তরুণ আলেমদের মধ্যে যারা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় সদর্পে বিচরণ করছেন তাদের একজন গাজী সানাউল্লাহ রাহমানী। কওমি মাদরাসাপড়ুয়া এই তরুণ প্রায় একযুগ ধরে এই জগতের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন আষ্টেপৃষ্ঠে। তার বলার ভঙ্গি ও উপস্থাপনা চমৎকার। লেখালেখির সঙ্গেও জড়িত। স্বপ্ন দেখেন তারুণ্য নিয়ে। তার সঙ্গে কথা বলেছেন ওমর ফারুক মজুমদার।
ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় অনেক দিন ধরে কাজ করছেন, এই অঙ্গন সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
আমার দৃষ্টিতে, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া হলো সমাজের একটি অনিবার্য অংশ। আজকের সমাজ যেমন ইলেকট্রিসিটি ছাড়া চলতে পারবে না, তেমনি এই সমাজ ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ছাড়াও চলতে পারবে না।
সময়ের গতি অথবা আমাদের জীবনের গতি আজ এমন এক পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে যে, আপনি যেমন খাবার ছাড়া একদিন থাকতে পারবেন না, তেমনি সমাজের একটি বড় অংশ ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ছাড়া থাকতে পারবে না।
আজকে আপনি সংবাদ বলুন, বিনোদন বলুন বা শিশুদের এন্টারটেনমেন্ট বলুন, সবকিছুর সমাহার এই ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে। তার মানে হলো, এই মাধ্যমটি সমাজের একটি অনিবার্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ মানুক আর না মানুক, এটিই আজ স্বীকৃত বাস্তবতা।
এখন কথা হলো, একজন আলেম হিসেবে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ব্যবহারকে কীভাবে নিচ্ছেন। এক্ষেত্রে বলে রাখা উচিত, একজন আলেমের পরিচয় হলো যিনি সমাজের মানুষকে সর্বদা সৎ পথে ডাকবেন। কল্যাণের পথে আহ্বান করবেন।
এই বিষয়টি অতি অল্প সময়ে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানোর সহজ মাধ্যমে হলো ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার গুরুত্ব আমার কাছে অপরিসীম।
লেবাস-পোশাক ঠিক রেখে ইসলামি প্রোগ্রাম ছাড়া টেলিভিশনের অন্য প্রোগ্রামগুলোতে কাজ করার সুযোগ আদৌ আছে কি?
আমি মনে করি, অবশ্যই আছে। দেখুন, আল্লাহভীতি হলো হৃদয়ে। নবীজি সা. যেমনটি বলে গিয়েছেন। হৃদয়টা যদি সজীব থাকে আমাদের জীবনও আলোকিত থাকবে।
আমার জানা মতে, বাংলাদেশের কোনো চ্যানেল এই কথা বলেনি যে, টিভিতে কাজ করতে গেলে টুপি খুলতে হবে। বা বোরকা পরে অফিসে আসা যাবে না। সব চ্যানেলেই ধর্মপ্রাণ মানুষ আছেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে যার যার ইবাদত করছেন।
কাজ করতে গিয়ে ধর্মীয় অনুশাসন পালনের ক্ষেত্রে কোনো রকম বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছেন, এমন কোনো সংবাদ আমার জানা নেই। ইতিমধ্যে দুয়েকটা বাদে দেশের প্রায় সবকটি চ্যানেলের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কথা বলার সুযোগ হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ।
কোথাও পোশাক কিংবা আলোচনার বিষয়ে কোনো ধরনের বিব্রতকর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়নি। বরং আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় দেখেছি, অধিকাংশ চ্যানেলে নামাজের সুন্দর ব্যবস্থা আছে। জামাতের সময় মুসল্লির সংখ্যাও আশা জাগানিয়া।
আপনার গদ্য ঝরঝরে, কিন্তু লেখার পরিমাণ এতো কম কেন?
একেবারে দুর্বল জায়গায় খোঁচা দিলেন! এই প্রসঙ্গে আমার প্রিয় কবি মুহিব খানের একটি মন্তব্য মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছিলেন, গাজী সানাউল্লাহ লেখালেখি ছেড়ে এখন দেখাদেখিতে চলে গেছে।
আসলে হয়েছে কী, লেখালেখিটা সাধনার একটি জায়গা। স্বপ্নের একটি অঙ্গন। কে কী বলবে সেটা জানি না। আমি অন্তত এমনটা মনে করি। চাইলেই কি আর এ জগৎ থেকে দূরে থাকা যায়!, তবে হ্যাঁ, আপনার অভিযোগ সত্য। বিষয়টি নিয়ে যে নিজের মধ্যে আফসোস নেই, এ কথা গোপন করবো না। ইনশাআল্লাহ, খুব শিগগির লেখার কিছু কাজ শুরু করার ইচ্ছে আছে, সবার দোয়া ও ভালোবাসা চাই।
ইসলামবার্তা নামে একটি অনলাইন সাময়িকী শুরু করেছিলেন, ধরে রাখতে পারলেন না কেন?
ধরে রাখতে পারিনি, এটা মানতে রাজি নই। আমি মনে করি, আমি নিজে হয়তো সেটিকে ধরে রাখতে পারিনি। কিন্তু আমাদের স্নেহধন্য একঝাঁক তরুণ সেটি ধারণ করে রেখেছে। দেখুন। বর্তমানে আমাদের কত কত অনলাইন পত্রিকা।
আমি মনে করি, জহির উদ্দিন বাবরসহ আমরা যারা তরুণদের প্রযুক্তিমুখিতার স্বপ্ন দেখেছিলাম তারা আজ সফল। এখন তো এক রকম ঘরে ঘরে অনলাইন সাময়িকী বা পোর্টাল। অনলাইন চ্যানেলও আছে বেশ কয়েকটি। মানের বিষয়টি যদি বাদ দিই, তাহলে নিশ্চয়ই এটি আনন্দময় সংবাদ। তবে হ্যাঁ, যে কারণে ইসলাম বার্তা চালু রাখতে পারিনি সেটি হলো, যোগ্য লোকের অভাব। সেই অভাব আজ কতটা পূরণ হয়েছে তা তর্কসাপেক্ষ।
ইসলামপন্থীদের পক্ষে ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা করা কতটুকু সম্ভব?
প্রথম কথা হলো, আমি আশাবাদী মানুষ। আমি মনে করি, একদিন না একদিন কোটি মানুষের এই স্বপ্ন পূরণ হবে ইনশাআল্লাহ। তবে এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। একটি ক্যামেরা আর একটি ল্যাপটপ দিয়ে কিন্তু চ্যানেল করা যায় না। মিডিয়া বা গণমাধ্যম আমাদের জন্য কতটা দরকারি এই বিষয়ে বিতর্ক কিন্তু এখনো শেষ হয়নি।
আমার মনে হয়, আমাদের অপেক্ষা করতে হবে দীর্ঘ সময়। কতদিন, সেটা আমি জানি না। তবে গণমাধ্যম বিষয়ে আমাদের উলামায়ে কেরামের চিন্তার দরজা প্রশস্ত হচ্ছে। একদিন না একদিন নিশ্চয়ই আমাদের নিজেদের একটি গণমাধ্যম হবে ইনশাআল্লাহ। অন্য অনেকের মতো সেই পথ চেয়ে আমিও বসে আছি।
আপনাদের দেখে যারা মিডিয়ায় আসতে চায় তাদের উদ্দেশে পরামর্শ কী থাকবে?
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ হলো, মাকসাদ ঠিক করা। মিডিয়াতে অনেকেই আসতে চান। কিন্তু এটাকে তারা শখ মনে করেন। চেহারা দেখাতে মিডিয়ায় আসার দরকার নেই। এটা শখের জায়গা নয়, কাজের জায়গা। পরিশ্রমের জায়গা। কাজের জন্য মিডিয়াতে আসুন। প্রত্যয় নিয়ে আসুন। দৃঢ় সংকল্প নিয়ে আসুন। যোগ্যতা-আন্তরিকতা ও শক্ত অভিপ্রায় নিয়ে আসুন। আপনার কাজের দরজা খুলে যাবে।
এজন্য প্রথম কাজ হলো, যোগ্যতা অর্জন কথা। শুধু জানলেই হবে না, নিজের ভেতরে সুপ্ত এই জ্ঞানকে সমাজের কল্যাণের জন্য সহজ ভাষায় উপস্থাপন করার দক্ষতাও অর্জন করতে হবে। এই লক্ষ্যে নিরলস পরিশ্রম ও অবিশ্রান্ত সন্তরণ মানজিলে মাকসাদে পৌঁছে দেবে ইনশাআল্লাহ।
[লেখা ও লেখকের কথা নিয়ে প্রকাশিত সাময়িকী ‘লেখকপত্র’ এর জানুয়ারি-মার্চ: ২০২০ সংখ্যার সৌজন্যে]