রকিব মুহাম্মদ ।।
মাওলানা আব্দুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ অনলাইনের পরিচিত মুখ। সমকালীন বিভিন্ন ইস্যুতে ইসলামি আলোচনার মাধ্যমে তিনি এক শ্রেণীর শ্রোতার কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।
সম্প্রতি তাকে নিয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম ফেসবুকে এক স্ট্যাটাস দিয়েছেন। মুহুর্তেই তা ভাইরাল হয়ে যায়।
তিনি লিখেছেন, মাওলানা আব্দুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ। ঢাকার পল্লবীর একটা মসজিদের খতীব। অসাধারণভাবে চিন্তা করেন এবং বলেন। কথার মধ্যে দরদ ভরা। এ রকমটা দেখেছি ডঃ খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যারকে। আমি জানতাম না, আজ শুনলাম সাইফুল্লাহ সাহেব আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যারের ছাত্র। যোগ্য শিক্ষকের যোগ্য ছাত্র। সাইফুল্লাহ সাহেব বলেছেন, আগে আমরা হুজুরদের কাছ থেকে দোয়া নিতাম।
এখন যা দেখছি তাতে মনে হচ্ছে, হুজুরদের জন্যই এখন আমাদের দোয়া করতে হবে। বুঝতে অসুবিধা হয়না যে, দুঃখ করেই তিনি এই কথাগুলি বলছেন। তাঁদের দিকে লক্ষ করেই বলছেন, যারা একে অপরের বিরুদ্ধে কেবল বলেই বেড়ায়। তাঁদের ওয়াজ মানে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা আর নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করা, সহিহ প্রমাণ করা।
দারুণ কথা বলেছেন সাইফুল্লাহ সাহেবঃ ‘কোন বে'দাতের সাথে আমাদের সম্পর্ক নেই, কোন খেলাপে-সুন্নাতের সাথে আমাদের সম্পর্ক নেই। তবে যেখানে সুন্নাতের বহুমুখীতা আছে সেখানে আমরা উদার।’ এই ‘সুন্নাতের বহুমুখীতা’ বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এটিই আমাদের ভাল করে বোঝা দরকার।
কে এই মাওলানা আবদুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ?
রাজধানীর পল্লবীর মসজিদুল জুমা কমপ্লেক্সের খতিব মাওলানা আবদুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে কমপারেটিভ রিলিজিয়াস বিষয়ে পিএইচডি করছেন। এছাড়াও তিনি বেসরকারি টেলিকম সংস্থা ইবিএসের রিলিজিসিয়াস এসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর।
পারিবারিক জীবনে তিনি দুই মেয়ের জনক। বড় মেয়ে নার্সারিতে পড়ে আর ছোট মেয়ের বয়স মাত্র ৮ মাস। তার গ্রামের বাড়ি নওগাঁ শহরে উকিলপাড়া। বাবা নওগাঁ আলিয়া মাদরসার প্রধান মুহাদ্দিস ও নওগাঁ কাঁচারি মসজিদের খতিব।
মাওলানা আবদুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহদের সাত ভাইবোন। পাঁচ ভাই ও দুই বোন। এর মধ্যে দুই ভাই ঢাকা মেডিকেলের ডা. নূরুল্লাহ ও ডা. নিয়ামতউল্লাহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছেন।
বালিশ নিয়ে বয়ান
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় নির্মাণাধীন ভবনের আসবাবপত্র ও বালিশ কেনা এবং অন্যান্য কাজের অস্বাভাবিক খরচের বিষয়ে বয়ান করেও আলোচনায় আসেন মাওলানা আবদুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ। বালিশ দুর্নীতি নিয়ে একটি ওয়াজ মাহফিলে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন তিনি।
ওয়াজে মাওলানা আবদুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ বলেন, ‘মিডিয়াতে যেভাবে আসছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বালিশের দাম নাকি ৬ হাজার টাকা। যদি ভালো বালিশ হয়। পারমাণবিক বালিশ হয়। তবে এখানে আরেকটি ব্যাপার রয়েছে, ওই বালিশ তুলতে নাকি আমার খরচ হয় ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা।
নিচ থেকে ওপরে ওঠাবে তাতেই ৮০০ টাকা। বিষয়টি কিন্তু হাসির কথা নয় ভায়েরা আমার, এটা ভয়ংকর ব্যাপর। এটা কেউ কেউ বলছে পুকুর চুরি। কিন্তু আমি বলছি এটা পুকুর চুরি নয় ভায়েরা আমার, এটা সমুদ্র চুরি।
https://www.facebook.com/abdulhimd.saifullah/videos/392365064686122/
বালিশের দাম ও বালিশ তোলার শ্রমিকের খরচও আমরা জানি। তবে এখন কথা হচ্ছে বালিশের দাম আমরা জানি বলেই বুঝতে পারছি কত বড় দুর্নীতি হয়েছে।
কিন্তু এই বালিশ ছাড়াও পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কাজের জন্য যেসব যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছে তার নাম, রং, আকৃতি ও দাম কিন্তু আমরা জানি না। তাহলে এ সব বিষয়ে কী ধরনের দুর্নীতি হচ্ছে তা জানা আমাদের সাধ্যের বাইরে। এ জন্য এটার নাম দিয়েছি সমুদ্র চুরি।
পাকসীতে আমার প্রচুর যাতায়াত রয়েছে। সেখানে এখন রেস্টুরেন্টের এক কাপ রং চায়ের দামও ৫৫ টাকা দিতে হয়। দাম বেড়েছে কেন? এটা পাকসী মনে করবেন না, এটা এখন মস্কো। রাশিযার সব কর্মচারীরা এখানে কাজ করছে। এখন এই এলাকার ৩০ টাকার রিকসা ভাড়া এখন ৭০ টাকা হয়েছে। কত বড় দুর্নীতি চিন্তা করে দেখেন ভায়েরা আমার।
এ সব কেন ঘটছে জানেন ভায়েরা আমরা? ঘটছে এই কারণে যে এখন আমাদের কাছে পাপ আর কোনো সাবজেক্টই না। কথা ঠিক কিনা বলেন? বিদেশিরা আমরাদের ঋণ দেয়। কিন্তু ওই ঋণের সঙ্গে শর্ত জুড়ে দেয়। ঋণ দিলে আমাদের কাজ থেকে এত টাকার জিনিসপত্র কিনতে হবে। যদি না মিলে তবে ব্যালেন্স করতে হবে। একটি ম্যাচের দাম যদি ৯ টাকা হয়, তবে যদি ব্যালেন্স করতে যদি ৯০০ টাকা বাকি থাকে তবে ম্যাচের দাম ৯০৯ টাকা ধরে ব্যালেন্স করতে হয়। রক্ত চোষা কাজ চলতেছে।
এসবের মুল কারণ কী? এসবের মূল কারণ হচ্ছে পাপ আর আমাদের কাছে কোনো গোনার বিষয় নয়। আল্লাহর কাছে দাঁড়াতে হবে, হিসেব দিতে হবে এটা আমাদের অনুভূতির মধ্যেই নেই। এত দুর্নীতিগ্রস্ত আমরা হয়ে গেছি প্রিয় বন্ধুরা আমরা। এ জন্য বালিশের দামও ঠিক আছে সবই ঠিক। দেখাতে এত ঠিক না দেখতে না জানি কী হচ্ছে আল্লাহ ভালো জানে।’
রোজা নিয়ে মাওলানা সাইফুল্লাহ’র ভাইরাল বক্তব্য
মাওলানা আবদুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ এক বয়ানে বলেন, যেসব নারীরা সংসারের কাজ করে তাদের আমরা তেমন মূল্যায়ন করতে চাই না। তবে তাদের অবশ্যই মূল্যায়ন করা উচিত। কারণ কোনো কাজকে ছোট করে দেখা উচিত নয়। কারণ আপনার মা বা স্ত্রী ঘরে যে কাজগুলো করেন তা তাদের জন্য ইহসান। তারা তা করতে বাধ্য নয়।
রোজায় সাহরির কথা উল্লেখ করে মাওলানা আবদুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ বলেন, আমাদের মা ও স্ত্রীরা সাহরিতে সবার আগে উঠেছে, খাবারগুলো গরম করেছে, সবাইকে ডাকছে উঠরে বাপ সময় নাই, সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছেন, আবার খাওয়ার পরে সেই বাসনগুলো ধুয়ে পরিষ্কার করছে। আপনি খেয়ে মসজিদে যাচ্ছেন নামাজ পড়তে। তিনি কিন্তু বসে নেই। বাসন ধোয়া ও মোছার কাজ শেষ হলেই তিনি নামাজ পড়ে তারপর ঘুমাতে যান। খবর নিয়েছেন কখনো। তাদের প্রতি সম্মান দেখান , তাদের খবর নিন।
ইফতারের আগে নারীদের কাজ করতে করতে ঘাম ছুটে যায়। তারা পরিবারের জন্য নিজের আন্তরিক্তার সবটুকু ঢেলে দেন।
https://www.facebook.com/abdulhimd.saifullah/videos/467392177339574/
তিনি বলেন, এতো গেল সাহরির কথা। আবার আসেন ইফতারের আগে রান্না করছেন, ইফতারি তৈরি করছেন। ইফতারের পরে আপনি খেয়ে মসজিদে দৌঁড় দেন নামাজের জন্য। আবার বাসায় ফিরে খাওয়া দাওয়া করে, কেউ টিভি দেখেন, কেউ মোবাইলে নেট চালান। কিন্তু এই মা বা স্ত্রী কিন্তু আপনার ও আপনার শিশুদের জন্য খাবার তৈরি করতে হয়রান। রাতে কী খাবেন? সাহরিতে কি খাবেন, খাওয়ার পরে ধোয়া-মোছার কাজ তো রয়েছে। কিন্তু আমরা তারাবি পড়ে ঘুমাই মা কিন্তু ঘুমায় না। কত কষ্ট করে আপনার আমার জন্য। কিন্তু তারা কিন্তু তা করতে বাধ্য নয়। বা না করলে গোনাগারও হবেন না।
তিনি আরো বলেন, তারাবির পরে এসে তৈরি খাবার পেয়ে যাচ্ছি। খেয়ে ঘুম। ভেবে দেখেছেন কি আপনার মা, স্ত্রী বোন আপনার জন্য কী করছেন?
বিয়ে করে নিয়ে এসেছেন বলেই করতে বাধ্য তারা এটা। না, তারা কিন্তু বাধ্য নয়। তারা কিন্তু কোনো কিছুর বিনিময়ে করছে না।
পরিবারের ভালোবাসা থেকে তারা এটি করছে। কিন্তু আপনি আমি কি করছি তাদের জন্য। ভেবে দেখেছেন কি? তাই এই মানুষগুলোর জন্য সহনুভূতিশীল হতে হবে, ভালোবাসতে হবে, তাদের ধন্যবাদ জানাতে হবে। না হলে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে প্রিয় ভাইয়েরা।
হযরত ওমর রাঃ উল্লেখ্য করে তিনি বলেন, এক লোকের স্ত্রী তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করে, তাই সে সিদ্ধান্ত নিল তার স্ত্রীতে তালাক দেবে। পরে সে এই সমস্যা সমাধানের জন্য হযরত ওমর রাঃ এর কাছে যায়।
হযরত ওমর রাঃ এর বাড়িতে যাওয়া পরে তিনি বাইরের থেকে হযরত ওমর (রাঃ) এর স্ত্রী চিৎকার ও চেঁচামেচি শুনতে পেলে এবং নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিলেন আমার আর বিচার দেওয়ার দরকার নেই।
কারণ হযরত ওমর রাঃ এর স্ত্রী যেভাবে চিৎকার ও চেচমেচি করছেন তা আমরার স্ত্রীর চেয়ে অনেক গুণে বেশি। তখন তিনি বাড়ির দিকে রওনা হলেন। পরে হযরত ওমর স্ত্রী সঙ্গে কথা শেষ করে দরজা খুলে ওই ব্যক্তিকে দেখতে পান।
পরে তাকে ডেকে বলেন তুমি কেন এসেছিলে। পরে লোকটি তার স্ত্রীর খারাপ আচরণের কথা বলে। পরে হযরত ওমর তাকে বলেন, স্ত্রী আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করলে আমি কিছু মনে করি না। কারণ তিনি আমার সংসার ও ছেলে মেয়েদের জন্য অনেক কষ্ট করেন। আমার সেবাযত্ন করেন। তাই এটা খুবই স্বাভাবিক। পরে লোকটি চলে গেলেন ও তার ভুল বুঝতে পারেন।
মাওলানা বলেন, অনেকে বলে থাকেন বউয়ের মেজাজ খিটখিটে, কেন খিটখিটে কখনও ভেবে দেখেছেন, খবর নিয়েছেন, একদিন বাচ্চাদের যত্ন নেন, ঘর গোছান, মসলা বাটেন, রান্না করেন দেখবেন মেজাজ ঠিক থাকবে না।
তিনি বলেন, অনেকে স্ত্রীদের কোথাও ঘুরতে নিয়ে যান না, উপহার সামগ্রী কিনে দেন না, সারা বছর একই কাজ সে শুধু করেই যাচ্ছে করেই যাচ্ছে, কোনো মানুষের মেজাজ ঠিক থাকবে। কতদিন পর্যন্ত তিনি পারবেন। আর কেনই বা তার মেজাজ ঠিক থাকবে।
স্ত্রীকে সম্মান করার নাম এহসান উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি এহসান হয়, গিফট বিনিময় হয়, হাদিয়া বিনিময় হয় তবে আপনি নিয়ামত পাবেন।
আরএম/