শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৬ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
ভারতের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ জয়পুরহাটে ১৫৫ মণ সরকারি চাল সহ আটক দুই তাপপ্রবাহ নিয়ে নতুন সংবাদ দিলো আবহাওয়া অধিদপ্তর রাঙামাটিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য পরিবহন ধর্মঘট বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখনো বিপদমুক্ত নয় : তারেক রহমান দেশের বিভিন্ন সেক্টরে অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে পরাজিত শক্তি: চরমোনাই পীর ‘শিক্ষা কমিশনে দেশের সর্বমহলে শ্রদ্ধেয় আলেমদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে’ আলমডাঙ্গায় রাসূল (সা.)-কে নিবেদিত কবিতা পাঠ ছাত্র-জনতার ওপর গুলি বর্ষণকারী শাহবাগ থানা আ.লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গ্রেফতার পার্বত্য জেলায় চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে যা জানাল আইএসপিআর

মুক্তিযুদ্ধে পটিয়া মাদরাসা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

শামসুল হক শারেক
সাংবাদিক ও গবেষক

বাংলাদেশে কওমি ধারার যে কয়টি বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে তার অন্যতম পটিয়া আল জামেয়া ইসলামিয়া। ১৯৭৬-৭৭ এবং ৭৭-৭৮ শিক্ষা বর্ষে দু’বছর পটিয়া মাদরাসার ক্যাম্পাসেই কেটেছে আমার। বিশাল এ দীনি প্রতিষ্ঠানের রয়েছে গৌরব উজ্জল ইতিহাস ঐতিহ্য। দেওবন্দ সিলসিলার প্রখ্যাত আলেমে মুফতি মরহুম মাওলানা আজিজুল হক রহ. এই মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা। হাটহাজারী বড় মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মরহুম মাওলানা জমির উদ্দিন এবং দেওবন্দ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মরহুম মাওলানা কাসেম-এর নামে এই মাদরাসার নাম করণ করা হয় জমিরিয়া কাসেমুল উলুম। এখন অবশ্য আল জামেয়াতুল ইসলামিয়া নামে দেশে বিদেশে ব্যাপক খ্যাতি পেয়েছে এটি।

জানা গেছে, যেখানে মাদরাসাটি হয়েছে এটি ছিল কুসংস্কারপূর্ণ একটি এলাকা। মুফতি মাওলানা আজিজুল হক রহ. ইসলামী শরিয়ার প্রচারে ওখানে একটি দীনি প্রতিষ্ঠান করতে চাইলে এলাকাবাসী মানতে রাজি হয়নি। এ কারণে তারা এক সময় মাদরাসা পুড়িয়ে দেয়। অনেক ক্ষতি করে মাদরাসার। আহত হয় মাদরাসার অনেক ছাত্র শিক্ষক।

ফার্সি একটি কবিতার লাইন মনে পড়ছে- “আগর গিতি সরাসর বাদ গিরদ চেরাগে মুকবিলাঁ হারগিজ নমিরদ।” অর্থাৎ আল্লাহর কোন প্রিয় বান্দার প্রজ্বলিত আলো বা চেরাগ যত ঝড় তুফান আসুক নিভে না। তাই হয়েছে পটিয়ার এই মাদরাসার ব্যাপারেও। এটি আজ উপমহাদেশের অন্যতম বিখ্যাত দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

দেশের শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, ফকিহ, দার্শনিক ও ইসলামি শরিয়াহ বিশেষজ্ঞদের অনেকই এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ছিলেন। উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমে, মুফাসসির খতিবে আজম মরহুম আল্লামা ছিদ্দিক আহমদ রহ. এই মাদরাসায় তাফসির এবং হাদিসের দরস দিতেন। তিনি একই সাথে দেশে ইসলামি শরিয়াহ আইন বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক ময়দানে ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

দেশের আলেম ওলামা ও ইসলাম প্রিয় জনতাকে একই প্লাট ফরমে এনে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন জোরদার করার নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে ছিলেন তিনি। নেজামে ইসলাম পার্টির প্রধান ছিলেন তিনি। ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ ‘আইডিএল’ প্রধানও ছিলেন তিনি। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে নেজামে ইসলাম পার্টির স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে যুক্তফ্রণ্টে যোগ দিয়েছিলেন।

বিভিন্ন সভা সমাবেশ এবং ওয়াজ মাহফিলে যাদুকরি বক্তৃতার জন্য তিনি খতীবে আজম খেতাব পেয়েছিলেন। বাংলা, আরবী, উর্দু-ফার্সি এবং ইংরেজি ভাষায় ও তিনি সমান পারদর্শী ছিলেন। অনেক বড় বড় মাহফিলে দেখেছি সর্বস্তরের মানুষ তন্ময় হয়ে তাঁর বক্তব্য শুনতে। তাঁর কাছে ইলমে তাফসির ও ইলমে হাদিসের জ্ঞান অর্জন করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তাঁর বড় বড় মাহফিলে যোগদান করে অনেক উপকৃত হয়েছি।

সুরায়ে ক্বদরের তাফসীর খতিবে আজমের কাছেই আমি প্রথম শুনেছি। ক্বদর রাতের মর্যাদা সম্পর্কে তিনি বলেন, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ক্বদর রাতের ইবাদতকে হাজার রাতের ইবাদাতের চেয়ে উত্তম বলেছেন। এখানে আল্ফ লাইল বা হাজার রাত বলা হয়েছে। কয় হাজার রাত বলা হয়নি। তাই আলফ এর অর্থ হাজার হাজার রাত বুঝানো হয়েছে। ক্বদর রাতের ইবাদত অর্থ হাজার হাজার রাত ইবাদত করার শামিল।

তখন পটিয়া থেকে কক্সবাজার আসতে গাড়িতে ভাল সিট পাওয়া যেত না। একদিন আমি বাসে করে কক্সবাজার আসছিলাম। গাড়িতে দেখি খতিবে আজম একটি সিটে বসা। তিনিও পটিয়া থেকে উঠেছেন। সম্ভবত তাঁর জন্য আগে থেকেই সিট নিয়ে রাখা হয়েছিল। তিনি আশ পাশের লোকজনের সাথে কথা বলছিলেন।

আমার বয়স এবং তুলনামূলক নিচের ক্লাশে হওয়ার কারণে আমাকে তিনি চেনার কথা নয়। আমি খতিবে আজমকে দেখে জড়ো সড়ো হয়ে তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়াই। আমার জড়ো সড়ো ভাব দেখে তিনি আমাকে কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেন এবং নাবিস্কো চকলেট খেতে দিয়েছিলেন। যা এখনো আমার মনে পড়ে।

মেরাজ সম্পর্কে তাঁর আরো একটি যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য শুনেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, মেরাজের রাতে রসুল করিম সঃ এর মহাশূণ্য ভ্রমণ এবং মহান আল্লাহ তায়ালার সাক্ষাত অবশ্যই বিষ্ময়কর। তবে আল্লাহর হুকুমে আল্লাহর বান্দার এই সফর অসম্ভব কিছু নয়। কুরআন হাদিস দ্বারা যেমন এটি প্রমাণিত সত্য। সাধারণ যুক্তিতেও এই সত্য অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই।

যেমন দেশের প্রেসিডেন্ট অথবা প্রধানমন্ত্রী কোথাও সফর করলে সেখানে অন্য সব যানবাহন চলাচল এবং স্বাভাবিক কার্যক্রম একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ রাখা হয়। তেমনি আল্লাহ তায়ালার প্রিয় বান্দা তাঁর সান্নিধ্যে সফরের সময় সৃষ্টিজগতের অন্য সব কর্যক্রম কিছু সময়ের জন্য বন্ধ করে রেখেছিলেন। দুরত্ব এবং সব ধরনের বৈরী পরিবেশকে সহজ করে রসুল সঃ কে উর্দ্ধলোকে তাঁর সান্নিধ্যে নিয়ে গিয়েছিলেন।

এখানে জানতে পারলাম স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই মাদরাসার ছিল এক গৌরব উজ্জ্বল অবদান। যুদ্ধের সময় তৎকালীন ১নং সেক্টর (চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ফেনী নদী পর্যন্ত) কমাণ্ডার মেজর (পরে রাষ্ট্রপতি) জিয়াউর রহমান তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের ট্রান্সমিটারসহ কৌশলগত কারণে এই মাদরাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন।

মুক্তিযোদ্ধারা এই মাদরাসায় আশ্রয় নেয়ার খবর পেয়ে পাকিস্তান বাহিনী মাদরাসায় বোমা বর্ষণ করেছিল। এতে মাদরাসার জেষ্ট্য শিক্ষক ও মোহাদ্দিস মাওলানা দানেশ শহীদ হয়েছিলেন। মাদরাসা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। মুক্তি যুদ্ধের সময় এই মাদরাসার অবদানের কথা হয়ত মেজর জিয়ার মনে ছিল। তাই রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর একদিন তিনি এই মাদরাসার সার্বিক অবস্থা পরিদর্শনে এসেছিলেন।

তখন মাদরাসার পরিচালক ছিলেন মরহুম মাওলানা মুহাম্মদ ইউনুস (প্রকাশ হাজী সাহেব হুজুর)। দিন তারিখ মনে নেই। রেওয়াজ অনুযায়ী একদিন মাদরাসা মসজিদে ঘোষণা দেয়া হল রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান মাদরাসা পরিদর্শনে আসবেন। মাদরাসায় রাষ্ট্রপতি আসবেন অনেক বড় আয়োজন। চলছিল নানা ধরনের প্রস্তুতি।

অন্যান্য আয়োজনের সাথে ব্যানার, ফেস্টুন, গেট তৈরি ও দেয়ালে নানা স্লোগান লিখতে হবে। এজন্য যাদের হাতের লেখা সুন্দর তাদের ডাক পড়ল। এদের মধ্যে আমিও বাদ পড়লাম না। ছোট বেলায় বাবার তাগিদে হাতের লেখা সুন্দর করার যেন পুরস্কার পেলাম! শুভেচ্ছা স্বাগতম, মেজর জেনারেল রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বলে প্রধান গেইটের লেখাটি ছিল আমার। আমাদের টিমে মেধাবী ছাত্র রামুর হাফেজ নুরুল হকও ছিলেন। তিনি এখন প্রবাসে।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই মাদরাসার ছিল এক গৌরব উজ্জ্বল অবদান। যুদ্ধের সময় তৎকালীন ১নং সেক্টর (চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ফেনী নদী পর্যন্ত) কমাণ্ডার মেজর (পরে রাষ্ট্রপতি) জিয়াউর রহমান তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের ট্রান্সমিটারসহ কৌশলগত কারণে এই মাদরাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। মুক্তি যোদ্ধারা এই মাদরাসায় আশ্রয় নেয়ার খবর পেয়ে পাকিস্তান বাহিনী মাদরাসায় বোমা বর্ষণ করেছিল। এতে মাদরাসার জেষ্ট্য শিক্ষক ও মোহাদ্দিস মাওলানা দানেশ শহীদ হয়েছিলেন।

অনুষ্ঠানের দিন রাষ্ট্রপতি জিয়া যথাসময়ে মাদরাসায় আসলেন। মাদরাসার শিক্ষক-ছাত্রদের প্রতি সমীহ দেখালেন। মুক্তিযুদ্ধে এই মাদরাসার অবদানের কথা স্মরণ করলেন। বিশেষ করে হাজী সাহেব হুজুরের প্রতি যে ভক্তি শ্রদ্ধা তিনি দেখালেন তা ছিল লক্ষণীয়। হাজী সাহেব হুজুরের পেছনে পেছনে হেঁটে রাষ্ট্রপতি জিয়া দারুল হাদিস, দারুত্তাফরির ও লাইব্রেরীসহ বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। মাঝে মধ্যে হাজী সাহেব হুজুর রাষ্ট্রপতি জিয়াকে তাঁর হাত ধরে এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে নিয়ে গেলেন। সে দিন দুপুরে রাষ্ট্রপতি পটিয়া ডাকবাংলোতে বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে পটিয়া কলেজ মাঠে এক জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন।

এভাবে পটিয়া মাদরাসায় অনেক দেশি বিদেশি মেহমানদের দেখার এবং তাঁদের স্বাগত জানানোর সুযোগ হয়েছিল। একদিন ভারতের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন মাওলানা হোছাইন আহমদ মাদাদি এর সুযোগ্য সন্তান মাওলানা আসয়াদ মাদানি এখানে সফরে আসেন।

উপমহাদেশে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে ওলামায়ে কেরামদের ভূমিকা ছিল অসামান্য। মাওলানা হোছাইন আহমদ মাদানি ছিলেন এর অন্যতম। তাই তাঁর ছেলেকে দেখার জন্য আমদের উৎসুখের অন্ত ছিল না। তিনি মাদরাসার মসজিদে ভারতবর্ষে কওমি মাদরাসার প্রতিষ্ঠা ও এর ভূমিকা সম্পর্কে উর্দু ভাষায় বক্তব্য রেখেছিলেন।

পটিয়া মাদরাসার এক প্রাক্তন ছাত্র (পরে তিনি ওই মাদরাসার পরিচালক হয়েছেন) মাওলানা হারুন ইসলামাবাদী আরব আমিরাতে কাজি (বিচারক) হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তাঁর মাধ্যমে হাজি সাহেব হুজুরের আমন্ত্রণে আমিরাতের প্রধান বিচারপতি একদিন পটিয়া মাদরাসায় আসলেন। বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন হল। মেহমান আরবিতে বক্তব্য রাখছিলেন। আমরা মাদরাসার ছাত্র হয়েও তাঁর বক্তব্য পুরোপুরি বুঝতে ছিলাম না। হারুন সাহেব মেহমানের বক্তব্য বাংলায় অনুবাদ করছিলেন। এটা দেখে আমাদের মধ্যে অন্যরকম এক অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল।

এখানে পড়ার সময় প্রতি বৃহষ্পতি/জুমাবার না হলেও মাঝে মধ্যে আমরা দল বেঁধে তাবলিগে দ্বীন বা দ্বীনের দাওয়াতী কাজে বের হতাম।

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ