বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ২৮ কার্তিক ১৪৩১ ।। ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


আকাশছোঁয়া ৫ মিনার

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আব্দুল্লাহ আফফান ।।

মিনার হল মসজিদের সাথে যুক্ত স্থাপত্য। যা মসজিদের সৌন্দর্য  বৃদ্ধি করে। মিনারের শীর্ষভাগ মসজিদের থেকে উঁচু হয়। এর শীর্ষভাগ সূচালো বা পেয়াজাকৃতির হয়ে থাকে। আজানের আওয়াজ দূরে পৌছানোর জন্য মিনারের ব্যবহার হয়।

ব্যবহার: মূলত আজানের শব্দ দূরে পৌঁছানোর জন্য মিনারের ব্যবহার শুরু হয়। দিনে পাঁচবার নামাজের সময় সময় আজান দেয়া হয়। আধুনিক যুগে মাইকের সাহায্যে আজান দেয়া হয়। তবে এরপরও মসজিদের স্থাপত্যে মিনারের ব্যবহার রয়েছে। মিনারের শীর্ষে মাইক যুক্ত করে শব্দ দূরে পৌঁছানো যায়।

ইতিহাস: প্রথমদিকে মদিনায় মিনারের ব্যবহার ছিল না। সেসময় ছাদের ওপর থেকে আজান দেয়া হত। মুহাম্মদ সা. এর মৃত্যুর অনেক বছর পর মিনারের ব্যবহার শুরু হয়।

তিউনিসিয়ার উকবা মসজিদের বড় মিনারটি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন টিকে থাকা মিনার। ৮৩৬ সালে এর নির্মাণ সম্পন্ন হয়। এছাড়া পরবর্তী অনেক মিনারের জন্য এই মিনার মডেল হিসেবে কাজ করেছে।

সর্বোচ্চ মিনারটি মরক্কোর কাসাব্লাংকায় দ্বিতীয় হাসান মসজিদে অবস্থিত। এর উচ্চতা ২১০ মিটার (৬৮৯ ফুট)। ইট নির্মিত সর্বোচ্চ মিনার হল ভারতেরদিল্লির কুতুব মিনার।

নির্মাণ: মিনারে মূলত তিনটি অংশ থাকে, ভিত্তি, উপরে উত্থিত অংশ ও গ্যালারি। মাটি খুড়ে শক্ত ভিত্তি নির্মাণ করতে হয়। মিনার বর্গাকার, বেলনাকার বা বহুভুজাকারও হতে পারে। উপরের অংশ জুড়ে পেঁচানো সিড়ি কাঠামোকে অতিরিক্ত মজবুত হতে সাহায্য করে।

শীর্ষভাগে গ্যালারি থেকে মুয়াজ্জিন আজান দেন। মিনার বিভিন্নভাবে অলংকরণ করার রীতি রয়েছে।

গ্র্যান্ড মস্ক হাসান: গ্রান্ড মস্ক হাসান বা দ্বিতীয় হাসান মসজিদের অনেকগুলো বিশেষত্ব রয়েছে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু মিনার বিশিষ্ট মসজিদ। বিশ্বের আলোচিত সুন্দর এই মসজিদের তিন ভাগের এক ভাগ আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর অবস্থিত।

মরক্কোর বাদশাহ দ্বিতীয় হাসান মসজিদটি তৈরি করেছেন। দূরের কোনো জাহাজ থেকে দেখলে মনে হয়, ঢেউয়ের বুকে যেন মসজিদটি দুলছে আর মুসল্লিরা যেন নামাজ পড়ছেন পানির ওপর।

মহাসাগরে ভাসমান এ মসজিদটি মরক্কোসহ আফ্রিকার সবচেয়ে বড় মসজিদ। মসজিদটির ভেতরে ২৫ হাজার এবং ভেতরে-বাইরে মিলিয়ে একসঙ্গে লক্ষাধিক মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন।

এই মসজিদে নারীদের জন্য রয়েছে নামাজ আদায়ের আলাদা ব্যবস্থা। ঝড়-বৃষ্টির সময় ছাড়া প্রাকৃতিক আলো ও মুক্ত বাতাস প্রবেশ করাতে মসজিদটির ছাদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যায় তিন মিনিট পরপর। ৩৩ ফুট উচ্চতার সামুদ্রিক ঢেউ সামলে নেওয়ার ব্যবস্থা আছে মসজিদটিতে।

মসজিদটির ভেতর থেকে সমুদ্রের গর্জন শোনা যায় না। ২২ দশমিক ২৪ একর জায়গার ওপর অবস্থিত এ মসজিদের মূল ভবনের সঙ্গে আছে সভাকক্ষসহ লাইব্রেরি, কুরআন শিক্ষালয়, অজুখানা।

মসজিদটি আড়াই হাজার পিলারের ওপর স্থাপিত। মসজিদ এলাকার আশপাশ সাজানো হয়েছে ১২৪টি ঝরনা ও ৫০টি ক্রিস্টালের ঝাড়বাতি দিয়ে। শুধু তাই নয়, কোথাও কোথাও এসব মোড়ানো হয়েছে স্বর্ণের পাত দিয়ে।

মসজিদটির মেঝে থেকে ছাদের উচ্চতা ৬৫ মিটার। মেহরাবের উচ্চতা দোতলা ভবনের সমান। আর মিনারের উচ্চতা ২১০ মিটার। ৬০ তলা ভবনের সমান এ মিনারের ওপরে রয়েছে লেজার রশ্মি। যা নাবিকদের দেখিয়ে দেয় পবিত্র কাবা শরিফের পথ। ৩০ কিলোমিটার দূর থেকেও স্পষ্ট দেখা যায় এই লেজার রশ্মি। বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু মিনার এটি।

২০১ গম্বুজ মসজিদ: এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি গম্বুজ এবং দ্বিতীয় উচ্চতম মিনার বিশিষ্ট মসজিদ। এই মসজিদের নকশা করা হয়েছে ২০১টি গম্বুজ ও ৯টি মিনার দিয়ে সজ্জিত একটি পূর্নাঙ্গ মসজিদ কমপ্লেক্স হিসেবে। মসজিদটি এখনো নির্মাণাধীন।

অবস্থান: মসজিদটি বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার নগদা শিমলা ইউনিয়নের দক্ষিণ পাথালিয়া গ্রামে অবস্থিত।

ইতিহাস: ২০১৩ সালের জানুয়ারি এই মসজিদ নির্মাণ কাজ শুরু হয়। মসজিদটি মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে নির্মিত হচ্ছে। এ কাজের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের মা রিজিয়া খাতুন। মসজিদ নির্মাণে ব্যয় হবে আনুমানিক ১০০ কোটি টাকা।

২০১৭ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নির্মাণ কাজ এখনো চলছে। নির্মাণ শেষ হলে কাবার ইমাম এসে নামাযের ইমামতি করে মসজিদটি উদ্বোধন করবেন। পৃথিবীর ইতিহাসে কখনো এত সংখ্যক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ তৈরী হয়নি।

স্থাপত্যশৈলী: অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদের ছাদে ৮১ ফুট উচ্চতার একটি গম্বুজ রয়েছে। এই বড় গম্বুজের চারপাশে ছোট ছোট গম্বুজ আছে ২০০টি। এদের প্রত্যেকের উচ্চতা ১৭ ফুট।

মূল মসজিদের চার কোণায় রয়েছে ৪টি মিনার। এদের প্রত্যেকের উচ্চতা ১০১ ফুট বা ১৩৭ মিটার। পাশাপশি আরও চারটি মিনার আছে ৮১ ফুট বা ২৫ মিটার উচ্চতার। সবচেয়ে উঁচু মিনারটি মসজিদের পাশেই অবস্থিত। এর উচ্চতা ৪৫১ ফুট।

১৪৪ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৪৪ ফুট প্রস্থের দ্বিতল এই মসজিদে একসঙ্গে প্রায় ১৫ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। মসজিদের দেয়ালের টাইলসে অঙ্কিত রয়েছে পূর্ণ পবিত্র কুরআন শরিফ। মসজিদের প্রধান দরজা নির্মাণে ব্যবহার করা হবে ৫০ মণ পিতল। আজান দেওয়ার জন্য মসজিদের সবচেয়ে উঁচু মিনারে বানানো হবে। মসজিদটি সম্পুর্ন শিতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলেও এতে সহস্রাধিক বৈদ্যুতিক পাখা যুক্ত করা হবে।

মসজিদ কমপ্লেক্স: ১৫ বিঘা জমির ওপর বিশাল মসজিদ ও মসজিদ কমপ্লেক্স অবস্থিত। মিহরাবের পাশে লাশ রাখার জন্য হিমাগার তৈরী করা হবে। এছাড়া মসজিদের পাশে নির্মাণ করা হবে আলাদা ভবন। ওই ভবনে থাকবে দুঃস্থ নারীদের জন্য বিনা মূল্যের হাসপাতাল, এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম, দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের পুর্নবাসনের ব্যবস্থা।

মসজিদ ও জীবন্ত মসজিদ

মসজিদে নববী: মুহাম্মদ সা.কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মসজিদ যা বর্তমান সৌদি আরবের মদিনায় অবস্থিত। গুরুত্বের দিক থেকে মসজিদুল হারামের পর মসজিদে নববীর স্থান। এটি পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ মসজিদ।

মুহাম্মদ সা. এর বাসগৃহের পাশে এই মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে মসজিদের নির্মাণকাজে অংশ নিয়েছিলেন। সেসময় মসজিদ সম্মিলনস্থল, আদালত ও মাদরাসা হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে।

মসজিদ সম্প্রসারণ: পরবর্তীকালের মুসলিম শাসকরা মসজিদ সম্প্রসারণ ও সৌন্দর্যবর্ধন করেছেন। তারা হলেন দ্বিতীয় খলিফা উমর, তৃতীয় খলিফা উসমান, উমাইয়া খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদ, উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ, আব্বাসীয় খলিফা আল মাহদি, আল-আশরাফ কানসুহ আল-গাউরি, প্রথম আবদুল মজিদ, আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ, ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ , ফাহাদ বিন আবদুল আজিজ।

মিম্বর: মুহাম্মদ সা. কর্তৃক ব্যবহৃত মিম্বরটি খেজুর গাছের কাঠ দিয়ে নির্মিত হয়েছিল। পরে এর স্থলে অন্য মিম্বর বসানো হয়। ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে একটি তিন ধাপ বিশিষ্ট সিড়ি যুক্ত করা হয়। তৃতীয় খলিফা উসমান এর উপর একটি গম্বুজ বসান এবং বাকি ধাপগুলো আবলুস কাঠ দিয়ে মুড়ে দেন।

১৩৯৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম বাইবার্স‌ মিম্বরটি সরিয়ে নতুন মিম্বর স্থাপন করেন এবং ১৪১৭ খ্রিষ্টাব্দে শাইখ আল-মাহমুদি নতুন মিম্বর স্থাপন করেন। ১৫শ শতাব্দীর শেষের দিকে কাইতবে মার্বেলের মিম্বর স্থাপন করেন।

গম্বুজ: মসজিদে সমতল ছাদ এবং বর্গাকার ভিত্তির উপর ২৭টি চলাচলসক্ষম গম্বুজ রয়েছে। গম্বুজের নিচের খোলা স্থানে ভেতরের স্থান আলোকিত করে। গম্বুজ সরিয়ে ছায়ার ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া প্রাঙ্গণে থাকা স্তম্ভের সাথে যুক্ত ছাতাগুলো খুলে দিয়ে ছায়ার ব্যবস্থা করা হয়।

মিনার: প্রথম মিনারগুলো ২৬ ফুট (৭.৯ মি) উঁচু ছিল যা উমর রা. কর্তৃক নির্মিত হয়। ১৩০৭ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মদ ইবনে কালাউন বাব আল-সালাম নামক মিম্বর স্থাপন করেন। পরে চতুর্থ মুহাম্মদ এটি সৌন্দর্য‌মন্ডিত করেন।

১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দের সংস্কার কার্যে‌র পর মোট মিনারের সংখ্যা দাঁড়ায় দশ যেগুলো ১০৪ মিটার বা ৩৪১ ফুট উচু। মিনারগুলোর উপর, নিচ ও মধ্যম অংশ যথাক্রমে সিলিন্ডার, অষ্টাভুজ ও বর্গাকার।

বাংলাদেশের মসজিদ

ফয়সাল মসজিদ: এটি পাকিস্তানের বৃহত্তম মসজিদ, যা পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে অবস্থিত। মসজিদটি ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। তুর্কি স্থপতি ভেদাত ডালোকে এর ডিজাইন করেন। মসজিদটি দেখতে অনেকটা মরুভূমির বেদুঈনদের তাঁবুর মতো। সারা পৃথিবীতে এটি ইসলামাবাদের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

সৌদি বাদশাহ ফয়সাল বিন আব্দুল আজিজ এই মসজিদ নির্মাণে সমর্থন এবং অর্থ সাহায্য প্রদান করেন। তাই এই মসজিদটি শাহ্‌ ফয়সালের নামে নামকরণ করা হয়।

এই মসজিদটি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম মসজিদ। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত মসজিদটি পৃথিবীর বৃহত্তম মসজিদ ছিলো। পরবর্তীতে মরক্কোর কাসাব্লাঙ্কায় হাসান ২ মসজিদ নির্মাণ হলে ফয়সাল মসজিদ তার অবস্থান হারায়।

তাতে চারটি মিনার রয়েছে। মিনার উচ্চতা ৯০ মিটার বা ৩০০ ফুট। মসজিদটি বানাতে খরচ হয়েছে ১২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

বাংলাদেশের মসজিদ

কুতুব মিনার: ভারতের দিল্লীতে অবস্থিত একটি  মিনার, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ ইটনির্মিত মিনার। এটি কুতুব কমপ্লেক্সের মধ্যে অবস্থিত। ভারতের প্রথম মুসলমান শাসক কুতুবুদ্দিন আইবেকের আদেশে এর নির্মাণকাজ ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়। তবে মিনারের উপরের তলাগুলোর কাজ ফিরোজ শাহ তুঘলক ১৩৮৬ খ্রিস্টাব্দে সম্পূর্ণ করেন ।

ভারতীয়-মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন বলে কুতুব মিনার বেশ উল্লেখযোগ্য। এর আশে পাশে আরও বেশ কিছু প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় স্থাপনা এবং ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, যারা একত্রে কুতুব কমপ্লেক্স হিসেবে পরিচিত। এই কমপ্লেক্সটি ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাবদ্ধ হয়েছে এবং এটি দিল্লীর অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য।

গঠন: কুতুব মিনার বিভিন্ন নলাকার শ্যাফট দিয়ে গঠিত যা বারান্দা দ্বারা পৃথকীকৃত। মিনার লাল বেলেপাথর দিয়ে তৈরী যার আচ্ছাদন এর উপরে পবিত্র কোরআনের আয়াত খোদাই করা।

ভূমিকম্প এবং বজ্রপাত এর দরুন মিনার এর কিছু ক্ষতি হয় কিন্তু সেটি পুনরায় শাসকদের দ্বারা ঠিক করা হয়। কুতুব মিনার এর দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে ২৫ ইঞ্চি একটি ঢাল আছে যা "নিরাপদ সীমার মধ্যে" বিবেচিত হয়।

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ