সারাদিন রোদ ঢেলেছে সূর্য। এখন শেষ বিকেলে ক্লান্ত হয়ে ছুঁই ছুঁই করছে পশ্চিমের পাহাড় চূড়া। আরেকটু পরই সূর্য পাহাড়ের আড়ালে চলে যাবে। তারপরই আঁধারের ছায়া নামবে পূবের দিগন্তরেখায়। হামাগুড়ি দিতে দিতে সে ছায়া দ্রুত এগিয়ে আসতে থাকবে। একসময় গোটা চরাচর ঢাকা পড়ে যাবে আঁধারের কালো পর্দায়। তার সাথে ওয়াদিউল কুরাও। রাত মানে অন্ধকার, রাত মানে শান্তি ও গভীর ঘুম।
ইহুদি বনি আসার গোত্রের বিরাট এ পল্লিটি গড়ে উঠেছে আল-কাব পাহাড়ের পাদদেশে। একদিকে বেশ উঁচু পাহাড়, আরেকদিকে মরুভূমি। সারা জনপদে অনেক খেজুর গাছ। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, পাহাড়ের গা থেকে নেমে আসা একটি সবুজ রেখা হঠাৎ করেই সীমাহীন মরুভূমির কিনারে এসে থমকে গেছে।
সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্তের এ সময়টিতে ওয়াদিউল কুরা পল্লিবাসীদের প্রায় সকলেই খুব ব্যস্ত। আসন্ন রাতের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে তারা। ইতোমধ্যেই ভেড়া আর ছাগলের পাল নিয়ে ফিরতে শুরু করেছে রাখালেরা। পল্লির পথে ঘন হয়ে উড়ছে ধূলি। ঘরে মেয়েরা গুছিয়ে রাখছে মশাল, প্রদীপ আর মোমবাতি। দিনের আলোর শেষ আভাটুকুও বিলীন হওয়ার পর ঘরে ঘরে আলো জ¦লে উঠতে শুরু করবে।
দাসী ঘরে প্রদীপ জ¦ালিয়ে দিয়ে গেছে। সে আলোতে রূপসজ্জা শেষ করে হরদিয়া। এমনিতেই খুব সুন্দরী সে। এ মুহূর্তে তাকে সুন্দরীশ্রেষ্ঠা মনে হচ্ছে। মায়ের হিসাব মতো এ বছর বিশের ঘরে পা দিয়েছে সে। ওয়াদিউল কুরায় তার চেয়ে সুন্দরী কোনো কুমারী নেই। আশপাশের সব পল্লিতেও তার রূপের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। বহু যুবক তাকে জীবনসঙ্গিনী হিসাবে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল। এ জন্য বেশ গর্ববোধ করে হরদিয়া। তাদের পল্লির মেয়েদের দু-একজন এ রূপের কারণে তাকে হিংসা করে, তাও জানে সে। তবে তা নিয়ে সে মোটেও মাথা ঘামায় না। তার মাথায় এখন অন্য চিন্তা। সে এমন এক চিন্তা যা হরদিয়াকে বেসামাল করে তুলেছে। কী করে কাজটি করা যায় তা ভেবে রেখেছে সে। চিন্তা হল যাকে দিয়ে তা করানো হবে তাকে নিয়ে। কারণ তার শর্ত। সে শর্ত দিয়েছে কাজটি সে করবে, তবে হরদিয়ার সাথে বিয়ে হওয়ার পরই করবে, তার আগে নয়।
হরদিয়া এখন যাবে বনি মোস্তালিকের কুয়ার পাড়ে। সেখানে তার দেখা হবে আইয়ুব ইবনে তালহার সাথে। ওয়াদিউল কুরার যুবকদের মধ্যে শক্তি ও সাহসে সে সবার সেরা। এমনকি আশপাশের পল্লিগুলোতেও তার সমকক্ষ বীর আর কেউ নেই। তবে এই কিছুদিন আগেও আইয়ুবের চেয়েও সেরা একজন বীর ছিল। তবে তার কথা মনে আনতে চায় না হরদিয়া। যাহোক, হরদিয়ার প্রেমে একেবারে হাবুডুবু খাচ্ছে আইয়ুব। কিন্তু হরদিয়া তাকে একটুও পছন্দ করে না। কিন্তু বীরযোদ্ধা হলে কি হবে, আইয়ুবের চরিত্র ভালো নয়। ইতোমধ্যেই দু-দুবার বিয়ে করেছে সে। কিন্তু কোনো স্ত্রীই তার ঘর করতে পারেনি। স্ত্রীদের কাউকেই নাকি তার পছন্দ হয়নি।
মারধরসহ নানা অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে শেষ পর্যন্ত দুজনেই তার ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। তারপর থেকেই আইয়ুবের চোখ পড়েছে হরদিয়ার ওপর। কিন্তু হরদিয়া অন্য ধাতুতে গড়া। তার কাছাকাছি ঘেঁষতে পারেনি আইয়ুব। অনেক চেষ্টা তদবির করে, লোকজন লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত হরদিয়ার কাছে নিজের মনে কথা পৌঁছাতে পেরেছে সে। হরদিয়া প্রথম দিকে পাত্তা দেয়নি। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে ওঠায় নিরুপায় হয়ে আইয়ুবের একতরফা প্রেমের জবাবে সাড়া দিতে শুরু করে। হরদিয়া নিজেও জানে যে প্রেম ভালোবাসা বলতে যা বোঝায় এটা তা নয়। আসলে এটাকে তার অভিনয় বললেই ঠিক বলা হয়। যেহেতু সে একটি ভয়ঙ্কর কাজ করতে চায় সে জন্য আইয়ুবের মতো একজন সাহসী ও বীর যুবককে তার হাত করা দরকার। এর মধ্যে দুদিন তার সাথে সাক্ষাত করেছে সে।
আইয়ুবের একই কথা, হরদিয়ার সম্মতি পেলেই সে তার বাবা শামাউনের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে। আইয়ুবকে এ রকম নাছোড়বান্দা দেখে হরদিয়া তার কাছে নিজের প্রস্তাবটি পেশ করে। হরদিয়াকে পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে আইয়ুব। কোনো চিন্তা-ভাবনা না করেই তার প্রস্তাবে রাজি হয়েছে সে। কিন্তু কথা হলো, বিয়েটা আগে হতে হবে। হরদিয়া দিন কয়েক সময় নিয়েছে তার কাছ থেকে। সে বুঝতে পারছে, আইয়ুবকে আর বেশিদিন ঘোরানো যাবে না, শিগগিরই তাকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। তবে আইয়ুবকে বিয়ে করবে, এটাই শুনতে চাইবে সে। অন্যকিছু বললে তার বিরাগভাজন হতে হবে। সেটা ভালো হবে না।
প্রদীপের আলোয় প্রসাধন শেষ করে উঠেপড়ে হরদিয়া। দামেস্ক থেকে আনা আয়নায় নিজেকে দেখে সে। নিজের রূপে যেন নিজেই মুগ্ধ হয়ে পড়ে। যুবকরা তার এ রূপ দেখে পাগল হবে না তো কি করবে? ওয়াদিউল কুরার যুবকদের কেউ যদি তাকে অংকশায়িনী করতে পারে, নিজেকে ধন্য মনে করবে। কিন্তু তারা তো জানে না, হরদিয়া কি চায়। জানলে তাকে বিয়ে করার জন্য অনেকের আগ্রহেই হয়ত ভাটা পড়ত।