মুহাম্মদ জিয়াউল হক
অতিথি লেখক
তারা তোমাদের , আর তোমরাও তাদের পরিচ্ছদ
নারী ও পুরুষকে আল কুরআনে পরষ্পরের পোশাক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে৷ তার মানে কী? সমাজে তারা একে অন্যের উপর নির্ভরশীল৷ নারী যেমন পুরুষের ভূষণ হিসেবে তার যায়গায় ক্ষমতাবান, পুরুষও তেমনি নারীর অলংকরণ৷ তাদের আন্ত:লিঙ্গীয় সম্পর্ক দ্বান্দ্বিক কিংবা পুরুষ বা নারীতান্ত্রিক নয়; বরং ইসলামি সমাজ হবে পরষ্পর নির্ভরশীলতার ও নারী পুরুষের সমমর্যাদার ৷
নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন
মহর প্রদানের নিশ্চয়তা বিধানের মাধ্যমে ইসলামি সরকারের নিকাহ বিভাগ বিবাহের প্রথম প্রহরেই নববধুকে স্পর্শের আগেই তাকে অর্থকড়ির স্বত্তাধিকারী বানাবে৷
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সচেতনতার মাধ্যমে পুরুষকে স্ত্রীর মহর প্রদানের ‘গণ প্রবণতা’ তৈরি করবে কর্তৃপক্ষ ৷ যা বর্তমানের সেক্যুলার সমাজে বিরলদৃষ্ট ৷ ফলে বাসরশয্যায় নবদুলহান তার মেহেদী রাঙা হাতেই ভালমানের একটা আর্থিক উপঢৌকন পেয়ে যাবেন প্রেম, ভালোবাসা, সম্মান, মর্যাদা, আর্থিক নিরাপত্ত্বা ও ক্ষমতায়নের প্রতীক স্বরূপ৷ যার তসররুফের এখতেয়ার একচেটিয়া নারীরই থাকবে ৷
নারীর এমন আর্থিক ক্ষমতায়ন পৃথিবীর অন্য কোন নারীবাদী মতবাদ ও সংস্থার ফর্মূলায় পিএইচডি গবেষণা করেও খুঁজে পাওয়া যাবে না ৷
শিক্ষায় নারী
নারী ও পুরুষের লৈঙ্গিক পৃথকতা মেনে নিয়েই বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের পৃথক হল থাকছে৷ ইসলামি সরকার এই নারীবান্ধব বিষয়টিকে সম্প্রাসারিত করে উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় নারীদের জন্য পৃথক ব্যবস্থাপনা করবে ৷
যেন অসাধু শিক্ষক-সহপাঠী দ্বারা নারী নিগ্রহের অঘটনগুলো না ঘটে ৷ ফলে নারীদের স্বতন্ত্র মেডিকেল, বিশ্ববিদ্যালয়,কলেজ প্রতিষ্ঠা হবে এতে নারী শিক্ষার হার বর্তমানের রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলবে ৷
কর্ম ও চলাচলের স্বাধীনতা
নারীর ব্যয়ভার পিতা, স্বামী ও সন্তানের কাধেই সাধারণভাবে ন্যাস্ত ৷ এতদসত্ত্বেও যদি নারী তার অর্জিত দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রতিফলনে প্রয়োজনে বা শখে কর্মে নিয়োজিত হতে চায়; সেক্ষেত্রে ইসলামি রাষ্ট্র তার কর্ম পরিবেশ নারীবান্ধব করে দিবে ৷ যেন নির্বিঘ্নে নিরাপত্ত্বায় সে কর্মে নিয়োজিত থাকতে পারে৷ এমনকি সামরিক বাহিনীতেও মেডিকেল কোরসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর যোগদানের সুযোগ রয়েছে ৷
ইসলামের জিহাদগুলোতে নারীদের সক্রিয় উপস্থিতির নজির পাওয়া যায়৷ এ ছাড়া তার ফ্রিডম অব মুভমেন্টে হস্তক্ষেপ নয়; বরং শতভাগ সার্বিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিৎ করা হবে ৷ নারীদের জন্য তাদের উপযোগী কর্ম প্রতিষ্ঠান ও সুকুমারবৃত্তিমূলক ট্রেনিং সেন্টার থাকবে৷
নারীরা জাতীয় আয় ও উৎপাদনে ব্যাপক ভূমিকা রাখবেন ৷ এখন অনুকূল কর্ম পরিবেশ না থাকায় সিংহভাগ নারীই ঘরে আবদ্ধ থাকেন ৷ ইচ্ছা, যোগ্যতা ও প্রয়োজন সত্তেও বহু নারী জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে পারছেন না ৷
কিন্তু ইসলামি শাসনব্যবস্থায় নারীর মনোদৈহিক সক্ষমতার বিবেচনায় ও তার সময় সুযোগের কথা মাথায় রেখে পৃথক কর্মালয় ও নারীবান্ধব শিল্প অবকাঠামো ও প্রশাসন তৈরি করা হবে যাতে নারীরা নিশ্চিন্তে আর্থ-সামাজিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হতে পারেন ৷
নানা পেশায় নারী
খিলাফত আমলে জটিল ও অস্পষ্ট শরঈ বিধানের সমাধানে তৎকালীন মুজতাহিদগণের শেষ ভরসা ছিলেন মুমিন জননী জ্ঞানতাপসী আয়েশা রা. ৷ পন্ডিত সাহাবীগণ তাঁর কাছে ছুটে যেতেন বিভিন্ন বিষয়ে সমাধান নিতে ৷
তিনি একজন আইনজ্ঞ, কুরআনের ভাষ্যকার, হাদিস বিশেষজ্ঞ এবং শ্রেষ্ঠ সপ্ত রাবির অন্যতম ছিলেন৷ একাধারে একজন কবি, ধর্মতাত্তিক, বিচক্ষণ, মেধাবী নারী হিসেবে জ্ঞানবিকাশে তাঁর অবদান অবিস্বরণীয়৷
খাদিজা রা আমদানি রপ্তানির ওয়ার্ল্ড ট্রেডার ছিলেন ৷ আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধণাট্য ব্যবসায়ী রমণী ছিলেন তিনি৷ রাসুলের যুদ্ধযাত্রার ঝুঁকিপূর্ণ সময়ের পুরোটা জুড়ে তাঁর স্ত্রীরা সাথেই থাকতেন৷ প্রয়োজনীয় কৌশলগত পরামর্শ দিতেন৷
বিখ্যাত হানাফি ইমাম নুমান বিন সাবিত তদীয় কন্যা হানিফার জ্ঞানগর্ভ ফিকহি সমাধানের স্বীকৃতিস্বরূপ কন্যা হানিফার পিতা পরিচয়ে জনপ্রিয় হন৷
নারীদের শিক্ষিকা, ব্যবসায়ী প্রভৃতি পেশাবৃত্তি গ্রহণে ইসলামের ভেতরেই অসংখ্য নজির রয়েছে৷ সুতরাং ইসলামি মূলনীতিতে দেশ শাষিত হলে নারীরা তাদের কর্মবৃত্তির বিষয়ে সহায়ক পরিবেশ ও নায্য সম্মানী লাভ করবেন ৷
মত প্রকাশের স্বাধীনতা
খলিফা ওমর রা. একদা রাষ্ট্রীয় প্রজ্ঞাপনে নারীদের বিবাহকালীন দেয়া মহরের অনূন্য হার নির্ধারণ করে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন৷ রীতি মোতাবেক জনগণের উদ্দেশ্যে জাতীয় মসজিদের নিয়মিত ভাষণে তিনি বিষয়টি উত্থাপন করলেন৷ তাৎক্ষণিক একজন বিদূষী রমণী তাঁর এই ফরমানের তীব্র বিরোধিতা করলেন৷
তিনি খলিফাকে যুক্তি দিলেন মহর বর-কনে পক্ষের একটা দর কষাকষি ও সমঝোতার ব্যাপার রাষ্ট্র এ বিষয়ে হস্তক্ষেপের এখতেয়ার রাখে না৷ ওমর রা. এর মত প্রতাপশালী রাষ্ট্রপতি একজন নারীর যৌক্তিক বক্তব্য মেনে নিলেন ৷ তিনি এ সিদ্ধান্ত আর নেন নি৷
উধিকন্তু ‘বোনটি সঠিক বলেছে ওমর ভুল করেছিল’ বলে নারীর বাকস্বাধীনতা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার উদারনৈতিক স্বীকৃতি দিয়েছিলেন৷
পর্দা প্রসঙ্গ
পর্দা নারীকে অবরোধবাসিনী নয়; বরং ব্যক্তিত্ববান, অভিজাত ও সম্মানিতা করে৷ পর্দা বিধানে বরং নারীর বহিরাঙ্গনে যাওয়ার একটি সয়ংক্রিয় প্রচ্ছন্ন অনুমোদন পাওয়া যায়৷ তা হল নিজ কক্ষে কোনো নারী হিজাবাবৃতা হয়ে বসে থাকে না৷ বের হওয়ার প্রয়োজনেই মহিলাগণ হিজাব পরেন৷ পশ্চিমা উলঙ্গ সংস্কৃতিতেও অধুনা নারীদের কাছে ফ্যাশন হিসেবে হিজাব এখন সমাদৃত হচ্ছে ৷
কিছু ক্ষেত্রে ইসলাম নারীর জন্য স্বতন্ত্র দায়িত্ব ও পরিসীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে ঠিকই৷ সেগুলো
ন্যাচারাল সায়েন্সের দৃষ্টিকোণে, সমাজবিজ্ঞানের নিরিখে, মনোবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞানসম্মতভাবে যথাযথ ও প্রগতিশীল৷ ইসলাম যেটুকু সীমারেখা প্রদান করেছে তা নারীকে ভোগবাদীদের পাবলিক প্রপার্টি হতে সেফটি দেয়ার লক্ষেই করেছে৷
লিঙ্গ বৈষম্য ও নারীবাদ
লিঙ্গ বৈষম্যের পশ্চিমা ধারণার স্থান ইসলামে নেই৷ নারীবাদ নামে ভিন্ন কোনো টার্মের আলোচনা ইসলামে নিতান্তই নিষ্প্রয়োজন৷ যেহেতু পারিবারিক, সামাজিক মর্যাদায় ইসলাম নারীকে মহিমান্বিত করে রেখেছে রাত্রিদিন৷ অর্থনৈতিক নিরাপত্ত্বাবেষ্টনীতে নারীকে করেছে সম্পদশালী৷
ইসলামি রাষ্ট্রে নারীর দরিদ্র থাকার, অনাহারে ও অভাবে থাকার কোন সিস্টেমই নেই৷ ইসলাম প্রথমত নারীকে মোহরের অধিকারী করেছে৷ দ্বিতীয়ত সংসারিক আর্থিক ব্যয় নির্বাহ থেকে নারীকে নিষ্কৃতি দিয়েছে৷ এমনকি নারীর নিজের দায়িত্বও তার নিজের নয়৷
নানা পর্যায়ে পিতা, ভাই, স্বামী, সন্তানের কাঁধে নারী মৌলিক চাহিদা পূরণের ভার দিয়েছে৷ কাজেই নিঃসন্দেহে ইসলামই প্রকৃতপক্ষে নারী ক্ষমতায়নের প্রায়োগিক ও বৈজ্ঞানিক পন্থা অবলম্বন করেছে৷
ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রে নারী
প্রচলিত সেক্যুলার রাষ্ট্র ব্যবস্থা নারীর হাতে কাবিখার কোদাল, বয়োবৃদ্ধ নারীর মাথায় মাটির টুকরি, হাতে সিটি কর্পোরেশনের ঝাড়ু তুলে দিয়ে চেচিয়ে শোনায়, সে নাকি নারীর ক্ষমতায়ন করেছে! এসব ভাওতাবাজির আড়ালে নারীলোভীরা লিঙ্গ বৈষম্য বিলোপের টাকায় না জানি কত লৈঙ্গিক সুখের অনুষঙ্গ তৈরি করে! আল্লাহ মালুম ৷
নারীবাদ, নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গবৈষম্য নিরোধ, তারকা খ্যাতির আড়ালে কর্পোরেট দুনিয়া মেয়েদের দিয়ে পণ্যের বাজারজাত করতে চায় ৷ আলো আধারীর নৃত্যমঞ্চে নর্তকির পোশাক পরিয়ে ষোড়শীর উতলা যৌবন নিয়ে পৈশাচিক ফূর্তিতে মদমত্ততা তাদের চূড়ান্ত লক্ষ৷
নারীর অন্তর্জাগতিক গুনাবলির মূল্যায়ণ না করে তার শরীর ও দৈহিক সৌন্দর্যকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করতে চায় একশ্রেণির পুজিপতি সিন্ডিকেট৷
কাজেই মুহতারামা নারী মহলের উচিৎ, প্রোপাগান্ডা ও হুজুগে তাল না দিয়ে অন্তর্দৃষ্টির প্রক্ষেপণ৷ প্রয়োজন ইসলাম নিয়ে গভীর অধ্যয়ন৷ আত্মপ্রবঞ্চনা থেকে বাঁচতে হলে এ সময়ের নারীদের আত্মচেতন হওয়ার বিকল্প নেই৷
লেখক: স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
আহবায়ক: সেন্টার ফর স্যোসাল থট
ziauicsm91@gmail.com
-আরআর