আরওয়া শবনম : ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরে বাংলা ভাষা আন্দোলনের অপ্রতিরুদ্ধ সংগঠন ‘তমদ্দুন মজলিস’ একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে যার নাম ছিল ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা না উর্দু?’ এটির লেখক ছিলেন- কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ এবং অধ্যাপক আবুল কাসেম।
তারা এই বইয়ে বাংলা ভাষাকে পূর্ব বাংলায় ভাব বিনিময়, অফিস ও আদালতের একমাত্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পক্ষে জোরালো মতামত তুলে ধরেন। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষেও জোরালো দাবি জানান। পুস্তিকাটিতে অধ্যাপক আবুল কাসেম কিছুসংক্ষিপ্ত প্রস্তাবনা তুলে ধরেন যার মূল কথা ছিল- বাংলা হবে,
১. পূর্ব-পাকিস্তানে তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যম।
২. পূর্ব-পাকিস্তানের আদালতের ভাষা এবং পূর্ব-পাকিস্তানের দাপ্তরিক ভাষা।
৩. উর্দু এবং বাংলা ভাষা হবে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের দাপ্তরিক ভাষা।
৪. পূর্ব-পাকিস্তানে শিক্ষার প্রধান মাধ্যম হবে বাংলা ভাষা। যা সব শ্রেণীর মানুষ শিখবে। উর্দু পূর্ব-পাকিস্তানের দ্বিতীয় ভাষা বা আন্তঃ-প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে গণ্য হতে পারে, যা সেই সমস্ত মানুষকে শেখানো হবে যারা পশ্চিম পাকিস্তানে কাজ করবে। পূর্ব-পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫% থেকে ১০% মানুষ উর্দু শিখলেই যথেষ্ট।মাধ্যমিক পর্যায়ের বিদ্যালয়গুলোতে উপরের দিকের শ্রেণীতে উর্দুশেখানো যেতে পারে এবং ইংরেজি হবে পূর্ব-পাকিস্তানের তৃতীয় অথবা আন্তর্জাতিক ভাষা।
৫. কয়েক বছরের জন্য ইংরেজি ও বাংলা উভয়েই পূর্ব-পাকিস্তানের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার হবে।
এভাবেই শুরু হয় আমাদের প্রাণের ভাষার জন্য লড়াই। এরপর ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ১৪৪ধারা ভঙ্গ করে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই বলে রাজপথ উত্তাল করে তোলে।উত্তাল ওই দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার, বাংলা মাস ফাল্গুনের ০৮ তারিখ।
পুলিশ ছাত্রদের ওপর গুলি চালায়। আর এতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার সহ আরো অনেকে শহীদ হন। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ভাষার জন্য প্রাণ দেয় কোনো জাতি। তার বিনিময়ে বাংলা হয় আমাদের মাতৃভাষা। একুশে ফেব্রুয়ারি স্বীকৃতি পায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে।
কিন্তু বড় দুঃখ আর পরিতাপের বিষয়, অর্ধ্ব শতাব্দী পর এসে আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে বিস্মৃতির অতল গহ্বরে ঠেলে দিচ্ছি। অথচ এখনো ঢাকা মেডিকেলের পাশের সেই রোডে আছে বীর শহিদদের রক্তের দাগ, বারুদের গন্ধ এখনো মানুষের নাকে ভেসে আসে।
আমাদের প্রানের ভাষা বাংলা। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর বছর পাঁচেক রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাংলা ভাষা প্রচলিত হয়েছিল। এ সময় বাংলা ভাষা, প্রশাসন, শিক্ষার মাধ্যম, নিম্ন আদালত প্রভৃতি ক্ষেত্রে দ্রুত চালু হতে থাকে। মোটকথা সত্তর দশকের প্রথমার্ধে বাংলাদেশে সমাজ জীবনের বিভিন্ন স্তরে প্রাপ্য মর্যাদা পেয়েছিল বাংলা ভাষা।
কিন্তু বর্তমানে আমরা বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার করছি না। আমাদের প্রাণের ভাষার সঙ্গে এখন মিশে গেছে অযাচিত কিছু ভাষা ও ভঙ্গী।
বর্তমান বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখা যায় হিন্দি চ্যানেল দেখতে দেখতে কোমলমতি বাচ্চাগুলো হিন্দিতে দেদারসে বকে যাচ্ছে। আর ইংরেজির অপব্যবহারের কথা তো না বলাই ভালো।
আজকাল মায়েরা যেন প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে তাদের চার পাঁচ বয়সের বাচ্চাটিকে নিয়ে। কে আগে বাচ্চাকে সবার থেকে আধুনিক করে গড়ে তুলবে, শিক্ষা দিবে প্রাণের ভাষার বিকৃত রূপ। আধুনিকতার এই মারপ্যাঁচে পড়ে প্রানাধিক শিশুরা মাতৃভাষা বাংলার ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর সারাজীবন ফেরি করে বেড়াচ্ছে বিকৃত বাংলার অযাচিত আকৃতি।
একসময় যেখানে শিশুরা প্রথম শেখা বুলিতে " মা" বলে ডাকতো সেখানে বর্তমানের শিশুরা মাকে ডাকছে ‘মাম্মি’, ‘মম’ বলে। কে জানে হয়তো এমন এক সময় আসবে, যখন মধুর ‘মা’ শব্দটি প্রায় হারিয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে আমাদের বাংলা ভাষার অনুরাঁগ। গুলির আঘাতে সালাম রফিকের গোঙানো শব্দ আমাদের স্মৃতিশক্তি থেকে মুছে যাবে চিরতরে।
কয়েকদিন আগে সরকারিভাবে দোকানের সাইনবোর্ডগুলোতে ইংরেজি শব্দ সরাতে আইন হয়েছে। কিন্তু শতচেষ্টা করেও কোনো ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি অনেক শিক্ষাঙ্গনের নাম পর্যন্ত ইংরেজি শব্দে। বাংলাদেশ বেতার হয়ে যায় "রেডিও বাংলাদেশ "।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মানুষ বাংলা ভাষাকে বিকৃত করে বাংলিশ ভাষায় লেখা দিচ্ছে। আমাদের আবেগ এখন হয়েগেছে ‘ইমোশন’, ভবিষ্যত হয়েগেছে ‘ফিউচার’, ভালবাসা হয়েগেছে ‘লাভ’, বন্ধুরা হয়েগেছে ‘ফ্রেন্ড’, সংসার হয়েগেছে ‘ফ্যামিলি’ আর মতবিনিময় সভা হয়েগেছে ‘টক শো’।
বাংলা ভাষার প্রতি এ অশ্রদ্ধা, অবজ্ঞা আর উপেক্ষা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, বাংলা ভাষার সৌন্দর্য, লালিত্য, মাধুর্য আজ বিলুপ্তের পথে। তাই প্রাণের ভাষার প্রতি যত্নশীলতা সচেতনতার পরিচয় দেওয়া এখন সময়ের দাবি।
আসুন আমরা গেয়ে উঠি-
“প্রাণে নয় শুধু বলা ও চলায় আসুক বাংলা ভাষা,
আধুনিকতায় হারিয়ে না যাক এটাই মনের আশা”