যিয়াদ বিন সাঈদ: সভ্যতার ভাঙা মুখ। ঘুণধরা সমাজের আছে যত অবক্ষয় কিংবা যত পঁচন; সেসব নিয়েই তরুণ লেখক আমিন ইকবালের দক্ষ হাতে নির্মিত একটি বই এটি।
সভ্য অসভ্যের চির প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিনি নির্মাণ করতে চেয়েছেন এক নিরুপম আশ্রয়স্থল। যেখানে নিজেকে আবৃত করলে অসভ্যতার গমনোন্মুখ ঢেউয়ে তলিয়ে যাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারবে মানুষ। আশ্রিত করতে পারবে দেহ-মন।
আমিন ইকবালের এ গ্রন্থের শুরুতেই আমার মনে সৃষ্টি হলো তীব্র বিচূর্ণন। ওই যে আছে এক বৃদ্ধাশ্রম। দীর্ঘকাল শত যাতনা সয়ে সয়ে যে পিতামাতা লালন করলো একেকটি সন্তান। স্বপ্ন দেখলো আকাশসম। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! জীবনের শেষ সময়গুলোতে এসে নিজের পায়ে দাঁড়াবার শক্তিটুকু যখন হারিয়ে ফেললেন পিতামাতা, তাদের আশ্রয় হলো কেবলই বৃদ্ধাশ্রম।
আমিন ইকবাল এমনই এক অসভ্যতার মুখে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করতে করতে কলমের কাছে চাইলেন আশ্রয়। তিনি তীব্র ব্যথার অন্তরালে সোনা ঝরানো হরফে লিখতে লিখতে ফেললেন 'দীর্ঘশ্বাস'।
বুকের ভেতর অগত্যা আক্রান্ত করা ছেদনের যাতনা নিয়ে আমি চলতে লাগলাম 'সভ্যতার ভাঙা মুখ' দিয়ে। নারী তো নিশ্চয় মহান। সর্বকালেই নারীপক্ষের ছিলো এক মহান মর্যাদা। অথচ সর্বনাশা এ সমাজ নারীকে কীভাবে ঠেলে দিচ্ছে ধ্বংসের মুখে এবং নারীকে করছে ক্রমেই পণ্যায়ন। এমনই এক অবক্ষয়ের কথা স্মরণের ভেতর দিয়ে আমিন ইকবাল জাগ্রত করতে চেয়েছেন আমাদের চেতনাকে। ঘুম ভাঙাতে চেয়েছেন দীর্ঘ নিদ্রায় যাপিত মানুষকে।
প্রগতিশীলতার মুখোশ পরিয়ে সুন্দরী প্রতিযোগিতার যে হই হই রব চারিদিকে, সেটা তো নিশ্চয় নারীজাতির জন্যে এক অকল্যাণকর সূচনা। অন্ধকারে নিমজ্জিতপ্রায় এক কালো অধ্যায়ের অঙ্কুরোদয়।
'সভ্যতার ভাঙা মুখ'র লেখক আমিন ইকবাল এ ছাড়াও আমাদের ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে, ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে সন্ধান দিতে চেয়েছেন আলোর। প্রমাণ করতে চেয়েছেন ইসলামই চির শান্তির ধর্ম। এ ছায়ায় আশ্রিত মানুষ সর্বদাই শান্তির পতাকাবাহী। চির শান্তির আহবায়ক।
ওই যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে হিজাব আর বোরকা নিষেধাজ্ঞার হিড়িক পড়ে গেছে চারিদিকে, যেনবা আমরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। মুসলিমতত্ত্বের কোনো ভ্যালু এখানে নেই। সময়ে অসময়ে ইসলামের চিরাচরিত বিধানের ওপর আসছে নির্মম আঘাত। এমনই এক নাজুক আবহ যখন সবদিকে তখনই আমিন ইকবাল লিখতে চাইলেন চিরসত্যের কথা। অমলিন চির সভ্যতার কথা। কখনো প্রতিবাদের স্বরে। আবার কখনো নির্মলতার চমকপ্রদ মিশেলে।
আমাদের এ সমাজ যখন ধর্মীয় সংস্কৃতি কে পোঁটলা বেঁধে তুলে রেখেছে আলমিরায় এরপরও ক্ষান্ত নয় সমাজ। ধর্মের কথা মেনে নিই না হয় তাদের পছন্দ অপছন্দের রেহাই নিয়ে। কিন্তু শত বছর ধরে চিৎকার করে গলা ফাটানো এ দেশীয় সংস্কৃতির ওপর যখন নেমে আসে নির্মমতা তখন প্রগতিবাদীদের নীরবতা প্রচণ্ড আক্রান্ত করে আমাদের। থার্টি ফার্স্ট নাইটের উদযাপন যখন শহরের রন্ধে রন্ধে রব ফেলে দেয়, উন্মাদিত তরুণকে ঠেলে দেয় মদ, জুয়া আর নারীমত্তদার দিকে তখন বাঙালী সংস্কৃতি কে কি অবমাননা করা হয়না?
এমনই এক দুর্লভ চিন্তার জগত কে চমৎকার উপস্থাপনায় হাজির করেছেন লেখক আমিন ইকবাল। আমাদেরকে সমাজের এ পঁচে যাওয়ার সংবাদ তীব্র ব্যথা দিলেও ভেতরে ভেতরে সুখ পেতে সাহায্য করেই বারেবার।
একুশে বইমেলা সংক্রান্ত একটা নিউজ সর্বত্র প্রচার হয়েছে ক'দিন আগে। মেলায় প্রকাশিত সব বই পুলিশ কর্তৃক যাচাইবাছাই করে নেয়া হবে। এমন সংবাদ শোনা মাত্রই পাঠক এবং লেখককে খুব চটে যেতে দেখা গেছে। কিন্তু আমিন ইকবাল এখানেই হয়তো খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছেন সত্য ও সুন্দরের কথা।
২০১৫ সালে রোদেলা প্রকাশনীর ধৃষ্টতা আর এর পরের বছর ব দ্বীপ প্রকাশনীর দুঃসাহসী কর্মকাণ্ডে যখন দেশজুড়ে সৃষ্টি হলো তোলপাড় তখন যদি সঠিক যাচাইয়ের পর এ বইগুলো পাঠকের সামনে নিয়ে আসা হতো, নিশ্চয় এত বিশৃঙখলার সৃষ্টি হতোনা। 'সভ্যতার ভাঙা মুখ'এ আমিন ইকবাল আক্ষেপের সুরে এ আবদারই করতে চেয়েছেন। বোঝাতে চেয়েছেন সত্য সুন্দরের অমিয় বার্তা।
ইফোর্ট: টি শার্টে আধুনিকতা ও শালীনতার সমন্বয়
আলোচনার একদম শেষ পর্যায়ে চলে আসতে হচ্ছে ঠিক যে কারণে, আমিন ইকবালের ঘুণধরা এ সমাজকে নিয়ে রচিত 'সভ্যতার ভাঙা মুখ'র ভেতর নির্মিত সব প্রতিবেদন এবং রচনা- যাই বলা হোক, সবই আমার প্রচণ্ড ভালো লাগার জোগাড় হয়েছে। ফলে এমন এক মুহূর্তের মুখোমুখি হয়ে গেছি, আমার আলোচনায় হয়তো সঠিক এবং সুন্দরতার লেশমাত্রও না থাকার সম্ভাবনা রয়ে যাচ্ছে শুধুই। এ জন্যে থেমে পড়লাম। এবং পাঠকের কাছে নম্রমুখ পারিজাত করে রেখে গেলাম একটি আবদার। আমিন ইকবালের এ বইটি আপনি পড়ুন। সমাজকে চিনতে শিখুন। এবং খুঁজতে থাকুন এর থেকে পরিত্রাণ।
শ্রদ্ধেয় লেখক আমিন ইকবালকে অশেষ কৃতজ্ঞতা। এ কর্মের ফল নিশ্চিত ওপারে আপনি পাবেন।
বই: সভ্যতার ভাঙা মুখ
লেখক: আমিন ইকবাল
প্রকাশক: আশরাফিয়া বুক হাউজ
প্রচ্ছদ: কাজী যুবাইর মাহমুদ