সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদই পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হিসেবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি সংসদ সদস্যদের ভোটেই নির্বাচিত হবেন দেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি। সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের হওয়ায় আবদুল হামিদের রাষ্ট্রপতি হওয়া নিশ্চিত। নির্বাচন শুধুই আনুষ্ঠানিকতা।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদ পূর্ণ করলে আবদুল হামিদই হবেন সবচেয়ে বেশি সময় ধরে থাকা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। এর আগে সর্বোচ্চ আট বছর রাষ্ট্রপতি ছিলেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।
বাংলাদেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ এক সময়ে দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন আবদুল হামিদ। তার রাষ্ট্রপতি থাকাকালেই ২০২০ সালে পালিত হবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। আবার ২০২১ সালে পালিত হবে স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী। দুটি বিষয়েই তাকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।
গত পাঁচ বছর রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবদুল হামিদ নিরপেক্ষ ভূমিকা রেখেছেন, অনেক সমস্যার দক্ষতার সঙ্গে সমাধান করেছেন। আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার তার হাত ধরেই হয়েছে। এ কারণেই তিনি দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন।
২১তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবদুল হামিদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সংবিধান সমুন্নত রাখা, অংশগ্রহণমূলক একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ সৃষ্টি, ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা। কেননা, চলতি বছরেই একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এই নির্বাচনকে ঘিরে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছে।
আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই আগামী নির্বাচন হবে। অন্যদিকে বিএনপির দাবি, শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। ফলে তার অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে চায় না দলটি। এই পরস্পরবিরোধী অবস্থান দেশে চরম অস্থিরতা তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। ইস্যুটিকে ঘিরে রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে বলে ধরে নেওয়া যায়।
এ অবস্থায় রাষ্ট্রপতিকে অভিভাবকের দায়িত্ব নিতে হতে পারে। যদিও আমাদের দেশে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমিত। তবুও নতুন রাষ্ট্রপতি এমন পরিস্থিতিতে কী পদক্ষেপ নেবেন তা দেখার অপেক্ষায় অনেকেই।
তবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব উল আলম হানিফ মনে করেন-নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের (ইসি)। তার ভাষ্য, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে রাষ্ট্রপতির কোনো চ্যালেঞ্জ দেখছি না। তবে তার দায়িত্ব রয়েছে, তা হলো সংবিধান সমুন্নত রাখা।’
প্রসঙ্গত, ২০১৮ ভোটের বছর। চলতি মাসে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর জাতীয় সংসদ থেকে ইউনিয়ন পরিষদ সব পর্যায়ের নির্বাচন থাকছে এ বছর। ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র পদে উপনির্বাচন দিয়ে শুরু হবে ভোটযুদ্ধ। এরপর ধারাবাহিকভাবে পাঁচ সিটিতে ভোটের আয়োজন। গাজীপুর সিটিতে ভোট মার্চ-এপ্রিলে। জুনের মধ্যে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশনে ভোট করতে পারে ইসি। আর সিটির ভোট শেষে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
আগামী ডিসেম্বরের শেষ দিকে সংসদ নির্বাচন করার জন্য অক্টোবরে চূড়ান্ত করা হতে পারে ভোটের দিনক্ষণ। নভেম্বরের মাঝামাঝি ঘোষণা হতে পারে তফসিল। এ ছাড়া বছরের বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় সরকারের ইউপি, পৌরসভা ও উপজেলাসহ অন্যান্য ছোট ছোট নির্বাচনও থাকছে। সব মিলিয়ে বছরজুড়েই ভোট উৎসবে থাকবে দেশ।
তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে আগামী সংসদ নির্বাচন হবে দেশের ভোটের ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন ভোটের একটি।
আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলে তারা একজন নির্দলীয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে আমাদের দ্বন্দ্বমুখর রাজনীতিতে এক অভাবনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর বিএনপি-আওয়ামী লীগনির্বিশেষে সব দলের সম্মতিতে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত করে। তিনি কোনো দল করতেন না। তার পরও আওয়ামী লীগ তাকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে।
বাংলাদেশে দলীয় সরকারের আমলে নির্দলীয় রাষ্ট্রপতির আর কোনো দৃষ্টান্ত নেই এবং সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল আওয়ামী লীগ, ১৯৯৬ সালে।
এ জন্য অবশ্য আওয়ামী লীগকে কম ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়নি। কারণ, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ নিজেকে দল-মতের ঊর্ধ্বে রাখার প্রতি বিশেষ যত্নবান ছিলেন। আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মেনে চলতে বাধ্য, কিন্তু প্রয়োজনে একবার ফাইল পুনর্বিবেচনার জন্য পাঠাতে পারেন। দ্বিতীয়বার সেই ফাইল এলে তিনি তা অনুমোদন করতে বাধ্য।
এসব কারণে তিনি আবার আওয়ামী লীগের বিরাগভাজনও হন। এর দায়দায়িত্ব আওয়ামী লীগের ওপরই বর্তায়। কিন্তু এত উল্টাপাল্টার মধ্যেও রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ একটি ঐতিহ্য স্থাপন করে গেছেন যে, বিদ্যমান ব্যবস্থায়ও রাষ্ট্রপতি নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারেন।
বাস্তবতা পর্যালোচনায় বলা যায়, ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার মামলার রায় ও আগামী নির্বাচন নিয়ে দেশে এক ধরনের জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে হতেও পারে। কেননা, খালেদা জিয়ার সাজা হলে বিএনপি নির্বাচন বয়কট করতে পারে। আর বিরোধী দল ছাড়া নির্বাচন করলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি চলতেই থাকবে। যা শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের কাম্য নয়।
অবশ্য এক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে নতুন রাষ্ট্রপতির ভাবমূর্তি কাজে লাগলেও লাগতে পারে। যদিও কাগজে-কলমে এ রকম কোনো বিধান নেই। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ প্রয়োজনে অন্তত কারও কারও কাছে সবার একটা প্রত্যাশা থাকে।
নতুন রাষ্ট্রপতির কাছে দেশবাসীর সে রকম আকাঙ্ক্ষা থাকতেই পারে। ঐতিহাসিক প্রয়োজনে সেই প্রত্যাশা পূরণ করা যে অনেক সময় অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়।
লেখক : কবি, কলামিস্ট ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম