এ এস এম মাহমুদ হাসান
বিশেষ প্রতিবেদক
দেশের খ্যাতনামা একটি ব্যাংকের মিরপুর শাখার ম্যানেজার তার বড় মেয়েকে ভর্তি করেছেন মহিলা মাদরাসায়। অপর দুই ছোট ছেলেদেরও হাফেজ বানাবেন বলে মনস্থির করেছেন। ফলে বাসার পাশে একটি কিন্ডারগার্টেন প্রাইভেট মাদরাসায় দুই ছেলেকে যথাক্রমে প্লে ও নার্সারীতে ভর্তি করেছেন।
ঢাকার একটি থানার ভারপ্রাপ্ত ওসির একমাত্র ছেলেকে ভর্তি করেছেন মাদরাসায়। বাবার অতি আদূরে স্নেহের সন্তানকে ইহলৌকিক সমৃদ্ধি ও পরলৌকিক নাজাতের আশায় ওসি তার নাড়িছেড়া ধনকে মাদরাসার হিফজ বিভাগে ভর্তি করেছেন।
এমন অসংখ্য জেনারেল পড়ুয়া ধনাঢ্য এলিট শ্রেণির পরিবারের সন্তানদের বর্তমানে মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত করার হিড়িক পড়েছে। ঢাকার একাধিক কওমি ও প্রাইভেট মাদরাসার পরিচালক ও অভিভাকদের সাথে কথা বলে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে।
জেনারেল শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত ব্যাংকারের কাছে তার সন্তানদের মাদরাসায় পড়ানোর কারণ জানতে চাইলে তিনি আওয়ার ইসলামকে বলেন, ‘শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সামাজিক মূল্যবোধ তৈরি করে আদর্শ ও নৈতিক শিক্ষার নাগরিক তৈরি করা ।
কিন্তু বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা বলছে, শিক্ষা হলো দারিদ্রতা দূরিকরণের হাতিয়ার।ফলে জেনারেল পড়ুয়া একজন চাকরিজীবি কিংবা ব্যবসায়ী অর্থ উপার্জনকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।’
‘তাই সন্তানদের চারিত্রিক উন্নতি, সামাজিক মূল্যবোধ, নিষ্ঠা, শিষ্টাচার, পরোপকার ও পরকালীন মুক্তির মনোভাব জাগাতে আমার সন্তানদের মাদরাসায় ভর্তি করেছি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাদরাসার অনেক অভিভাবক আওয়ার ইসলামকে তাদের ওপেন মতামত জানিয়েছেন। তাদের মতে, নীতি নৈতিকতার শিক্ষা এখন কলেজ-ভার্সিটি খুব কমই লক্ষ্য করা যায়।
ধর্মীয় শিক্ষা ও সু-দীক্ষার অভাবে বাসার পাশেই অভিভাবকদের সামনে অনায়াসে মেয়ে সঙ্গী নিয়ে ঘুরছে। যে অনৈতিক কাজগুলো মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না।
তাছাড়া ধর্মীয় ও আদর্শিক শিক্ষার অভাবে অধিকাংশ সাধারণ পরিবারেই বিরাজ করছে অস্থিরতা। পরিবারের সদস্যদের মাঝে বোঝাপড়ার অভাব, বিশ্বাসের ঘাটতি, সন্তানদের আনুগত্যহীনতা, পরকিয়াসহ অসংখ্য অনৈতিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে অনেক আধুনিক শিক্ষিত পরিবার।
যা একটি প্রতিষ্ঠিত পরিবারকে উভয় জগতে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। এমন পরিবারের তথ্য প্রতিদিন সংবাদ পত্রে আসছে। অথচ মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিতদের থেকে পারিবারিক এমন বিচ্যুতি নেই বললেই চলে।
মাদরাসা শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার (বেফাক) পরিসংখ্যান মতে, যে সব পরিবারের দ্বীন-ধর্ম, সম্পর্কে তেমন ধারনাই ছিল না, প্রতি বছর এমন নিরেট জেনারেল পড়ুয়া এলিট শ্রেনীর ১০-১৫ হাজার শিক্ষার্থী মাদরাসায় ভর্তি হচ্ছে।
বেফাকের গত ৪০তম কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ২৫ হাজার। কিন্তু এই প্রতিবেদন তৈরী পর্যন্ত এ বছর বেফাকের কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লক্ষ ৫১ হাজার। গতবারের তুলনায় এবার ২৫ হাজারেরও বেশী পরীক্ষার্থী বেফাকের পরীক্ষায় অংশ নিবে বলে জানিয়েছেন বেফাকের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাওলানা আবু ইউসুফ।
তিনি বলেন, এবারের কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় অংশগ্রহনকারীর সংখ্যা আরো বাড়বে। বিগত ২০১৩ সালে ৩৯ হাজার, ২০১৪ সালে ৭৩ হাজার, ২০১৫ সালে ৯৫ হাজার পরীক্ষার্থী কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে।
বেফাক ছাড়াও আঞ্চলিক বোর্ডগুলোতে প্রতি বছর পরীক্ষার্থী বৃদ্ধি পাওয়ার পরিসংখ্যান প্রায় একই ধরনের।
মাদরাসা শিক্ষায় প্রতি বছর এত বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ জানতে চাইলে বেফাকের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাওলানা আবু ইউসুফ বলেন, স্কুল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের তুলনায় মাদরাসা পড়ুয়ারা মা বাবার দেখভাল ও আনুগত্য বেশি করে থাকে।
আদর্শ ও নৈতিক শিক্ষার বীজ অঙ্কুরেই বপিত হওয়ায় ধর্মীয় নিরিখে পরিবার ও সামাজিকতা রক্ষা করে চলে তারা।
পাশিাপাশি কলেজ ভার্সিটি পড়ুয়া অধিকাংশরা ওই ভাবে নৈতিক শিক্ষাটা পান না। ফলে কারণে-অকারণে মারামারি, খুনোখুনি, সন্ত্রাসী ও নারী ঘটিত কর্মকান্ডের সাথে তারা সহজেই জড়িয়ে পড়ছে। পক্ষান্তরে মাদরাসা শিক্ষায় এ সবের নজির নাই। ফলে সভ্য সমাজের ধনী ও শিক্ষিত পরিবারে মাদরাসা শিক্ষার ব্যাপক চাহিদা বাড়ছে।
তাছাড়া জেনারেল শিক্ষিত অসংখ্য বেকার রয়েছে। যারা কর্মসংস্থানের অভাবে দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ছে। কিন্তু মাদরাসা পড়ুয়ারা তাদের শিক্ষা দ্বারা ইলমী ও আমলী লাইনে যেমন বিচরণ করে পরলৌকিক মুক্তির ঠিকানা পাচ্ছে, ঠিক তেমনি পার্থিব উপার্জনে কোনো মাদরাসার ছাত্রই বেকার পাওয়া যাবে না।
মাদরাসা শিক্ষার ব্যাপরে অসচেতন মহলে ষড়যন্ত্রকারীরা মিথ্যা অপবাদ রটিয়েছিল। কিন্তু জ্ঞান, বিজ্ঞান ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নত এ যুগে মাদরাসার বিরুদ্ধে সেই অপবাদ আর ধোপে টেকেনি। ফলে অভিভাকরা সচেতন হয়ে তাদের সন্তানদের এখন মাদরাসামুখী করছেন। যেখানে জাগতিক শিক্ষার পাশাপাশি পরকালীন মুক্তির শিক্ষাও পাচ্ছে সন্তানরা। এ কারণেও ব্যাপকহারে মাদরাসামুখী হচ্ছেন অভিভাকরা।
বাংলাদেশ প্রাইভেট মাদরাসা এসোসিয়েশনের সহসভাপতি ও ঢাকা আইডিয়াল ক্যাডেট মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল মুফতি মামুনুর রশিদের কাছে প্রাইভেট মাদরাসায় প্রতি বছর ছাত্র/ছাত্রী বৃদ্ধি পাওয়ার পরিসংখ্যান জানতে চাইলে তিনি বলেন, সঠিক পরিসংখ্যান এ মুহুর্তে দেওয়া সম্ভব না হলেও আমাদের এসোসিয়েশনের অন্তর্ভূক্ত মাদরাসা গুলোতে প্রতি বছর প্রায় ৭-৮ হাজার উচ্চবিত্ত ও উচ্চ শিক্ষিত পরিবারের সন্তান ভর্তি হচ্ছে।
তিনি আওয়ার ইসলামকে তার অনেক অভিভাকদের তথ্য জানিয়ে বলেন, সামাজিক অবক্ষয়ে সন্তানরা জড়িয়ে পড়ায় অনেক বিত্তশালী পরিবারে দেখা দিয়েছে হতাশা। অনেক উচ্চ শিক্ষিত ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তানদের অভিভাকরা মাদরাসায় ভর্তি করাচ্ছেন, যেন অন্য দশ জনের মতো তার সন্তান ভুল পথে না যায়। বরং একজন আদর্শবান, মানবিক নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
সন্তান যেন শিশুকাল থেকেই মানবিক গুনাবলী নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে সেই মহৎ আশা রেখেই সন্তানদের মাদরাসাগুলোতে ভর্তি করছেন।
এইচজে