জহির উদ্দিন বাবর
আলেম ও সাংবাদিক
প্রায় দেড় হাজার বছর আগের কথা। আরবের ধূসর মরুর বুকে রবিউল আউয়ালের এক প্রভাতে উদয় হলো আলোকদীপ্ত এক সূর্যের। যার আলোকরশ্মি বিদীর্ণ করে দিলো ভ্রষ্টতা ও মূর্খতার সব পর্দা। বছরের পর বছর ধরে যে আরবভূমি তথা বিশ্বমানবতা পিপাসায় হাহাকার করছিল, এর ওপর বয়ে গেল রহমতের বারি বর্ষণ।
সততা, নিষ্ঠা, ভ্রাতৃত্ব, হৃদ্যতা, ন্যায় ও সাম্য থেকে বঞ্চিত মানবতার রুক্ষ-ভূমি পূর্ণ হয়ে উঠলো শ্যামল শোভায়। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির জন্মের সেই শুভমুহূর্তে আনন্দের বন্যা বয়ে যায় সবখানে। সে খুশির বারতা মুহূর্তের মধ্যে পৌঁছে যায় দিক-দিগন্তে।
ত্রিভুবনের প্রিয় হজরত মোহাম্মদ সা.-এর জন্মের শুভ মুহূর্তের আলোড়িত সব ঘটনাই বিশ্বমানবতার গগনে প্রদীপ্ত সূর্য উদয়ের পূর্বাভাস ছিল। তাঁর জন্মের কারণে অন্ধকারের কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যাওয়া বসুন্ধরা ফিরে পেয়েছিল নতুন প্রাণের স্পন্দন। মানবতা পেয়েছিল জন্মের সার্থকতা।
তিনি ছিলেন রহমাতুলিল আলামীন তথা সারাবিশ্বের জন্য রহমতস্বরূপ। রাব্বুল আলামীনের ঘোষণা, ‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত হিসেবে পাঠিয়েছি।’ [সুরা আম্বিয়া: ১০৭]
প্রিয়নবী হজরত মোহাম্মদের সা. করুণার কারণেই প্রাণীকুল তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রতি দুর্বল। তাঁর নাম শুনলে ভক্তিতে গদগদ করে। কালের বিরামহীন চক্রে দেড় হাজার বছর লীন হয়ে গেলেও আজও তাঁর অবদানের কথা জগদ্বাসীর কাছে ভাস্বর হয়ে আছে।
এখনও দুনিয়ার প্রতিটি স্থানে প্রতি মুহূর্তে শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত হচ্ছে তাঁর বরকতময় নাম। নাতিদীর্ঘ কর্মময় জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ইতিহাসের পাতায় রক্ষিত আছে সযতনে। তাঁর সর্বপ্লাবী ব্যক্তিত্বের কাছে দুনিয়ার তাবৎ কৃতিত্ব ও যোগ্যতা ধূসরিত। ঘোর শত্রুর কাছেও তিনি কীর্তিমান, অদ্বিতীয় এক মহাপুরুষ। চরিত্রে তাঁর নেই বিন্দু পরিমাণ কালিমার আঁচড়। চারিত্রিক সার্টিফিকেটে স্বয়ং রাব্বুল আলামীন তাঁকে সর্বযুগের রেকর্ডসংখ্যক মার্ক দিয়েছেন।
কৃতিত্ব, অবদান ও মানবিক যোগ্যতার আকর্ষণীয় দিকগুলোর সম্মিলনের কারণে প্রতিটি মুসলমানের হৃদয়ে প্রিয়নবীর সা. প্রতি সহজাত টান রয়েছে। সর্বোপরি মহব্বতে রাসুল তথা নবীজীকে ভালোবাসার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন ঈমানের অনিবার্য দাবি। সে দাবি পূরণ করতে মুসলমান হিসেবে রবিউল আউয়াল এলে আমরা সবাই কমবেশি আন্দোলিত হই।
প্রিয়নবীর সা. প্রতি আমাদের ব্যাকুল অন্তরের আকুল অনুভূতির প্রকাশ ঘটে। মহব্বতে রাসুলের সা. নতুন হাওয়া বইতে থাকে চারদিকে। তবে আমাদের মহব্বতের প্রকাশ ভঙ্গিটা যথার্থ কিনা তা বিবেচনার দাবি রাখে। অনুষ্ঠানের হিড়িক, চোখ ধাঁধানো চাকচিক্য এবং মহব্বতে রাসুলের সস্তা স্লোগানের কারণে রবিউল আউয়াল আমাদের জীবনধারায় কোনওই পরিবর্তন আনতে পারে না। গতানুগতিক বহমান স্রোতে পণ্ড হয়ে যায় রবিউল আউয়ালের প্রকৃত চেতনা ও দাবি।
রবিউল আউয়ালের পয়গাম ও দাবি কী-সেগুলোও আমাদের কাছে ততটা স্পষ্ট নয়। আনুষ্ঠানিকতার সব আয়োজনই আমরা সম্পন্ন করি, কিন্তু এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও শিক্ষা, বাস্তবজীবনে নবীর আদর্শের কোনও ছাপ রাখতে পারি না।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন, ‘রবিউল আউয়াল এলে তোমারই গান গাই, রবিউল আউয়াল গেলে তোমায় ভুলে যাই।’ মিলাদ, কিয়াম, জশনে-জুলুশ আর অনুষ্ঠানসর্বস্ব রবিউল আউয়াল আমরা যতই উদযাপন করি, প্রাপ্তির খাতায় শূন্যতা থেকেই যাবে। এজন্য নবীর জন্ম-মৃত্যু উভয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রবিউল আউয়ালের যথার্থ দাবি আদায়ের প্রতি মনোযোগী হওয়া আমাদের সবার দায়িত্ব।
দুই.
মানুষ স্বভাবতই অনুসরণ ও অনুকরণপ্রিয়। যেকোনও কাজে আদর্শ বা মডেল খোঁজা আমাদের স্বভাব। পারিবারিক পরিমণ্ডল থেকে রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই আমরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কারও দেখানো পথ অনুসরণ করি। জীবন চলায় এটা মানুষের জন্য নিরাপদ।
যেকোনও অজানা গন্তব্যে যেতে হলে চেনা-জানা কারও নির্দেশনা অনুযায়ী চলাই সমীচীন। নিজে নিজে অজানা পথ মাড়াতে গেলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। মানুষের জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে অনুসরণযোগ্য ব্যক্তিত্ব পাওয়া অসম্ভব। আপনি দুনিয়ার যে কাউকে অনুসরণ করুন, তার প্রতিটি কর্মকাণ্ড আপনার আস্থায় আসবে না। কোনও না কোনও ত্রুটি-বিচ্যুতি এর মধ্যে পাওয়া যাবে।
এতে তার প্রতি আপনার আস্থা ও বিশ্বাসে চিড় ধরা স্বাভাবিক। মানবেতিহাসে একমাত্র মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সা. ছাড়া পূর্ণাঙ্গ আদর্শ বা মডেল কোনও ব্যক্তিত্ব নেই। তাঁর পূর্ণতার সার্টিফিকেট খোদ শ্রষ্টা দিয়ে দিয়েছেন। শুধু তাঁর জীবন ও আদর্শের মধ্যেই আপনি খুঁজে পাবেন জীবন চলার পাথেয়।
মানবজীবনের ঐকান্তিক সফলতা নিহিত আছে তাঁর আদর্শে। মুসলমান হিসেবে তাঁকে অনুসরণ করা, তাঁর দেখানো পথে চলা, তাঁর আদর্শের বাস্তবায়ন ঈমানের অনিবার্য দাবি। রাসুলকে সা. ভালোবাসা ও তাঁর আনুগত্য করাই হচ্ছে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি।
আল্লাহ বলেন, ‘(হে নবী) বলুন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমাকে অনুসরণ কর। আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ [সুরা আলে ইমরান-৩১]
একজন মুমিনের ঈমানের অনিবার্য দাবি হচ্ছে, তার স্ত্রী-পরিজন, পিতামাতা, সন্তান-সন্তুতির চেয়ে রাসুলকে বেশি ভালোবাসবে। হাদিসে আছে, ‘তোমরা তোমাদের সন্তান পিতা-মাতা ও সবার চেয়ে আমাকে যতক্ষণ না বেশি ভালোবাসবে ততক্ষণ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না।’ [বুখারি]
মুসলমান বলে দাবি করলে তাঁকেই মানতে হবে, তাঁর আদর্শের কাছেই বারবার ফিরে যেতে হবে। তাঁর আদর্শ ও নির্দেশিত পথ মানবজাতির এমন এক ঠিকানা যা ভুল করলে কখনও কেউ সাফল্যের মুখ দেখতে পারবে না। জীবনের বাঁকে বাঁকে প্রিয়নবীই (সা.) হলেন আমাদের প্রকৃত সহায়ক, কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছার একমাত্র রাহবর। তিনি শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সবার পথের দিশা।
রাসুল সা. ছিলেন সৃষ্টির সেরা মানুষ। নিরপেক্ষ প্রাচ্যবিদরাও অকপটে স্বীকার করেছেন, তিনি সব যুগের সেরা মানুষ। আপনি যে কেউই হোন না কেন তাঁর জীবনাদর্শে খুঁজে পাবেন মূল্যবান পাথেয়।
আপনি ব্যবসায়ী হলে মক্কা-মদিনা ও সিরিয়ার ব্যবসায়ী কাফেলায় নেতৃত্বদানকারীকে দেখুন। আপনি রাষ্ট্রপ্রধান হলে মদিনার খেজুর পাতার ছাউনিতে বসে বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনাকারী শাসককে দেখুন। আপনি প্রজা হলে কুরাইশদের শাসিতের দিকে একটু তাকান।
আপনি বিজয়ী হলে বদর-হুনাইন ও মক্কা বিজয়ীর আচরণ লক্ষ্য করুন। আপনি পরাজিত হলে উহুদের বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিন। শিক্ষক হলে সুফফার সেই মহান শিক্ষকের পাঠদান অনুসরণ করুন। শিক্ষার্থী হলে জিবরাইলের সামনে বসা শান্তশিষ্ট ও অতিশয় ভদ্র সেই ছাত্রের কথা স্মরণ করুন।
বক্তা হলে মসজিদে নববিতে দাঁড়ানো মিষ্টভাষী সেই খতিবকে দেখুন। সত্য প্রচার করতে গিয়ে প্রতিকূলতায় পড়লে একটু তাকিয়ে দেখুন মক্কার সেই অনাথ শিশুটির দিকে, যার আশ্রয়-প্রশ্রয়ের কোনও জায়গা ছিল না। দীর্ঘ সংগ্রামে শত্রুদের পরাজিত করলে আপনি অনুসরণ করুন মক্কাবিজয়ী উদার সেই বীর সেনানীকে। আশ্রয়হীন-এতিম হলে দেখুন আব্দুল্লাহ ও আমেনার সেই আদরের দুলালকে।
একজন শিশুর জন্যও হালিমা সাদিয়ার রা. কোলের সেই শিশুটি আদর্শ। আপনি যুবক হলে মক্কার হিলফুল ফুজুলের সেই যুবককে দেখুন, যিনি আল আমিন বা সত্যবাদী হিসেবে বিশ্বখ্যাত। মুসাফির হলে বাণিজ্যিক কাফেলায় সিরিয়া-বসরা সফরকারী সেই বণিককে দেখুন।
আপনি বিচারক হলে দেখুন ওই শালিসকারী ও বিচারককে যিনি হাজরে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে দ্বন্দ্বের সুরাহা করে দিয়েছেন অসাধারণ দক্ষতা ও কৌশলে। মদিনার খেজুর পাতা বেষ্টিত কাঁচা ঘরে বসা সেই বিচারকের ঐতিহাসিক রায় আজও মানবতাকে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের পথ দেখায়।
আপনি স্বামী হলে খাদিজা রা ও আয়েশার রা. আদর্শ স্বামীকে অনুসরণ করুন। পিতা হলে দেখুন ফাতেমার রা. আদর্শ বাবাকে। এককথায়, আপনি যে কেউই হোন না কেন, আপনার অবস্থান যাই হোক তাঁর জীবনে আপনি খুঁজে পাবেন সঠিক দিশা। কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছতে তিনিই মানবজাতির একমাত্র আদর্শের ঠিকানা।
একবিংশ শতাব্দীর সমস্যাসংকুল এই বিশ্বে বছর ঘুরে রবিউল আউয়াল আমাদের দুয়ারে হাজির। প্রিয় নবীর জন্ম-মৃত্যুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মাস হিসেবে এ মাসে নতুন প্রাণে উজ্জীবিত হওয়া সবার কর্তব্য। মুমিনের সামনে স্বচ্ছ আয়নার মতো নববি আদর্শের বাস্তব চিত্র স্থির হয়ে আছে।
সে চিত্রের সঙ্গে নিজেদের জীবনের রূপটা পরখ করে দেখলেই প্রত্যেকের স্ব-স্ব পরিচয় উদ্ভাসিত হয়ে যাবে। অনুমান করতে কষ্ট হবে না, আমাদের জীবনচিত্র সে ছাঁচের কাছে কতটা বেমানান। আদর্শিক বিচারে নবী মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহর সা. পথ ও পদ্ধতি অনুসরণের কোনও বিকল্প নেই।
আমরা যে কেউই হই না কেন, আমাদের জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে রাসুলের জীবনের মধ্যে রয়েছে অনন্ত পাথেয়। অন্ধকারে আলোকদিশা পাওয়ার প্রোজ্জ্বল জ্যোতি একমাত্র তাঁর আদর্শেই বিরাজমান। জীবনের সব ঝঞ্জাট, সংকট ও সমস্যাকে জয় করতে হলে রাসুলের সা. জীবনাদর্শে ডাকে সাড়া দিতে হবে। কারণ অনির্বাণ এ আদর্শই হলো কিয়ামত পর্যন্ত আগত-অনাগত সব মানুষের মুক্তি ও সফলতার চিরন্তন অঙ্গীকার।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম