শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ছাড়া ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না: সৌদি যুবরাজ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হারলে দায় বর্তাবে ইহুদিদের ওপর: ট্রাম্প পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সরকার, সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার আ.লীগ নেতাকর্মীর প্রভাবে নিউ ইয়র্কে ড. ইউনূসের সংবর্ধনা বাতিল আইন নিজের হাতে তুলে নিলে কঠোর ব্যবস্থা ইসলামি লেখক ফোরামের বৈঠক অনুষ্ঠিত, আসছে নতুন কর্মসূচি সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান কারাগারে উত্তপ্ত খাগড়াছড়িতে ১৪৪ ধারা জারি খুলনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা নেতানিয়াহুকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে ইসরায়েলি নাগরিক গ্রেপ্তার

‘ইহুদিরা আমাদের শেখাচ্ছে এক মুঠো মানুষ দিয়ে কিভাবে পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করতে হয়’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বৃটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোর কর্তৃক ইহুদি নেতাদের কাছে লেখা চিঠিই বেলফোর ঘোষণা হিসেবে পরিচিত। ফিলিস্তিন ভূমিতে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ ছিলো এ ঘোষণা।

২ নভেম্বর ১৯১৭ সালে লেখা চিঠিতে বেলফোর বলেন, ‘আমি অত্যন্ত আনন্দের সাথে ঘোষণা করছি, মহামান্য ব্রিটিশ রাজার সরকার ইহুদি আন্দোলনের প্রতি আন্তরিক সহানুভূতি পোষণ করে এবং ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জাতীয় আবাসভূমি স্থাপনের দাবি সমর্থন করে। আমি আরো ঘোষণা করছি, ব্রিটিশ সরকার ইহুদিদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য সব ধরনের সহযোগিতা দেবে।’

গতকাল বেলফোর ঘোষণার একশো বছর পূর্ণ হয়। বেলফোর ঘোষণা, তার প্রেক্ষাপট ও প্রভাব নিয়ে কথা হয় বিশিষ্ট আলেম, আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক মাওলানা লিয়াকত আলীর সঙ্গে। আলাপচারিতায় তার সঙ্গে ছিলেন আতাউর রহমান খসরু

আওয়ার ইসলাম : বেলফোর ঘোষণার একশো বছর পূর্ণ হলো। সে ঘোষণার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট কী ছিলো?

মাওলানা লিয়াকত আলী : ইহুদি জাতি মনে করে, তারা পবিত্র সত্ত্বার অধিকারী এবং জেরুজালেমের পবিত্র ভূমিতে তাদের ঐশ্বরিক অধিকার আছে। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে এ দাবি মিথ্যে। কারণ, তারা মিসর থেকে বিতাড়িত হয়ে জেরুজালেমে এসেছিলো।

বার বার আল্লাহর অবাধ্য হওয়ায় আল্লাহ তাদের রাষ্ট্র ও পবিত্র ভূমি থেকে বঞ্চিত করেছেন। এজন্য ইহুদি ধর্ম রাষ্ট্রকে সমর্থন করে না।

ইহুদিদের ভুল বিশ্বাসের কারণে, তারা জেরুজালেমে ফিরে আসার চেষ্টা করেছে বিভিন্ন সময়। তুর্কি খলিফা সুলতান ২য় আবদুল হামিদের কাছে ইহুদিরা ফিলিস্তিন ভূ-খণ্ড কেনার প্রস্তাব করেছিলো। কিন্তু তিনি তা নাকচ করে দেন। তুর্কি খেলাফত দুর্বল হয়ে গেলে ইউরোপীয় সম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ফিলিস্তিন দখলের ষড়যন্ত্র শুরু করে।

১৮৪০ সালে জেরুজালেমে মিশনারি কার্যক্রমের মাধ্যমে ষড়যন্ত্রের বীজ বপন করা হয়। ১৮৫০ সালের মধ্যে ফ্রান্স, রাশিয়া ও ব্রিটেন সেখানে মিশনারি তৎপরতা শুরু করে। ১৮৫৫ সালে ইহুদি ধনকুবের ও বৃটিশ ব্যাংকার স্যার মুসা মনেটকিওর ফিলিস্তিনের জাফায় একটি বাগান কেনেন। এভাবে ষড়যন্ত্র এগুতে থাকে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক-জার্মান পরাজিত হলে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের সুযোগ সামনে চলে আসে। ব্রিটিশ সরকার প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সমুদয় ব্যয় বহনের শর্তে ফিলিস্তিন ভূমি ইহুদির কাছে বিক্রি করে দেয়। সে প্রেক্ষাপটেই ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণা।

আওয়ার ইসলাম : এখানে ইউরোপীয় সম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর কী স্বার্থ ছিলো?

মাওলানা লিয়াকত আলী : প্রথম কথা হলো, ইউরোপীয় সম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ায় তারা মনে করে জেরুজালেম তাদের পবিত্র ভূমি। সুতরাং সেখানে তাদের প্রবেশাধিকার থাকা প্রয়োজন।

দ্বিতীয়ত যুদ্ধবিধ্বস্ত ব্রিটিশ সম্রাজ্য রক্ষায় সম্পদশালী ইহুদিদের আনুকূল্য লাভ। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে ইউরোপের স্বার্থের স্থায়ী সংরক্ষক প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি অনেক বিষয় রয়েছে।

আওয়ার ইসলাম : সমকালীন রাজনীতিতে বেলফোর ঘোষণার কেমন প্রভাব পড়েছিলো?

মাওলানা লিয়াকত আলী : সমকালীন রাজনীতিতে বেলফোর ঘোষণার প্রভাব ছিলো গুরুতর। কারণ, এটাই ছিলো ইহুদিবাদের প্রতি প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়ী ব্রিটিশরাই আন্তর্জাতিক রাজনীতির নিয়ন্ত্রা হয়ে উঠেছিলো। তাই তাদের এ ঘোষণাই ইহুদি রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেছিলো বলা যায়।

প্রকৃতপক্ষে অনেক শক্তির বিরুদ্ধে ইহুদিদের সমর্থন লাভ ও মুসলিম ফিলিস্তিন মুছে ফেলার সুযোগ তৈরি করে বেলফোর ঘোষণা। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ এ ঘোষণাকে ইহুদিদের জন্য বৃটেনের পুরস্কার বলে অভিহিত করেন।

আওয়ার ইসলাম : এরপর এ চুক্তি কিভাবে বাস্তবায়ন করা হয়?

মাওলানা লিয়াকত আলী : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফিলিস্তিন অঞ্চল ব্রিটিশদের দখলে চলে যায়। চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকার সেখানে ইহুদিদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে। সারা পৃথিবী থেকে ইহুদিরা সেখানে জড়ো হতে থাকে। উচ্চ মূল্যে ভূমি কিনে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।

১৯২৩ সালে ফিলিস্তিন ব্রিটেনের অছিভূক্ত হয়। এতে ইহুদি বসতি স্থাপন আরও সহজ। ব্রিটিশ সরকার ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সব আয়োজনই করে সেখানে। বিনিময়ে ইহুদিরা ইসরাইল রাষ্ট্রে ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।

আওয়ার ইসলাম : ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে ইউরোপে ইহুদি গণহত্যা ও তাদের মানবেতর জীবনযাপনকে যুক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

মাওলানা লিয়াকত আলী : এ যুক্তিটি অসার ও নির্লজ্জ। কেননা ইহুদি গণহত্যা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। তার ২০ বছর পূর্বে বেলেফোর ঘোষণা আসে। ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার সাথে এ গণহত্যার কোনো সম্পর্ক নেই। পরবর্তীতে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে জনমত গঠন করতে এটা যুক্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।

তাছাড়া হত্যা করেছে ইউরোপ জায়গা আরব কেনো দিবে? যারা তাদের উপর নির্যাতন করেছে তাদের নিজস্ব ভূমিতে জায়গা দিলেই তা হতো মানবিকতা।

আওয়ার ইসলাম : তখন আরবদের প্রতিক্রিয়া কী ছিলো?

মাওলানা লিয়াকত আলী : আরবদের প্রতিক্রিয়ার দুটি দিক। এক. সাধারণ আরব, দুই. আরব শাসক। উসমানীয় খেলাফতের পতনের পর আরব দুনিয়া জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে আকৃষ্ট হয়।

জাতীয়তাবাদী সংকীর্ণতার কারণে বেলফোর ঘোষণার প্রতি একদল আরবের এড়িয়ে যাওয়া ভাব ছিলো। কিন্তু তার পরিমাণ খুব সামান্য। আবর জনগণের বৃহৎ অংশই এ অন্যায়ের জোর প্রতিবাদ করে।

অন্যদিকে শাসকরা উসমানীয় খেলাফতের পতনের পর ক্ষমতা দখল ও পাকাপোক্ত করতে ব্রিটিশদের সঙ্গে আপোষকামী মনোভব পোষণ করতো।

আওয়ার ইসলাম : বেলফোর ঘোষণার ৩০ বছর পর ইহুদি রাষ্ট্রের আনু্ষ্ঠানিক ঘোষণা আসে। এ সময়টা কি যথেষ্ট ছিলো না এই অন্যায় প্রক্রিয়া ঠেকানোর?

মাওলানা লিয়াকত আলী : সময়টা যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু ইসলামি খেলাফত ভেঙ্গে যাওয়ায় পৃথিবীতে একক নেতৃত্ব বলতে আর কিছু ছিলো না। তাই এ প্রক্রিয়া থামানো সম্ভব হয় নি। পৃথিবীর নেতৃত্বে আসীন ক্ষমতাগুলোর বিরুদ্ধে বিক্ষিপ্ত ও আঞ্চলিক প্রতিবাদ দিয়ে কার্যকর কিছু আশা করা যায় না। বিশেষত মুসলিম শাসকরা যখন নিজ নিজ ক্ষমতা ও দেশ রক্ষার সংগ্রামে ব্যস্ত থাকে।

আওয়ার ইসলাম : আপনি ইহুদিদের অন্যায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা রুখতে না পারার কারণ হিসেবে একক নেতৃত্ব তথা খেলাফতের অনুপস্থিতিকে দায়ী করছেন। কিন্তু উসমানীয় খেলাফত তো তখন সন্ধ্যার সূর্যের মতোই নিষ্প্রভ ছিলো!

মাওলানা লিয়াকত আলী : উসমানীয় খেলাফতের প্রভাব কমে গিয়েছিলো সত্য। কিন্তু এটাও তো সত্য খেলাফত যতোদিন ছিলো ততোদিন ফিলিস্তিন ভূমি দখল করা সম্ভব হয় নি কারো পক্ষে। খেলাফত ব্যবস্থাই মুসলিম জাতির মুক্তির পথ।

খেলাফতের দৃষ্টান্ত অনেকটা পিতার মতো। পিতা সবল, সুস্থ ও কর্মঠ হলে সংসারের উন্নতি ও অগ্রগতি দ্রুত হয়। পিতা দুর্বল ও অসুস্থ হলেও তার উপস্থিতি সংসারের ঐক্য, উন্নয়ন ও স্বার্থ রক্ষার জন্য সহায়ক হয়।

আওয়ার ইসলাম : খেলাফত বা বিশ্বব্যাপী একক মুসলিম নেতৃত্বে ফেরা সম্ভব হচ্ছে না কেনো?

মাওলানা লিয়াকত আলী : প্রথম বাধা সম্রাজ্যবাদী শক্তি। দ্বিতীয় বাধা তাদের দেশীয় দোসর। তারা উভয়ে পারস্পারিক স্বার্থ রক্ষার জন্য খেলাফত প্রতিষ্ঠা হতে দিচ্ছে না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তো ইসলামে রাষ্ট্রব্যবস্থা বলতে কিছু আছে এ ধারণাই মুসলিম বিশ্ব থেকে বিলুপ্ত করে দেয়া হয়েছে। এখন পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলিম মনে করে ইসলাম নিছক ধর্ম। রাষ্ট্রের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। মুসলিম বিশ্বের এ মানসিকতা ইসলামি রাষ্ট্র ও খেলাফত প্রতিষ্ঠার পক্ষে বড় বাধা।

আওয়ার ইসলাম : বেলফোর ঘোষণার একশো পূর্ণ হলো। মুসলিম জাতির জন্য শেখার কী আছে?

মাওলানা লিয়াকত আলী : অনেকে অনেক কথাই বলবে। আমি বলবো, ইহুদি জাতি থেকে আমাদের শিখতে হবে এক মুঠো মানুষ দিয়ে কিভাবে পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।

ইহুদিদের আমরা দেখি, তাদের শিক্ষা, গবেষণা, ঐক্য ও লক্ষ্যে অবিচল থাকার দৃঢ় প্রত্যয়ে তারা সমৃদ্ধ এবং লক্ষ্য অর্জনে সুদীর্ঘ পরিকল্পনা। লক্ষে অর্জনে ধৈর্য্যহারা হওয়া ও তড়িৎ ফল চাওয়া আমাদের চারিত্রিক দুর্বলতা অন্যতম দিক।

আওয়ার ইসলাম : আওয়ার ইসলামকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

মাওলানা লিয়াকত আলী : আওয়ার ইসলাম পরিবার ও তার সব পাঠকের প্রতি আমার সালাম ও অভিনন্দন রইলো।

আসছে রবিউল আওয়াল, জীবনের শ্রেষ্ঠ চিঠিটা নবীজিকেই লিখুন


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ