শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
পার্বত্য জেলায় চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে যা জানাল আইএসপিআর ঢাবিতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক : ইসলামী ছাত্র আন্দোলন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ছাড়া ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না: সৌদি যুবরাজ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হারলে দায় বর্তাবে ইহুদিদের ওপর: ট্রাম্প পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সরকার, সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার আ.লীগ নেতাকর্মীর প্রভাবে নিউ ইয়র্কে ড. ইউনূসের সংবর্ধনা বাতিল আইন নিজের হাতে তুলে নিলে কঠোর ব্যবস্থা ইসলামি লেখক ফোরামের বৈঠক অনুষ্ঠিত, আসছে নতুন কর্মসূচি সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান কারাগারে উত্তপ্ত খাগড়াছড়িতে ১৪৪ ধারা জারি

যেভাবে হারিয়ে যাচ্ছে ইবতেদায়ি মাদরাসা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

যুবায়ের আহমাদ

আমাদের বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে পাটধা নয়াপাড়া গ্রামে একটি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা। মাদ্রাসাটি থেকে আধা কিলোমিটারেরও কম দূরে ছিল আরেকটি রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুল। একই রাস্তার পাশে দুটো প্রতিষ্ঠান।

মাদ্রাসা ও স্কুল উভয়টিরই ছিল ভাঙা টিনের ঘর। টিনের বেড়া ভাঙা ছিল বলে ক্লাসের দৃশ্য বাইরে থেকেই দেখা যেত। উভয় ধরনের প্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষকদের সম্মানী ছিল ৫০০ টাকা করে। স্কুলটির নাম ছিল ‘সাহেদা খালেক রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়’।

কিছুদিন পর স্কুলটির শিক্ষকদের সুবিধা বাড়তে থাকল। এর শিক্ষকরা জাতীয় স্কেলে বেতন পেতে শুরু করলেন, মাদ্রাসাটির শিক্ষকরা স্কেল পেলেন না। স্কুলের সুবিধা বাড়তে বাড়তে সরকারি হয়ে বর্তমানে এর নাম ‘সাহেদা খালেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’।

এর বিপরীতে মাদ্রাসাটি মৃতপ্রায়। স্কুলটির আছে বিল্ডিং, মাদ্রাসাটির ক্ষেত্রে তার কিছুই নেই। হঠাৎ এক রাতে প্রলয়ঙ্করি ঝড়ে উড়ে গেল মাদ্রাসাটির টিনের চাল। বেতন না পাওয়ায় অভাবে থাকা শিক্ষকরা টাকার ব্যবস্থা করতে পারেননি বলে আর মেরামত করা হলো না মাদ্রাসার ঘরটি।

অনেক দিন পর আবার শিক্ষকরা নিজেরা ধারদেনা করে দাঁড় করালেন ঘরটি। কখনো শনের, কখনো টিনের। এভাবেই গ্রামগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ইবতেদায়ি মাদ্রাসাগুলো মৃতপ্রায় হয়ে টিকে আছে।

কোনো কোনো মাদ্রাসা একেবারেই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। এখন কেবলই সেগুলো ইতিহাস। যেসব প্রতিষ্ঠান এখনো প্রাণে বেঁচে আছে, সেগুলোরও হাজার হাজার ইবতেদায়ি শিক্ষক কোনো বেতনভাতা না পেয়েই অবসর গ্রহণের রেকর্ড করেছেন।

১৯৮৪-৮৫ সালে ১৮ হাজার ১৯৮টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা রেজিস্ট্রেশন পায়। ১৯৯৪ সালে একই পরিপত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে গড়ে ওঠা রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকদের মাসিক ৫০০ টাকা হারে সম্মানী দেওয়া হয়।

রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ধাপে ধাপে বাড়তে থাকে। ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হয়, কিন্তু একই সময়ে রেজিস্ট্রিকৃত স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসাগুলোর ভাতা ৫০০ টাকাই থেকে যায়।

এমনকি বিগত চারদলীয় জোট সরকার গণমানুষের ইসলামী মূল্যবোধকে পুঁজি করে ক্ষমতায় এলেও একটি বারের জন্যও ফিরে তাকায়নি এই চরম অবহেলিত ইবতেদায়ি শিক্ষকদের দিকে।

রেজিস্টার্ড স্কুলগুলো সরকারিকরণের ঘোষণার দিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রাথমিক শিক্ষাকে সম্পূর্ণ জাতীয়করণের ঘোষণাও করেছিলেন। সেই থেকে ইবতেদায়ি শিক্ষকরা নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন।

একই বছর তাদের (এমপিওভুক্ত ছয় হাজার ৭৬ শিক্ষকের) ভাতা ৫০০ থেকে এক হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়। তারপর স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নিয়ে বিরাজমান সমস্যা সমাধানে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে। সে কমিটি তিনটি প্রস্তাব তৈরি করে।

প্রস্তাব ১. প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতোই স্কেল দেওয়া। ২. স্কেলের ৫০ শতাংশ দেওয়া। ৩. বেতনভাতা এক হাজার থেকে বাড়িয়ে দুই হাজার টাকা করা।

প্রথম প্রস্তাব অর্থাৎ প্রাথমিকের সমান স্কেল দেওয়ার বিষয়টি কার্যকর হয়নি। হয়নি দ্বিতীয়টিও। তৃতীয় প্রস্তাব অনুযায়ী এক হাজার থেকে বাড়িয়ে দুই হাজার টাকা করা হয়েছে।

আফসোস! সে প্রস্তাব বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের মানবেতর জীবনযাপনের দিকে তাকানো হয়নি। অথচ যারা চাইলেই শিক্ষকদের জন্য প্রাথমিকের সমান স্কেল প্রদানের প্রস্তাব কার্যকর করতে পারতেন, কিন্তু করেননি। তারাও তো কোনো না কোনো শিক্ষকেরই ছাত্র। ভুলে গেলেন শিক্ষকসামাজকে।

কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয়করণে সরকারের সদিচ্ছার কথা আবারও উঠে আসে মিডিয়ায়। ইবতেদায়ি মাদ্রাসা জাতীয়করণসহ শিক্ষকদের সব সুবিধা দিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড আলাদা বৈঠক করে।

গত ৪ মে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ইবতেদায়ি শিক্ষকদের জাতীয়করণের দাবি মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। মন্ত্রী, সচিব হয়ে প্রধানমন্ত্রীর সবুজ সংকেত পেলেই শিক্ষকদের এ স্বপ্ন আশার আলো দেখবে।

আজ মাদ্রাসা অবহেলিত অথচ ভারতীয় উপমহাদেশের মূল ধারার শিক্ষাই হলো মাদ্রাসা শিক্ষা। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে ব্রিটিশদের হাতে আমাদের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রণীত একমাত্র শিক্ষাব্যবস্থা ছিল মাদ্রাসা।

মুসলিম শিশুদের শিক্ষা শুরু হতো কোরআন শিক্ষার মাধ্যমে। তৎকালীন সময়ে প্রাথমিক শিক্ষা ছিল পূর্ণাঙ্গ ইসলামি। ঐতিহাসিকের মতে, Between the age of four and five years the Muslim boys and girls were required to attend the Primary Madrasah for their primary education. It was customary to start with Bismillah ceremony of a boy or girl at the age of four years, four months and four days. (A. R. Mallic, British policy and Muslim in Bengal: ১৪৯).

অর্থাৎ মুসলিম বালক-বালিকাদের জন্য চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই ইবতেদায়ি (প্রাথমিক) মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। এটা ছিল প্রতিটি মুসলিম পরিবারের অপরিহার্য প্রথা যে, কোনো সন্তানের বয়স চার বছর চার মাস চার দিন পূর্ণ হলে বিসমিল্লাহ অনুষ্ঠান নামে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার শিক্ষার সূচনা হতো।

পবিত্র কোরআনের কিছু অংশ শিশুকে পাঠ করে শোনানো হতো এবং শিশু তা পুনরাবৃত্তি করত।

প্রাথমিকের সীমা অতিক্রমের পর মাদ্রাসায় তাদের ইসলামি শিক্ষার পাশাপাশি বিজ্ঞান, চিকিৎসা, প্রকৌশলবিদ্যা পড়তে হতো। ৭০০ বছরের মুসলিম শাসনের সময়ে উপমহাদেশের মাদ্রাসাগুলোর ব্যয়ভার বহনের জন্য বিশাল সম্পত্তি ওয়াকফ করা ছিল।

ব্রিটিশরা এসে প্রাথমিক শিক্ষার শত শত বছর ধরে চলে আসা সেই মাদ্রাসাগুলোকে বন্ধ করে দেয়। মাদ্রাসার জন্য ওয়াকফকৃত সম্পত্তিগুলো বাজেয়াফত করে চাপিয়ে দেয় প্রাথমিক শিক্ষা। ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা উদ্ধার হলেও ওয়াকফকৃত সম্পত্তি আর ফিরে পায়নি আমাদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যের ধারক মাদ্রাসাগুলো।

ব্রিটিশ-পরবর্তী সময়েও মাদ্রাসা থেকে অনেক আলোকিত সন্তানের জন্ম হয়েছে। শহিদ তিতুমীর, হাজি শরিয়তুল্লাহ, মওলানা ভাসানী, মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগিশ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র।

পিতা মৌলভী মো. ইয়াসিন খান সাহেবের কাছে গ্রহণ করা দীনি শিক্ষাই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বুনিয়াদ। আজো মাদ্রাসার ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়।

বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখে তারা। সন্ত্রাস, জুয়া, ইয়াবা, ফেনসিডিলের মতো মাদকসহ সব ধরনের অসামাজিক কর্মকান্ডে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ প্রায় শূন্যের কোঠায়।

শিক্ষার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড অত্যন্ত প্রশংসিত। প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে ইবতেদায়ি শিক্ষকরা।

আশা করি, তাদের হতাশার দিন ফুরাবে এ সরকারের হাত ধরেই। এমপিও বা কোনো প্রকার বেতনভাতা না পাওয়ায় যেসব মাদ্রাসার অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার পথে সেগুলোকে প্রাণ সঞ্চার করাসহ সব স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসাকে জাতীয়করণ করে প্রধানমন্ত্রী নিজেকে বৈষম্যহীন শিক্ষাবান্ধব হিসেবে প্রমাণ করবেন।

তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে বঞ্চিত শিক্ষকদের মুখে হাসি ফুটিয়ে কোটি জনতার হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নেবেন তিনি। বাংলা-ইংরেজির পাশাপাশি কোরআনের সোনালি অক্ষর ‘আলিফ, বা, তা, ছা’র শিক্ষার উন্নয়ন করে তিনি সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলার দরবারেও মর্যাদার স্থান অর্জন করবেন-এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক

কওমি শিক্ষা সনদের চলমান প্রক্রিয়া নিয়ে আলেমদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ