সোমবার, ১০ মার্চ ২০২৫ ।। ২৫ ফাল্গুন ১৪৩১ ।। ১০ রমজান ১৪৪৬

শিরোনাম :
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হলেন আনিসুজ্জামান চৌধুরী বিরতিকে কাজে লাগিয়ে মুসলিম ফুটবলারদের ওমরা পালন ধর্ষণের বিচারে শরয়ি আইন থাকলে, কোন শিশু আর ধর্ষিত হতো না: উলামা-জনতা ঐক্য পরিষদ শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি থাকায় ঈদে নতুন নোট বিতরণ স্থগিত ধর্ষণ এবং নারীর পরিচয় নিয়ে অবমাননায় ১৫১ আলেমের বিবৃতি ১০ম তারাবির নামাজে তিলাওয়াতের সারমর্ম ত্রাণ বন্ধের পর এবার গাজায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করছে ইসরায়েল তারাবিতে ফাইভ জি স্পিডে তেলাওয়াত করবেন না: আজহারী ‘আলেমদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তোলা জিহাদ নয়, সন্ত্রাসী কার্যক্রম’ পদত্যাগ করেছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আমিনুল ইসলাম

আরাকানের স্বাধীনতা ছাড়া রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান অসম্ভব: মাওলানা লিয়াকত আলী

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা লিয়াকত আলী। আলেম, সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক। মাদরাসা দারুর রাশাদের মুহাদ্দিস ও শিক্ষা সচিব প্রাজ্ঞ এ আলেম দৈনিক নয়া দিগন্তের সিনিয়র সহ-সম্পাদক পদে কর্মরত রয়েছেন।

সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কথা বলেছেন আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকমের সাথে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আতাউর রহমান খসরু

আওয়ার ইসলাম : বর্তমান রোহিঙ্গা সংকটের ‍মূল কারণ কী?

মাওলানা লিয়াকত আলী : মূল কারণ উগ্র জাতীয়তাবাদ ও জাতিগত বিদ্বেষ। একটি ঐতিহাসিক কারণও রয়েছে। তাহলো, মুসলিমদের কাছ থেকে বার্মিজরা স্বাধীন আরাকান রাজ্য দখল করে এবং মুসলিমদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। বার্মিজদের পূর্ব নির্যাতন ও রাষ্ট্র ছিনিয়ে নেয়ার ক্ষোভ থেকে ব্রিটিশ বাহিনী বার্মা আক্রমণ করলে আরাকানের মুসলিমগণ ব্রিটিশদের সাহায্য করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও মুসলিম ব্রিটিশের পক্ষ নিয়ে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আর বার্মিজরা ছিলো জাপানের পক্ষে। জাতিগত ঐতিহাসিক এ সংঘাত বর্তমান সংকটের অন্যতম কারণ।

মুসলিম সহযোগিতার বিনিময়ে ব্রিটিশ বাহিনী আরাকানের স্বাধীনতার আশ্বাস দিয়েছিলো। কিন্তু তারা মুসলমানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। ব্রিটিশদের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য রোহিঙ্গা মুসলমানের আজ এ দুর্দিন।

আওয়ার ইসলাম : মিয়ানমার বার বার দাবি করছে ১৮২৪ সালের পূর্বে রাখাইন রাজ্যে কোনো মুসলিম ছিলো না। ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর তারা সেখানে বসতি স্থাপন করেছে। এ দাবি কতোটা সত্য?

মাওলানা লিয়াকত আলী : দাবিটা সম্পূর্ণ মিথ্যে। আরাকানে ‍ইসলামের প্রচার হয়েছে আরব ব্যবসায়ী ও ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে। বার্মিজরা রাখাইন দখল করার পূর্বে সেখানে স্বাধীন মুসলিম আরাকান রাষ্ট্র ছিলো। মুসলিম শাসকগণ আরাকান শাসন করতেন। এটা হতে পারে ব্রিটিশ আনুকূল্যে সেখানে মুসলিম জনগোষ্ঠির সমাগম বেড়েছে। ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদী সরকার তাদের স্বার্থেও বহু মুসলিমকে মিয়ানমারে পাঠিয়েছে কর্মচারী ও কর্মকর্তা হিসেবে। ব্রিটিশদের মাধ্যমেই সেখানে রোহিঙ্গাদের গোড়াপত্তন হয় একথা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

আর মিয়ানমারের দাবী যদি সত্যও হয়, তবুও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। কেননা আন্তর্জাতিক আইনে মানুষের দেশ, নাগরিকত্ব ও বাসস্থান পরিবর্তনের অধিকার দেয়া হয়েছে।

আওয়ার ইসলাম : দীর্ঘ অর্ধ-শতাব্দীকাল অতিক্রান্ত হওয়ার পরও রোহিঙ্গা ইস্যুতে কোনো মিমাংসা হলো না কেনো?

মাওলানা লিয়াকত আলী : রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক কোনো উদ্যোগই তো নেয়া হয় নি। সমাধান হবে কি করে? বিশ্বব্যাপী ইসলামি খেলাফতের পতন; বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বলতে গেলে মুসলিম বিশ্বের কোনো সমস্যার সমাধান হয় নি। আর সেটা হওয়ার সম্ভাবনাও কম। কেননা অমুসলিমরা মুসলমানের বিরুদ্ধে সব সময় এক ও অভিন্ন অবস্থানে রয়েছে।  একদিকে মিয়ানমারের পক্ষে রয়েছে আমেরিকা, চীন, রাশিয়া ও ভারত, অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের পক্ষে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোই ঠিক মতো কথা বলছে না। এখন বলুন, সমস্যার সমাধান কিভাবে হবে?

আওয়ার ইসলাম : ঠিক বলেছেন। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোও রোহিঙ্গা নিপীড়নের ব্যাপারে সমান সোচ্চার নয়। বিশেষত আরব রাষ্ট্রগুলোর নিরবতা মুসলিম বিশ্বের জন্য বিস্ময়কর ও বেদনাদায়ক। এ নিরবতার কী কারণ?

মাওলানা লিয়াকত আলী : আমাদের ধর্ম ইসলামের বিকাশ আরব ভূমি থেকে হয়েছিলো। তাই আরবের ব্যাপারে আমাদের একটি আবেগ কাজ করে। আমরা আশা করি, ইসলাম ও মুসলমানকে রক্ষায় তারা নেতৃত্ব দিক এবং জোরালো ভূমিকা পালন করুক। এজন্য আমরা কষ্ট পাই, বেদনাহত হই।

কিন্তু মনে রাখতে হবে, বর্তমান অধিকাংশ আরব রাষ্ট্রগুলো মেরুদণ্ডহীন। আরবের শাসকরা ইউরোপ-আমেরিকার পোষ্য ও দাস। ইউরোপ-আমেরিকার সিদ্ধান্তের বাইরে তাদের যাওয়া অসম্ভব।

আরব রাষ্ট্রনীতির আদর্শিক কোনো ভিত্তি নেই। আরব রাষ্ট্রনীতির ভিত্তি আরব জাতীয়তাবাদ ও শাসকদের স্বার্থের নিরাপত্তা। আমরা যে আবেগের জায়গা থেকে তাদের দেখি তাদের ভেতর সে আবেগ কাজ করে না।

আওয়ার ইসলাম : তাহলে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কোথায়?

মাওলানা লিয়াকত আলী : আরাকান রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ব্যতীত রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী কোনো সমাধান নেই। কোনো সংঘাত যখন জাতিগত বিদ্বেষে রূপ নেয়, তখন স্বাধীনতা ছাড়া সমাধানের কোনো পথ খোলা থাকে না।

সাময়িক কিছু সমাধানের কথাও আমরা বিবেচনা করতে পারি। যেমন, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান, ভোটারাধিকার ফিরিয়ে দেয়া, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান ইত্যাদি। মুসলমান ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ব্যতীতও তা অর্জন করা সম্ভব নয়।

আওয়ার ইসলাম : স্বাধীনতা, স্বায়ত্তশাসন বা ন্যূনতম নাগরিক অধিকারই হোক, তা কিভাবে অর্জিত হবে?

মাওলানা লিয়াকত আলী : সশস্ত্র বিপ্লবের ধারণা এ যুগে খানিকটা অচলই বলতে হবে। কেননা সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা বা ভূমি দখল করা সম্ভব। কিন্তু বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে টিকে থাকা অসম্ভব। সুতরাং স্বাধীনতার কথা বলি আর নাগরিক অধিকারের কথা বলি তা করতে হবে কূটনৈতিক উপায়ে। জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে তা সম্ভব।

আওয়ার ইসলাম : বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার আলোকে মুসলিম বিশ্বের পক্ষে কি কূটনৈতিক উপায়ে কোনো ভূখণ্ডের স্বাধীনতার দাবি আদায় করা সম্ভব?

মাওলানা লিয়াকত আলী : পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার দাবি আদায় করা কঠিন। কিন্তু মুসলিম বিশ্ব সোচ্চার হলে নির্যাতন বন্ধ ও নাগরিকত্ব আদায় করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। কারণ, বিশ্ব মোড়লদের অনেক স্বার্থই মুসলিম দেশগুলোর সাথে জড়িত।

আওয়ার ইসলাম : রোহিঙ্গা সংকটে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত বাংলাদেশ। বাংলাদেশের করণীয় কী?

মাওলানা লিয়াকত আলী : বাংলাদেশের জন্য পরিস্থিতি সত্যিই সংকটময়। একদিকে রোহিঙ্গা মুসলমিদের মানবিক আশ্রয় না দিয়ে উপায় নেই, অন্যদিকে এ বিপুল সংখ্যক মানুষকে আশ্রয় দেয়া ও তাদের ব্যয় বহন করা বাংলাদেশের জন্য অসম্ভবপ্রায়।

যেহেতু আন্তর্জাতিক আইনে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বাধ্য। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে।

আওয়ার ইসলাম : আশ্রয় তো কোনো সমাধান নয়। মিয়ানমার চায়, রোহিঙ্গারা দেশ ছেড়ে চলে যাক। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলে তাদের প্রত্যাশায় তো পূরণ হচ্ছে?

মাওলানা লিয়াকত আলী : আমি তো আশ্রয়কে চূড়ান্ত সমাধান বলি নি। রোহিঙ্গাদের মানবিক দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিবে আবার তাদের স্বদেশে নিরাপদে ফিরিয়ে দিতে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাবে। সামগ্রিক বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্ব বাংলাদেশকে সাহায্য করবে। আর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বের হয়ে আসবে স্থায়ী সমাধান।

আওয়ার ইসলাম : রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার বিপক্ষে যাদের অবস্থান, তাদের দাবি রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে নানা সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষত মাদক চোরাচালানের সাথে তারা জড়িত।

মাওলানা লিয়াকত আলী : এ কথাটি পুরোপুরি সত্য নয়। কোনো ছিন্নমূল গোষ্ঠির পক্ষে এককভাবে কোনো অপরাধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। যেমন ধরুন! ঢাকা শহরের অধিকাংশ অপরাধের সাথে ছিন্নমূল বস্তিবাসীর নাম জড়িয়ে যায়। কিন্তু একটু অনুসন্ধান করলে বের হয়ে আসে তাদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিচ্ছে রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রীয় কর্তা ব্যক্তিরা।

রোহিঙ্গাদের ব্যাপারটিও তেমন। তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে একদল ক্ষমতাশীল ব্যক্তি তাদের নানা অপরাধে ব্যবহার করছে। অপরাধের বিচার করলে পর্দার অন্তরালে থাকা ব্যক্তিদেরই প্রথম বিচার হওয়া দরকার।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ