শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬


রোহিঙ্গা সমস্যা; যে পথে এগুতে হবে আমাদের

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

যুবায়ের আহমাদ

রোহিঙ্গা নামটি শুনলেই ভেসে আসে নিজেদের ভিটায় পরবাসী নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর ছবি। রেহিঙ্গা প্রশ্নে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। গত কয়েকদিনে আবারো রোহিঙ্গা নির্যাতনের খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় উঠে এলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আহবান করে। আমরা আশা করেছিলাম জাতিসংঘ ন্যূনতম ভূমিকাটুকু পালন করবে। কিন্তু তা হলো না।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে চীনের আপত্তির কারণে বিশ্ব মানবতার ‘কল্যাণে’ নিবেদিত আন্তর্জাতিক সংস্থাটি রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি বিবৃতি পর্যন্তু দিতে পারেনি। চীন রোহিঙ্গাদের পক্ষের প্রস্তাবের বিরোধিতা করবে তাই স্বাভাবিক। কারণ আজ যদি রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধ হয়, নির্যাতনের কারণে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে জবাবদিহি করতে হয় তাহলে সেদিন বেশি দূরে নয় যে উইঘুর মুসলিমদের নির্যাতনের কারণে চীনকেও জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে।

জাতিসংঘ যদি কোনো পদক্ষেপ না নেয় তাহলে কি রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান নির্যাতন চলতেই থাকবে? আমাদের কি কিছুই করার নেই? পৃথিবীর মুসলিম রাষ্ট্রগুলো আন্তরিক হলেও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সম্ভব।

রোহিঙ্গাদের স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। সে রাষ্ট্রের নাম আরাকান। এর পাশেই ছিল বৌদ্ধ রাষ্ট্র ‘বার্মা’। আরাকান ছিল প্রাচীন বঙ্গের অংশ। এর অধিবাসীরা ছিল রোহিঙ্গা বাঙ্গালী মুসলমান। আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যকে মর্যাদার আসনে আসীন করতে মহাকবি আলাওলের ভূমিকার কথা আমরা জানি। তখন সংস্কৃতি, জ্ঞান ও বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল আরাকান আরাকান রাজপ্রাসাদ।

১৯৪৭ সালের ধর্মীয় দ্বি-জাতি তত্ত্বর ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভাগ না হয়ে যদি ভাষাগত জাতিতত্ত্বে ভাগ হতো তাহলে আরাকান অবশ্যই বঙ্গের অংশ থাকত।

বঙ্গের অংশ, বাঙ্গালীদের অঞ্চল তো মিয়ানমারের অধীনে থাকার কথা না। হয়তো স্বাধীন রাষ্ট্র থাকবে নয়তো কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্ত হতে হলে তা যে কোনো বিবেচনায়ই বংলাদেশের সঙ্গেই হওয়ার কথা। ভৌগোলিক দিক থেকেও আরকানের বাংলাদেশের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়াই সঙ্গতিপূর্ণ। কোনো যুক্তিতেই তা মিয়ানমারের অংশ হতে পারে না।

কিন্তু আন্তর্জাতিক মোড়লদের প্রত্যক্ষ মদদে তৎকালীন বার্মার শাসকেরা রোহিঙ্গাদের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে আরাকান দখল করে। দখলের পর যদি আরাকানীদের মৌলিক অধিকারগুলো প্রদান করত তাহলে হয়তো আরাকান নিয়ে মাথাব্যথার কারণ হতো না। কিন্তু তাদের সুবিধা দিলে তারা প্রতিষ্ঠিত হবে একদিন স্বাধীন আরাকানের পতাকা উড়াবে এ চিন্তা থেকেই হয়তো দখলদার বার্মিজরা ক্রমেই আরাকানিদের সুযোগ সুবিধার পথ সংকোচিত করতে থাকে।

সর্বশেষ ১৯৮২ সালে তথাকথিত নিউ সিটিজেনশিপ ল বা নতুন নাগরিত্ব আইন প্রণয়ন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বটুকুও কেড়ে নেয় তারা। তাদের মিয়ানমার বহির্ভূত বিদেশী হেসেবে গণ্য করা হয়। আরোপিত হয় গ্রামের বাইরে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা। বন্ধ হয়ে যায় তাদের শিক্ষার সুযোগসহ সব মৌলিক অধিকারের দ্বার। এভাবেই নিজেদের আবাসভূমিতে পরবাসী হয়ে পড়ে রোহিঙ্গারা।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী? রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আমাদের দুটি বিকল্প। প্রথমত রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বসহ সব অধিকার ফিরিয়ে দিতে মিয়ানমার সরকারকে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বরাবরই বাংলাদেশকে চাপ দিয়েছে যেন বাংলাদেশ যেন রোহিঙ্গাদের জায়গা দেয়। আমাদের অনেকেও বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত খুলে দিতে বলেন। সীমান্ত খুলে দেওয়া কোনো স্থায়ী সমাধান নয়।

আজ বাংলাদেশ ৫ হাজার রোহিঙ্গাকে জায়গা দেবে ৬ মাস পর মিয়ানমারে আবার শুরু হবে রোহিঙ্গা নিধন আবার বাংলাদেশের প্রতি সীমান্ত খুলে দেওয়ার অনুরোধ আসবে এভাবে কতদিন? আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সীমান্ত খুলে দেওয়ার অন্যায় অবদারের মাঝেও রয়েছে গভীর ষড়যন্ত্র। তারা চাইছে সমস্যাটি জিইয়ে রেখে আরাকান থেকে এ কৌশলে রোহিঙ্গাদের বের করে বাংলাদেশ বা অন্য কোনো দেশে ঠেলে দিয়ে আরাকানের ভূমি বৌদ্ধদের নিরাপদ আবাসে পরিণত করতে। তাদেরর উচিত বাংলাদেশের প্রতি সীমান্ত খুলে দেওয়ার অনুরোধ করার আগে নিজেদের মাতৃভূমিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে মিয়ানমারকে চাপ দেওয়া। যদি তারা তা করত তাহলে নিশ্চয় এতদিনে তা সমাধান হতো। যদিও মানবিক কারণে আমরা তাদের জায়গা দিচ্ছি কিন্তু এর পাশাপাশি স্থায়ী সমাধানের দিকে হাঁটতে হবে।

প্রথম পর্যায়ে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর দেশগুলো বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলো মিয়ানমারকে আল্টিমেটাম দিতে পারে যে রোহিঙ্গাদের যথাযথ প্রাপ্য না দিলে তারা মিয়ানমারের সঙ্গে সব ধরণের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করবে। এতে মিয়ানমার সরকারের টনক না নড়লে বাস্তবেই কিছুদিনের জন্য রাষ্ট্রটির সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে। তাতে কাজ না হলে দ্বিতীয় পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।

দ্বিতীয় পদক্ষেপটি হলো স্বাধীন আরাকানের পক্ষে কথা বলা। যদি এটিই বাস্তব হয় যে মিয়ানমার সরকার কিছুতেই রেহিঙ্গাদের অধিকার দেবে না তাহলে স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্রের দিকে হাঁটা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

স্বাধীনতা মুনষের জন্মগত অধিকার। শাসনের নামে রেহিঙ্গাদের আধুনিক দাসে পরিণত করে রাখার অধিকার তাদের নেই। যদি মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদেরকে নাগরিকত্ব না দেয় তাহলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ কথা জোর দিয়ে বলতে হবে যে আসলেই এরা মিয়ানমারের নাগরিক নয়; এরা আরাকানের নাগরিক।

রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ সরকার যে পরিকল্পনায় এগুচ্ছে

আরাকান রাষ্ট্রের দখল যেন মিয়ানমার ছেড়ে দেয়। শান্তি প্রতিষ্ঠায় আরাকানের স্বাধীনতাকামীদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে মুসলিম দেশগুলোসহ অন্যান্য শান্তিকামী দেশ মিয়ানমারের বিরেুদ্ধে সৈন্য পাঠাতে পারে। যেহেতু আরাকানে অশান্তি হলে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে বাংলাদেশে তাই মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার প্রদান না করলে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদানকারী আরাকানীদের স্বাধীনতা আন্দোলনে শক্তভাবে পাশে দাঁড়াবার ব্যাপারটিও গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে পারে বাংলাদেশ।

মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের ব্যাপারে বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই কথা বলছেন। ব্যাপারটি খুবই ইতিবাচক। মানবিক দায়বদ্ধতা থেকে সাংবাদিক ও লেখকরা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তরিক হলে তা মিয়ানমারের প্রতি আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া বা স্বাধীন আরাকান প্রতিষ্ঠায় জনমত তৈরিতে খুবই সহায়ক হবে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ