মাওলানা আবু দারদা
শিক্ষক; ফয়জুল উলুম মাদরাসা চাঁদপুর
মাদকতা একটি অভিশাপ।মাদকতা ব্যক্তির প্রতিভা বিকাশ ও সমাজের উন্নয়নের পথে অন্তরায়। মাদকদ্রব্য সেবনে মানুষের বিবেক-বুদ্ধি লোপ পায়।
নেশার জগতে পা বাড়ালে প্রতিভারা ক্ষয়ে-ক্ষয়ে ক্রমশ ঘৃণিত ও অচ্ছূৎ হয়ে যায়। মাদকাসক্তি কেড়ে নেয় মার্জিত ব্যক্তির সামাজিক বন্ধন ও সম্মান। ধ্বংস করে স্বাস্থ্য ও সম্পদ।নেশার অনিষ্ট থেকে উম্মতকে বাঁচাতে প্রিয় নবি সা. পর্যায়ক্রমে মদ পানকে চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। নেশার অনিষ্ট সম্পর্কে জানিয়েছেন উম্মতকে।
হাদিসে এসেছে মাদকতাকে ‘না’ বলার নির্দেশ। কুরআনে এসেছে নেশার অনিষ্টের বর্ণনা ও তা নিষিদ্ধ হওয়ার ঘোষণা। অনেকে স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য মদ পান করার অভ্যাস গড়ে। এটা বাহ্যত উন্নতি মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে ক্ষতির দ্বার উন্মোচিত করে। পবিত্র কুরআনে এমনই বর্ণনা এসেছে। আল্লাহ বলেন, “তারা তোমাকে (নবি সা.) মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দাও, এ দুটির মাঝে রয়েছে মহাপাপ।
আর মানুষের জন্য উপকারিতাও রয়েছে, তবে এ-গুলোর পাপ উপকারিতা অপেক্ষা অনেক বড়”। সুরা বাক্বরা-২১৯
আয়াতটিতে বলা হয়েছে যে, মদ ও জুয়াতে যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে কিছু উপকারিতা পরিলক্ষিত হয়, কিন্তু দু’টির মাধ্যমেই অনেক বড় বড় পাপের পথ উন্মুক্ত হয়; যা এর উপকারিতার তুলনায় অনেক বেশি ক্ষতিকর।
ইসলামের দৃষ্টিতে মদ-জুয়া হারাম। কবিরা গুনাহ। শয়তান কখনো আদম সন্তানের ভাল চায় না। সে চায় মানুষ তার স্রষ্টাকে ভুলে থাকুক। নেশা আর মাস্তিতে বুঁদ হয়ে পড়ে থাকুক। সমাজে মন্দ আর ক্ষতিকর কাজের ব্যাপকতা লাভ করুক। সম্ভাব্য জান্নাতিকে জাহান্নামি আর সমাজের শান্তিকে অশান্তিতে পরিণত করার জন্য শয়তান জাল বুনে। সে জাল ছড়িয়ে দেয় সমাজে। মদ ও জুয়া মুমেন বান্দাকে আটকে ফেলার জন্য শয়তানের ছড়ানো জাল।
এ জাল থেকে সতর্ক থাকার জন্য পবিত্র কুরআনে আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! মদ, জুয়া প্রতিমা ও লটারি এ সবই শয়তানের কাজ। তোমরা তা হতে বিরত থাক। আশা করা যায় , তোমরা সাফল্য লাভ করতে পারবে। নিশ্চয় শয়তান, মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে চায় এবং আল্লাহর স্মরণ ও নামায হতে তোমাদের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকে। তাই তোমরা এসব জিনিস হতে বিরত থাকবে কি? সুরা মায়েদা ৯০-৯১
মাদকতা নিষিদ্ধের ঘোষণা দিয়ে রাসুল সা. বলেছেন, ‘হযরত জাবের রা. হতে বর্ণিত রাসূল সা. বলেন; প্রত্যেক নেশাকর বস্তু হারাম। মেশকাত-৩৬৩৯
হযরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত রাসুল সা. বলেন ; প্রত্যেক পানীয় যা নেশাগ্রস্ত করে তা হারাম। মেশকাত-৩৬৩৭
মদ ক্রয়-বিক্রয়, পান-বহন মদের ব্যবসার অনুমোদন সবই ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ। জীবাণু জিইয়ে রেখে যেমন কোন রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠতে পারে না তেমনি মদ্যশালার রাষ্ট্রীয় বৈধতা রেখে মাদকতামুক্ত সুস্থ সমাজ গড়া সম্ভব নয়। মাদকতায় শুধু শারীরিক ও সামাজিক ক্ষতিই নয় পরকালের সুখময় জীবনকেও নরকে পরিণত করে। রাসুল সা. এর বদদোয়া রয়েছে মাদকতায় জড়িতদের প্রতি।
হযরত আনাস রা. বলেন; রাসুল সা. মদের সাথে সম্পৃক্ত দশ ব্যক্তিকে লানত করেছেন। ১. মদ প্রস্তুতকরী। ২. মদের ফরমায়েশ দানকারী। ৩. মদ পানকারী। ৪. মদ বহনকারী। ৫. যার কাছে মদ নিয়ে যাওয়া হয় সে ব্যক্তি। ৬. যে মদ পান করায়। ৭. মদ বিক্রেতা। ৮. মদের মূল্য ভোগকারী। ৯. মদ ক্রয়কারী। ১০. যার জন্য মদ ক্রয় করা হয়। মেশকাত-২৭৭৬
শুধু সংবাদ ব্রিফিং আর মুখরোচক কথায় মাদকতার অবসান ঘটানো সম্ভব নয়। মাদকপাচারকারীরা আইনের ফাঁকফোকড়ে বেরিয়ে গেলে মাদকমুক্ত সমাজ গড়া সম্ভব নয়। তাই মাদকতার বিরুদ্ধে রাসুলের সা. এর অবস্থান ছিল কঠোর। হযরত জাবের রা. হতে বর্ণিত রাসুল সা. বলেন; যে ব্যক্তি মদপান করে। তাকে বেত্রাঘাত করো। যদি চতুর্থবার পান করে তবে তাকে হত্যা করো। তিনি বলেন পরে অনুরূপ এক ব্যক্তিকে তার নিকট আনা হলে তিনি তাকে প্রহার করেন কিন্তু হত্যা করেননি। মেশকাত- ৩৬১৭
উমর রা. এর শেষ যুগে তিনি ৪০ বেত্রাঘাত করতেন। কিন্তু যখন মদপান বৃদ্ধি পেতে লাগলো তখন তিনি ৮০ বেত্রাঘাত করতেন। মেশকাত-৩৬১৬
দুনিয়ায় মদ পান হারাম। নিষিদ্ধ। কিন্তু জান্নাতে মদ সুপেয় পানীয়। যারা দুনিয়ায় মদ পান করবে তারা আখেরাতে তা থেকে বঞ্চিত হবে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত রাসূল সা. বলেন ; যে ব্যক্তি দুনিয়াতে মদ পান করলো অথচ তওবা করলো না। আখেরাতে সে থেকে বঞ্চিত হবে। মুসলিম-২০০৩
হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রা.বলেন রাসূল সা. বলেছেন; আল্লাহ ঐ ব্যক্তির জন্য ওয়াদাবদ্ধ যে ব্যক্তি নেশাজাতীয় বস্তু পান করে তাকে ‘ত্বীনাতুল খাবাল’ পান করাবেন। আরজ হলো হে আল্লাহর রাসুল সেটা কী? তিনি বললেন, জাহান্নামিদের দেহের ঘাম অথবা দেহনিঃসৃত রক্ত-পুঁজ। মেশকাত-৩৬৩৯
মাদকতা সমাজের শান্তি ছিনিয়ে নেয়। আখেরাতের শান্তির বিঘ্ন ঘটায়। ধর্মীয় বিধিনিষেধ মেনে চললে মাদক নিরাময়কেন্দ্রের আশ্রয় নেওয়া ছাড়াই ধীরে ধীরে মাদকসেবীরা সুস্থ হয়ে ওঠবে। ধর্মীয় অনুভূতি, পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক সচেতনতা ও প্রশাসনিক কঠোরতা সমাজের সর্ব স্তরে প্রতিষ্ঠিত হলে ‘মাদককে ‘না’ বলুন’ স্লোগানের যথার্থ প্রয়োগ হবে।
ডিএস