শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
ইসলামি লেখক ফোরামের বৈঠক অনুষ্ঠিত, আসছে নতুন কর্মসূচি নিজের হাতে আইন তুলে নিলে কঠোর ব্যবস্থা, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স উত্তপ্ত খাগড়াছড়িতে ১৪৪ ধারা জারি খুলনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা নেতানিয়াহুকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে ইসরায়েলি নাগরিক গ্রেপ্তার ‘উলামায়ে কেরামদের বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন অসম্ভব’ নিউইয়র্কে যাদের সঙ্গে বৈঠক হতে পারে প্রধান উপদেষ্টার গাজাজুড়ে ইসরায়েলের নৃশংস হামলা, নারী-শিশুসহ নিহত ২৮ ফিলিস্তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল প্রকার রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত 'ঢাবি ও জাবির হত্যাকাণ্ডে জড়িত খুনীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে'

কয়েকটি দ্বিধা এবং একটি সুরাহা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ

munshi_ubaidullah‘সংসারের হাল ধরো৷ পড়াশোনার আর দরকার নেই৷' বাড়ি থেকে জোর তাগিদ আসে৷ তরুণের মনটা ভেঙে যায়৷ পড়াশোনায় আর তার মন বসে না৷ মাথায় ঢোকে না কিতাবের হাশিয়া, বাইনাসসতর৷ সংসার পরিচালনার চিন্তায় বিভোর হয় সারাক্ষণ৷ পথপন্থা খুঁজে বের করবার প্রয়সী হয় বহু৷ কিন্তু কোন পথে যাবে! পায় না কোনো দিশা৷

মাদরাসায় পড়ালে বেতন কম৷ সংসার চালানো মুশকিল৷ বিয়ে করা হবে না৷ ঋণ করে বিয়ে করলেও বউ নারাজ থাকবে৷ আলতা, স্নো-লিপস্টিক কেনার পয়সা হবে না৷ বাসায় গেলে মুখ ভার করে বসে থাকবে নববধূ৷ পেটে দানাপানি পড়বে না৷ নানান টেনশন৷ নাহ, মাদরাসায় পড়ানো বাদ৷

মাথা চুলকোয় তরুণ৷ বালিশের উল্টো পিঠে মাথা রাখে৷ ভাবে কী করা যায়! মাথায় কিচ্ছুটি খেলে না কোনোমতেই তার৷ ভাবতে ভাবতে ভাবনার রাজ্য, অতঃপর ঘুমের দেশে বেড়াতে যায় সে৷ স্বপ্নভঙ্গের একটি রাত পেরোয়৷ আরম্ভ হয় আরেকটি দিন স্বপ্নদেখার৷

চায়ের কাপে চুমুক মারে তরুণ৷ হঠাৎ মাথায় খেলে একটা বুদ্ধি৷ হু, ব্যবসা করা যেতে পারে৷ ওপরে ওঠতে ব্যবসাই আমার জন্য পারফেক্ট সিঁড়ি৷ কাড়ি কাড়ি টাকা কামানো যাবে৷ মাথা উঁচু করে সমাজে বাঁচা যাবে৷ গাড়ি-বাড়ি হবে৷ মানুষের দ্বারে দ্বারে ভিখেরির মতো হাত পাততে হবে না৷ ‘মুষ্টি চাল দিন, কোরবানির চামড়া দিন৷' বলতে হবে না৷ জাকাত-ফিতরার আশায় আশায় থেকে দিনরাত এক করতে হবে না৷ সমাজের অর্থশালীদের কটু কথা শুনতে হবে না৷ আরও কতো কি!

ব্যবসার জন্য চাই পুঁজি৷ কিন্তু তরুণের তো কোনো সম্বলই নেই৷ কোত্থেকে মিলবে এতো টাকা? সবেই তো সে এতিমখানা থেকে ‘মৌলবি' হয়ে বেরিয়েছে৷ মামু-খালুর হাতেপায়ে পড়ে৷ দাওয়াত করে৷ বিশাল ভোজের আয়োজন করে তাদের তুষ্টি হাসিলের জন্য৷ পেটপুরে খাওয়ায়৷ কিন্তু যখন সত্যটা উপলব্ধি করেন তারা, অমনিই চুপ্টি মেরে বসে থাকেন৷

টাকার কথা বললে অন্য প্রসঙ্গ তোলেন৷ ‘টাকা ছাড়া পৃথিবীর সব বিষয়ে কথা বলো৷ শুনতে তৈরি৷' ভাবখানা এমন দেখান৷ চারটে পেটে পড়েছে যে, কিছু একটা তো শুনতে হয়৷ তাই শুনবেন বলে যতোটুকুন শোনার ভান করেন৷

বেচারা তরুণ চোখে ঝাপসা দেখে৷ তার বড় হবার স্বপ্নপ্রদীপ ধীরে ধীরে নিভে যেতে চায়৷ এতো পয়সা খরচ করলো, লাভটা কি হলো? হীতে বিপরীত যেনো৷ স্বপ্নভঙ্গের দ্বিতীয় রাত পেরোয় নির্ঘুম কিংবা দ্বিধাসংশয়ে আগামীর চিন্তা-ভাবনায়৷

ফজরের আজান হয়৷ আলসেমি ভেঙে জাগে তরুণ৷ মুখ ভার কাজকম্মে আজকাল তার৷ বাড়িতে এলেই বিনা বেতনে ইমামতি করে গাঁয়ের মসজিদে৷ কিন্তু কণ্ঠস্বর বদলে যায় আজ৷ সালাম ফেরাবার পর ভার ভার বোধহয় খানিকটা৷ ভারী মিষ্টি কণ্ঠ ছেলেটির৷ তাই ফজরে ইমামতি করতে বলা হয়৷ অথচ কণ্ঠের সেই পুরোনো তেজ নেই আজ, মনে হয় মুসল্লিদের৷ সবসময় সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলে, কিন্তু কারোর প্রতি মুখ তুলেও তাকাচ্ছে না এখন৷ মাথা নিচু করে কী যেনো ভাবছে৷ সংক্ষিপ্ত মোনাজাত শেষ করে বাইরে বেরোবার প্রস্তুতি নেয়৷ অমনিই কে যেনো হাত রাখে তার কাঁধে৷ ঘাড় বাঁকিয়ে দেখে তরুণ৷ গাঁয়ের মোড়লের মুচকি হাসি নজরে পড়ে তার৷

‘কী? কিছু বলবেন, চাচা?'
‘হ, সেইরহমই তো ইচ্ছা৷'

দুজনেই ভেতরে গিয়ে বসে মসজিদের৷ ‘তোমার ব্যাপারে সব শুনলাম৷ টাকার জন্য এদিক-ওদিক হাত পাততেছো৷ পাইতেছো না৷ তবে আমি কই কি, তুমি গেরামের জমি জমার ব্যবসা করতে পারো৷ জমি জমার ব্যবসা যারা করে, তাগোরে সবাই অবিশ্বাস করে৷ দালাল কয়৷ কারণ ওরা তো ভালো মানুষ না, ছলচাতুরি করে৷ কিন্তু তুমি তো হুজুর মানুষ৷ তোমারে সবাই বিশ্বাস করবো৷ দালাল কইবো না৷ যহন খরিদ্দার জানতে পারবো, অমুক মওলানা সাব এই জমির ক্রয়বিক্রয়ে জড়িত, তহন তারা আগ্রহ কইরা আসবো৷ আস্থা রাখবো তোমার প্রতি৷ দুই তরফ থেইকাই লাভ পাইবা…৷'

টানা ঘণ্টা দুয়েক অর্থ কামাইয়ের সস্তা বয়ান ঝাড়ে মোড়ল৷ তরুণ তার আলোচনায় সায় দেয়৷ মোড়ল হজ, ওমরা, ট্রাভেল্সের বিষয়েও জানায়৷ বেচারা তরুণের ভালোলাগে তার সব কথা৷ চাঙা দিয়ে ওঠে সে৷ এইতো জীবনের ঘুরে দাঁড়াবার সময় এলো বুঝি, মনে মনে ভাবে৷ সিদ্ধান্ত নেয় হজ, ভুমিব্যবসা করে স্বাবলম্বী হবার৷ কিন্তু শেষাবধি কি সে খুঁজে পায় কোনো পথ সাফল্যের? জানা নেই৷ কারোর হয়তো বা জানা থাকতে পারে৷

এমনকরে কতো তরুণ স্বপ্ন দেখে রোজ৷ স্বপ্নভাঙার ব্যথায় কতোজন বা হারিয়ে যায় কালের অতলে৷ হারাম কিংবা অন্য পন্থা খোঁজে কেউ বা আবার৷ সফলতার মুখ ক'জনই বা দেখে?

কেবল তরুণই নয়, এমন স্বপ্ন দেখে সমাজের কতো কতো শ্রেণির মানুষ! কতোজনের কতো কর্ম ভাগ্যে জোটে৷ দ্বিধাসংশয়ের হাজারো দরোজা খোলে৷ কোনটা করবে কোনটা ছাড়বে, সিদ্ধান্তহীনতার দোলাচলে ভোগে৷

দুই.
গেলো বারের কথা৷ ইফতায় দর্স হচ্ছে আমাদের৷ টেবিলে ‘আল আশবাহ ওয়ান নাজায়ের' কিতাব৷ প্রথমখণ্ডের ১৪১ নম্বর পৃষ্ঠায় চলছে সবক৷ যেটি কিতাবের দ্বিতীয়নম্বর শিরোনাম ‘আল উমুরু বিমাকাসিদিহা'র অধীনে৷ ‘শরহু মুনিয়াতিল মুসল্লি'র সূত্রে তারাতিবের আলোচনা এটি৷ সালাতুল ইস্তিখারার ওপর হচ্ছে কথা৷

পড়াচ্ছেন আমাদের শ্রদ্ধেয় শায়খ হজরত মুফতি আদিল সাহেব৷ ইস্তিখারার নিয়ম বললেন তিনি৷ ইস্তিখারার দোয়া কারোর মনে আছে কিনা, পরীক্ষা করে নিলেন৷ তিনটে ছেলে গড়গড় করে বমি করলো একশ্বাসেই৷ হজরতের মালুমাতে আরও একটি পদ্ধতি রয়েছে ইস্তিখারার, জানালেন৷ যেটি হজরত তাঁর মুর্শিদ হজরত মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহি রহ. থেকে শিখেছেন৷ হজরত বললেন, ‘আমলকে লিয়ে ও তরিকা বহুত আসান হে৷' আমরা জানতে আগ্রহী হলাম৷ নড়েচড়ে বসলাম সবাই৷

হজরত ইস্তিখারার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বললেন আরও দরকারি কয়েকটি৷ মুখে মুচকি হাসির রেখা ছড়িয়ে বললেন, ‘গৌরসে সুনিয়ে৷' গৌরসে শোনার অপেক্ষায় আমরা৷

‘দুটো কাগজ নাও৷ একটির এক পিঠের শুরুতে লেখো—
يعتذرون إليكم إذا رجعتم إليهم، قل لا تعتذروا لن نؤمن لكم، قد نبأنا الله من أخباركم، وسيرى الله عملكم و رسوله ثم تردون إلى عٰلم الغيب و الشهادة فينبئكم بما كنتم تعملون
বাকি অংশ খালি রাখো৷ অপর পিঠের শেষাংশের কোণায় লেখো إفعل ৷ দ্বিতীয় কাগজটির এক পিঠের শুরুতে লেখো—
و قل اعملوا فسيرى الله عملكم و رسوله و المؤمنون ؛ و ستردون إلى عٰلم الغيب و الشهادة فينبئكم بما كنتم تعملون
অপর পিঠের শেষাংশে লেখো لا تفعل ৷ এরপর কাগজদুটো মুড়িয়ে গোল করে জলে ছেড়ে দাও৷ আর পড়তে থাকো—
و إذ قتلتم نفسا فادارأتم فيها، و الله مخرج ما كنتم تكتمون

যতোক্ষণ না দুটোর একটি কাগজ খুলে যায়, ততোক্ষণই পড়তে থাকো আয়াতটি৷ দু'তিন মিনিটের ভেতর যেকোনো একটি খুলে যাবে, ইনশাআল্লাহ৷

যেটি খুলে যাবে, সেটি তোলো৷ দেখো তার অপর পিঠে কী লেখা রয়েছে—إفعل না لا تفعل؟ ৷ ব্যস, সে অনুযায়ী আমল করো৷ বরকত হবে, ইনশাআল্লাহ৷ আমিও এসবের ওপর আমল করে উপকৃত হয়েছি৷' বিস্তারিত জানালেন হজরত৷ দ্বিধায় ভুগতে হবে না বললেন৷ ইস্তিখারার গুরুত্ব বোঝালেন খুব করে৷

দর্স শেষ হবার পথে ততোক্ষণে আমাদের৷ হজরত আরও দু'একটি কথা বলতে চেয়েছিলেন হয়তো বা৷ কিন্তু ঘণ্টা বেজে ওঠলো এরই মধ্যে৷ দর্স শেষ হলো কি হলো না, এই দ্বিধাসংশয়ের ঘোর থেকে বেরোলাম আমরাও৷ কারণ আজ যে শিখলাম আকাবিরের অভিজ্ঞতালব্ধ অভিনব এক কারিশমা৷

লেখক: শিক্ষার্থী, দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত

আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ