۞ ইলিয়াস মশহুদ
প্রথমবার হামহাম দর্শনে মুগ্ধ বন্ধু শামছুল হকের পীড়াপীড়ি। যে করেই হোক তাদের সফর সঙ্গী হতে হবে। কতবার না করেও পারলাম না। একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে রাজি হলাম।
৩০ অক্টোবর বৃহস্পতিবার। সেদিন ছিলো আমাদের মাদরাসার বার্ষিক হস্তলিপি ও ক্বেরাত প্রতিযোগিতা।শেষ হতে প্রায় তিনটে বেজে গেলো। একে একে সবাই প্রস্তুতি সেরে নিলাম। গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। শামছুল হককে দেখলাম- পান সুপারির পুটলি হাতে গাড়িতে উঠতে। একটু অবাকই হলাম বটে, আমরা পানখোরদের জন্য বেচারার পানপ্রীতি দেখে!
যা হোক, আমাদের ২২ জনের বিশাল কাফেলা আগে থেকেই ভাড়া করা দু’টি মাইক্রোবাসে করে মৌলভীবাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। পথে আসরের নামাজ হাজীগঞ্জ বাজারে ও মাগরিবের নামাজ ফেঞ্চুগঞ্জে আদায় করে বিরতিহীনভাবে ছুটে চললো আমাদের গাড়ি।
রাত পৌনে ন’টায় আমরা গিয়ে পৌঁছলাম কুলাউড়া উপজেলার আমতলা বাজারে। এখানে জামাতবদ্ধ হয়ে এশার ক্বসর নামাজ আদায় করে আবারো গাড়িতে চেঁপে বসা। এবার গন্তব্য আমাদেরই মেজবান, দীর্ঘদিনের সহপাঠী, বন্ধুবর নূর উদ্দীনদের বাড়িতে। সময়ের অভাবে অল্পক্ষণের জন্য তাদের বাড়িতে মেহমান হলাম।
ভারত সীমান্ত লাগোয়া নূর উদ্দীনদের বাড়ির উঠোন থেকে মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করলাম সীমান্তের কাঁটাতার এবং বিদ্যুৎ বাতির ঝলকানি। কাঁটাতার; আহ্! মনে হয়ে গেল তখন কিশোরী ফেলানীর ঝুলন্ত লাশের কথা।
স্বাস্থ্যবান টাইপ একটা নাস্তা শেষে বিদায় নিলাম নূর উদ্দীনদের বাড়ি থেকে। এবার আমাদের যেতে হবে আরেক সহপাঠী নূরুল ইসলাম খান’র বাড়ি। ওখানে হালকা নাস্তা সেরে রওয়ানা দিলাম কমলগঞ্জ ভানুগাছের উদ্দেশ্যে। রাত সাড়ে ১২ টায় গিয়ে উপস্থিত হলাম বাংলাদেশের প্রখ্যাত ক্বারী, আঞ্জুমানে তা’লীমুল কোরআন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, শায়খুল কুররা মাওলানা আলী আকবর সিদ্দিক রহ.'র বাড়িতে। ওখানেই আমাদের সহপাঠী মামুন মাছুমদের বাড়ি।
পূর্ব নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী মামুন মাছুমদের বাড়িতেই ভোজনপূর্বক রাত্রিযাপন করলাম। উল্লেখ্য, আমাদের ২২ জনের কাফেলার সাথে এতক্ষণে স্থানীয় আরো তিনজন সহপাঠী যোগ হয়েছেন। পরদিন শুক্রবার। ভোরে ফজরের নামাজ আদায় করে সরইবাড়ি গ্রাম কতক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখলাম।এদিকে শামছুল হক, মাছুমরা মিলে ইবাদ ভাইদের উঠোনেই চুলা করে খিচুড়ি পাকাচ্ছে! তারা এ কর্মটি করেছে স্রেফ আনন্দের জন্যে।
সকাল ৭টায় ভূনা খিচুড়ির সাথে ভূনা গোশত খেয়ে আমরা সদলবলে বেরিয়ে পড়লাম হামহামের উদ্দেশ্যে। সকাল ন’টা নাগাদ আমরা গিয়ে পৌঁছলাম কমলগঞ্জ ও কুরমা বনবিটের একেবারে শেষপ্রান্ত আধিবাসী পল্লী কলাবনপাড়া বা তৈলংবাড়িতে।
আকাশ ফাটা রোদ তখন মাথার উপর। গাড়ি থেকে নামতেই ওখানকার আধিবাসী শিশুরা আমাদের ঘিরে ধরলো। প্রতিটা শিশুর হাতেই কয়েকটা করে বাঁশের কঞ্চি বা লাঠি। ওদের যুদ্ধংদেহী ভাব দেখে প্রথমে তো ভয় পেয়ে গেছিলাম! অত:পর আমরা ২৫ জনে ২৫টি বাঁশের লাঠি কিনলাম। ওদিকে শামছুল হক স্থানীয় বাজি মণ্ডল নামে একজনকে আমাদের গাইড হিসেবে ঠিক করলো। কমলগঞ্জের একবারে শেষ গ্রামের নাম কলাবনপাড়া।
তৈলংবাড়ি নামেও জায়গাটি পরিচিত। বলতে গেলে এরপর থেকে আর কোনো জনবসতি নেই। আর এখান থেকেই শুরু হয় হামহাম যাওয়ার আসল অ্যাডভ্যাঞ্চার। আমরা ২৫ জনের বিশাল কাফেলা হাতে লাঠি, মাথায় রুমাল; যেনো একটা জিহাদী জযবা নিয়ে কোথাও যাচ্ছি। ভাগ্যিস, হুজি টাইপ কোনো জঙ্গি সংগঠনের চোখ পড়েনি এই জায়গার দিকে!
গাইডের অনুসৃত পথে আমরা এগিয়ে চলছি হামহামের উদ্দেশ্যে। চারদিকে ঘন বনজঙ্গল। মনজোড়ানো বিশালাকৃতির নাম না জানা কতশত গাছ। বিশেষকরে প্রচূর বাঁশবন। লা ওয়ারিশ হাজারো কলাগাছ। হরেক রকম পাখপাখালীর মন মাতানো গান। আমরা হাঁটছি। সবার মাঝে তখনো আনন্দের ছোঁয়া। ভাবছিলাম- জুম’আর নামাজ হামহাম থেকে ফিরে এসে কোনো লোকালয়ে পড়ে নিব। কিন্তু…।
কিছুক্ষণ উঁচু নিচু পাহাড় অতিক্রম করতেই আমাদের দৃষ্টিসীমায় পড়লো ঝুঁকিপূর্ণ বাশেঁর দীর্ঘ একটি সাঁকো। অনেকেই তখন সাহস হারা। তার মাঝে কেউ কেউ পাড়িও দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত সবাই পার হলাম। আবারো হাঁটছি…। এতক্ষণে পায়ে ধরতে শুরু করেছে। ঘণ্টাখানেক হাঁটছি মাত্র। সাথে করে নিয়ে যাওয়া পানি দিয়ে কেউ গলা ভিজাচ্ছেন, কেউবা মুখে পান দিয়ে অশান্ত দাঁতকে শান্ত করছেন। কেউ তো ফিরে আসার মনস্থ করলেন।
আসলে এরকম দূর্গম পাহাড়ি টিলা ট্রেকিংয়ের পূর্ব অভিজ্ঞতা কারোর নেই। সামান্য বিরতি নিয়ে বাজি বাবুর নির্দেশমত আবারো রওয়ানা দিলাম…।
পাহাড়ি গিরিপথ। কোথাও বেশ খাড়া কোথাও বেশ নিচু। এসব কণ্টকাকীর্ণ পথ মাড়িয়েই আমরা চলছি। কখনো উঠতে হচ্ছে, আবার কখনো নামতে হচ্ছে। প্রচণ্ড ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা। চারদিকে হরেক রকম পাখপাখালির কোলাহল। হাঁটছি আমরা। অশান্ত মনে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে যায় কখনো সখনো। জোর কদমে এগিয়ে চলছি। এভাবে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক গাইডের পিছনে হাঁটার পর বিরক্ত হয়ে এক সময় বাজি বাবুকে জিজ্ঞেস করলাম-
দাদা! আর কদ্দুর?
দাদা বললো, ঘণ্টাখানেক!
মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। সহপাঠীদের জোরাজুরীতে ধীর পায়ে আবারো চললাম। মিনিট চল্লিশেক হাঁটার পর শাঁ শাঁ শব্দ কানে আসলো। সবাই একযোগে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো- আল্লাহু আকবার! আল্লাহু আকবার!!
পথে পথে বেশ ক’বার ফটো সেশনও চললো। এবার আমাদের সামনে আবিস্কার করলাম- ছোট্ট একটি ঝিরিপথ। হাটুসমেত হিমশীতল পানিতে যেই না পা ফেললাম, মাথা পর্যন্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। এতক্ষণের ক্লান্তি নিমিশেই নিঃশেষ হয়ে এলো। এবার প্রায় বিশ মিনিট এগোতেই চোখে পড়লো আমাদের কাঙ্খিত স্পট হামহাম জলধার।
শাঁ শাঁ শব্দে ১৫০ ফুট উঁচু থেকে গড়িয়ে পড়া স্বচ্ছ পানি দেখে আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম। সবাই হাতমুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম নিলাম। হঠাৎ আমার পায়ে একটি জোঁকের অস্থিত্ব টের পেয়ে হাঁক দিয়ে উঠলাম। জোঁক অন্বেষণে এবার সবাই লেগে পড়লো। একে একে চারটি জোঁক আবিস্কার হলো দু’জোড়া পায়। এদিকে আলী, মিছবাহ, নদীম, গনী, হুসাইনরা জীবনের জুঁকি নিয়ে ঝরণার একেবারে উৎসস্থলে পৌঁছে গেলো। ছাকিব, তাজুল, শুয়াইবসহ তিন চারজন ছাড়া আমরাও সব উঠে গেলাম ১৫০ ফুট উঁচুতে।
ঝরণার উৎসস্থলে। ওখানে গিয়ে আবিস্কার করলাম আশ্চর্য এক কাণ্ড। উদোম গায়ে সবাই স্নান করছে। হৈ হুল্লোড়ে নিঃস্তব্ধ এই গহীন বনে শব্দের মোহনা বইয়ে দিচ্ছে। ছোট্টাকৃতির জলাশয়ে নেমে একে অপরকে পানি ছিটিয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করছে।
হঠাৎ একজনের উচ্চকণ্ঠে আওয়াজ- এ্যাঁই জোঁক, জোঁক! সবাই জোঁক চেকে ব্যস্ত। উপর থেকে পানি যে স্থান হয়ে গড়িয়ে পড়ছে, ওখানে সাত-আটজন আড়াঁআড়িভাবে শুয়ে পানির গতি কতক্ষণ আটকে রাখছে তো আবার ছেড়ে দিচ্ছে। কখনো বা উপর থেকে নিচে পানি ছোড়া হচ্ছে। সবাই গোছল করে যখন নিচে নেমে আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, ঠিক তখনই দেখলাম হুসাইন ভাইকে পূর্ব দিকে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতে!
তার দেখাদেখি আমরাও ক’জন নামাজের জন্য দাড়িয়ে গেলাম। আসলে ওটা মূলত: দক্ষিণ দিক ছিলো! নিচে এসে কয়েক গ্রুপে ভাগ হয়ে কাদাঁমাটির উপর রুমাল বিছিয়ে জামাতবদ্ধ হয়ে আমরা জুম’আর পরিবর্তে দু’রাকাত জোহরের ক্বসর নামাজ আদায় করলাম।
এবার ফেরার পালা। বিকাল তিনটে বেজে গেছে। তাড়া নিয়েই ফিরছি আমরা। ফেরার পথে বেশ কয়েকটি পর্যটক গ্রুপকে অতিক্রম করলাম। পেটে প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে। আশপাশের কোথাও খাবারের কোনো সু ব্যবস্থা নেই। ক্ষুধা নিয়েই আমরা গাড়িতে চেঁপে বসলাম।
সফর সিডিউলে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, ৭১’র বধ্যভূমি, চা গবেষণা কেন্দ্র ইত্যাদি দর্শনীয় স্থান সমূহ দেখার কথা থাকলেও ক্লান্তি এবং সময়ের অভাবে আর যাওয়া হয়নি। সোজা চলে আসলাম শ্রীমঙ্গল চিড়িয়াখানায়। চিড়িয়াখানা থেকে ফিরে এসে শ্রীমঙ্গল শহরে খাবার পর্ব সেরে নিলাম সবাই। স্থানীয় সহপাঠীরা বিদায় নিলো আমাদের থেকে। আমরাও বিদায় নিলাম তাদের থেকে। ছুটলাম আপন গন্তব্য্যে। দু’দিনের এই সফর স্মৃতিময় হয়ে থাকবে।
E-mail: eliasmoshud71@gmail.com
আরআর