মুফতী আহমাদ শাওকি আলআযহারী
প্রাচীন সভ্যতা ও ইসলামি নিদর্শনের জন্য বিখ্যাত মিশর। এখানে আছে বিখ্যাত নীলনদ, পৃথিবীর সপ্তাশ্চার্যের পিরামিড, ফিরাউনের মৃতদেহ, কারুনের ধ্বংসাবশেষ, তূর পাহাড়, লৌহিত সাগর, প্রাচীন ফারাও রাজা বাদশাহদের প্রত্নতত্ত্ব ও প্রতিমার সম্ভার। আছে প্রাচীন সভ্যতা ও বিভিন্ন নবী রাসুলদের সংশ্লিষ্ট নানান নিদর্শন। এছাড়াও রয়েছে হাজার বছরের প্রাচীন ও বিশ্ববিখ্যাত ইসলামি বিদ্যাপীঠ কায়রোর আলআযহার বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রায় দুবছর হল মিশরে আসা হয়েছে। তবে এখনো ফিরাউনের লাশটি নাকি দেখা হয়নি আমার। এটা বলতেই যেন কেমন শোনা যায়। যে ফিরাউনের সম্পর্কে মানুষের কৌতূহলের ইয়ত্তা নেই অথচ আমি মিশরে থাকা সত্বেও সেটি দেখিনি এর চেয়ে হতভাগা আর কে আছে। আসলে পডাশোনার চাপ ও বিবিধ ব্যস্ততার কারণে এতদিন সময় পাইনি। তাছাডা কোনকিছু কারো জন্য সহজলভ্য হলে সেটা দামি হলেও তার কাছে গুরুত্ব একটু কমই থাকে।
গত বছরের ৭ রমজানে গেলাম মিশরের জাতীয় যাদুঘরে। উদ্দেশ্য- ফিরাউনের লাশটি দেখবো। যাদুঘরটি আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢের দূরে নয়। মোটামোটি কাছেই। নীলনদের তীরে মিশরের কায়রোর তাহরীর স্কয়ারে অবস্থিত মিশরের জাতীয় যাদুঘর। তবে আমার সাথে বাংলাদেশি এক ব্যবসায়ীও যেতে বায়না ধরলো। কারণ তার ভিসা নেই। একা কখনো আর তার দেখা নাও হতে পারে।
মিশরে সাধারণত ছাত্র ও ছাত্রদের অভিভাবক ছাড়া অন্যদের ভিসা নেই। যথারীতি আমরা দুজন যাদুঘরের সামনে এলাম। যেমন আশঙ্কায় ছিলাম তেমনটিই ঘটল। আমার সাথে যে ব্যবসায়ী ছিল তার ভিসা না থাকায় পুলিশ তাকে আটকে বিবিধ প্রশ্নের সম্মুখীন করলো। এক পর্যায়য়ে তাকে পুলিশ গ্রেফতার করার উপক্রম হলে আমি ভয়ে হতচকিত হলাম। তবে এ যাত্রায় আল্লাহ আমাদের বাচিয়েছেন। আমি আমার আযহারের স্টুডেন্টশিপ কার্ড দেখালে পুলিশ উভয়কে আর না ঘাটিয়ে ছেড়ে দেয়। মনের আনন্দে আমরা যাদুঘরে প্রবেশ করলাম।
আমি আযহারের ছাত্র, এ কারণে টিকিট হাফ। আমার কাছে নেয়া হলো ৩৫ পাউন্ড। ব্যবসায়ী ব্যক্তিটির কাছে রাখল সত্তর পাউন্ড। যাদুঘরটি খুব নিরাপত্তা বলয়ে বেষ্টিত। আর ফিরাউনের লাশটিতো পুরো নিরাপত্তার চাদরে আচ্ছাদিত।
নিরাপত্তার নানা বেডাজাল পেরিয়ে অবশেষে আমরা ফেরাউনের লাশেরর কাছাকাছি চলে এলাম। সেখানে আবার আরেক ঝক্কি। লাশ দেখার জন্য ৭০ ও ১০০ পাউন্ড করে দিতে হলো। এরপর ঢুকলাম ফেরাউনের লাশ সংরক্ষিত কামরায়। বুকে অজানা এক ধাক্কা খেল। ঢোকার পর অবশ্যই সেই ভয় কেটে গেছে। কারণ আমার মত আরো নানা দেশের শতশত মানুষ লাশ দেখছে।
স্বচ্ছ কাঁচের ভেতরে সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে লাশটি। আমাদের সমাজে ফিরাউনের ব্যাপারে নানান কল্পকাহিনী প্রচলিত আছে। আমরা বেশ সময় নিয়ে ফিরাউনের লাশটি দেখলাম। মনে হল লম্বায় সাত থেকে আট ফিট হবে। মুখ প্রায় পুরোটাই বিকৃত হয়ে গেছে। নিথর দেহ।চোখগুলোও পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। চুলগুলো অবশ্য অনেকটা ভালো আছে। দী্র্ঘদেহে একধরনের কাপড় পেচিয়ে রাখা হয়েছে সেটাও মনে হয় অনেক পুরানো।বেষ্টিত কাচের উপর নাম লেখা। দ্বিতীয় রমসিস।
ফিরাউন ছিল মিশরের বাদশাহদের উপাধি আর মুসা আ. এর যুগের ফিরাউনের নাম ছিল দ্বিতীয় রমসিস। জীর্ণ শীর্ণ দেহে এখন মেডিসিন দিয়ে রাখা হয়েছে নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে। কারণ এটি দিয়ে মিশর সরকার কোটি কোটি বিলিয়ন ডলার আয় করছে। প্রতিদিন প্রায় বিশ থেকে ত্রিশ হাজারের মত পর্যটক লাশ দেখতে আসে। আর প্রত্যেক দর্শনার্থী থেকে তারা নিচ্ছে প্রায় দুই হাজার টাকা।
কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী ফিরাউনের লাশ মেডিসিন ছাড়াই সংরক্ষিত থাকবে কিয়ামত অবধি। মানুষের শিক্ষাগ্রহণের জন্য।
ভেতরে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেদ করে তেমন কিছু আর করা যায়নি। ছবি উঠানো একেবারেই নিষেধ। প্রতিটি দর্শনার্থীই চেস্টা করছে ছবি উঠাতে। কিন্তু এটা কোনভাবেই সম্ভব নয়। কারণ অন্যকক্ষ থেকে সিসি কেমারায় সবকিছু পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তবে এর ব্যত্যয়ও অনেক সময় ঘটে।
ফেরাউনের লাশের আশেপাশে প্রাচীন রাজা বাদশাহদের আরো কয়েকটি লাশ আছে। সেগুলোও দেখলাম। সবগুলো একই পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা। দীর্ঘ এক ঘন্টা পর আমরা বেরিয়ে এলাম। মনে হলো কী যেন একটা শূন্যতা পূরণ হলো।
লেখক: শিক্ষার্থী আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়