আবু শরীফ মাহমুদ খান
মহাগ্রন্থ আল কোরআন ও হাদিসে নববি থেকে জানা যায়, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পথভোলা নাফরমান কাফেরদের মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ির জন্য বিভিন্ন সময় নানা প্রকার আজাব, গজব ও মহামারী দ্বারা পৃথিবীর মানুষকে শাস্তি দিতেন। বর্তমান অধুনিক বিশ্বেও মানুষ আল্লাহর নাফারমানি ও ব্যভিচারে লিপ্ত রয়েছে। তাই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গজবের কথা আমরা শুনে থাকি।
সম্প্রতি এইডস নামক রোগ বিশ্বজুড়ে এক মহামারী হিসেবে দেখা দিয়েছে। এইচআইভি নামের জীবাণুর আক্রমণে এইডস হয়ে থাকে। এটি এমন এক ঘাতক ব্যাধি, যাতে শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। এইডস আক্রান্ত মানুষ বিভিন্ন রোগে ধুঁকে ধুঁকে মারা যায়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এইডস রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ দেশের জন্যও এইডসের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন পর্যন্ত এইডস রোগের কোনো ফলপ্রসূ চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি। কাজেই এ রোগ হলে মৃত্যু অনিবার্য।
প্রত্যেক ধর্মই ব্যভিচার ও বেহায়াপনার বিরোধী। বিশ্ব শান্তির একমাত্র বিধান শান্তির ধর্ম ইসলামে যাবতীয় বেহায়াপনা, বেলেল্লাপনা, জেনা, ব্যভিচার ও নারী-পুরুষের অবৈধ সম্পর্ককে হারাম করেছে। সুতরাং ইসলাম ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষার মাধ্যমে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি ও ইসলামের বিধিবিধান কঠোরভাবে মেনে চললে এইডস প্রতিরোধ করা সম্ভব। প্রতিষেধকহীন এ ব্যাধিকে কেবল ধর্মীয় অনুশাসনই রুখতে পারে।
এইচআইভি/এইডস অনেক জটিল রোগ। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এইডস আক্রান্ত হওয়ার যেসব কারণ উল্লেখ করা হয়েছে তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ব্যভিচার নামের সামাজিক অনাচারই এইডসের জন্য দায়ী। পক্ষান্তরে অশ্লীলতা ও অনৈতিকতা থেকে দূরে থাকাই মরণঘাতী এইডস থেকে মুক্তির সর্বশ্রেষ্ঠ পথ। অবৈধ যৌনাচার ও ব্যভিচারকে মহামারীর কারণ হিসেবে উল্লেখ করে হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘যখন কোনো জাতির মধ্যে অশ্লীলতা প্রকাশ্যভাবে চলতে থাকে, তখন তাদের মধ্যে প্লেগ ও এমন অভিনব দুরারোগ্য ব্যাধি দেয়া হয়, যা তাদের পূর্বপুরুষরা কখনো শোনেনি।’ (দায়লামি)
নবী করিম (সা.) আরো বলেছেন, ‘যখনই কোনো জাতি বা সম্প্রদায় অশ্লীল ও ঘৃণ্য কাজে লিপ্ত হয়, তখন তাদের মধ্যে এমন এক ভয়ঙ্কর মহামারী দেখা দেয়, যা তারা অতীতে কখনো দেখেনি।’ (ইবনে মাজা)
ইসলাম বহু শতাব্দী আগে থেকে ব্যভিচারের কদর্যতা ও নোংরামির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে রেখেছে; এটিকে হীন ও মন্দকর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করেছে এবং মানব সভ্যতার জন্য বড় ধরনের হুমকি সাব্যস্ত করেছে। যেসব কারণে এইচআইভি ভাইরাস ছড়ায়, এর প্রায় সবগুলোকে ইসলাম আজ থেকে প্রায় ১৪০০ বছর আগে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। নারী-পুরুষের অবাধ যৌনাচার শুধু চরম অশ্লীলতাই নয়, যাবতীয় অন্যায় ও কুকর্মের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। অবাধ যৌনমিলন ও ব্যভিচার পারিবারিক বন্ধনকে বিনষ্ট করে এবং সামাজিক জীবনকে বিষময় করে তোলে; তাই ব্যভিচারের মতো বিবাহবহির্ভূত যৌনাচার শুধু পরিত্যাগ করাই উচিত নয়, বরং এর সংস্রব ও কামনা-বাসনা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বলেছেন, ‘আর তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তীও হয়ো না, নিশ্চয়ই এটি অশ্লীল কাজ ও নিকৃষ্ট আচরণ।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত-৩২)
[caption id="attachment_19687" align="alignright" width="500"] কুইজে অংশ নিতে ফেসবুক পেইজে আসুন [/caption]
ইসলাম ব্যভিচারের অনৈতিক পথ চিরতরে বন্ধ করে পৃথিবীতে সুস্থ-সুন্দর বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে দাম্পত্য জীবনযাপনে সমর্থ মানুষকে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে। বৈধ স্ত্রী ব্যতীত অন্য নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের কারণেই এইডসের মতো প্রাণসংহারী ব্যাধির জন্ম হয়। কেননা এইডস রোগের ভাইরাস বহনকারী আক্রান্ত পুরুষের মাধ্যমে নিজেদের অজ্ঞতার কারণে নারীও এইচআইভি পজিটিভ হয়ে যায়। অথচ বিবাহিত নারী-পুরুষের মিলনে এইডসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই, যদি তাদের কেউ বিপথগামী না হয়। বৈবাহিক সম্পর্ক বহুগামিতার মূলে কুঠারাঘাত হেনেছে। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যাদের সামর্থ্য আছে, তারা যেন বিবাহ করে, কারণ বিবাহ পবিত্রতা রক্ষার এবং দৃষ্টিকে সংযত রাখতে সাহায্য করে। অপরদিকে যাদের সামর্থ্য নেই, তারা যেন রোজা রাখে। কারণ রোজা যৌনক্ষুধা সংবরণে সহায়ক।’ (বুখারি ও মুসলিম)
যারা অবৈধ যৌনাচার, সমকামিতা, অনৈতিকতা, অশ্লীলতা ও ঘৃণ্য কাজে জড়িত, তাদের কঠোর শাস্তির ভীতি প্রদর্শন করে আল্লাহ তাআলা সাবধানবাণী ঘোষণা করেছেন, ‘আমি লুতকে প্রেরণ করেছিলাম, যখন সে তার জাতিকে বলেছিল : তোমরা কী এমন অশ্লীল কাজ করছো, যা তোমাদের আগে সারা বিশ্বে কেউ করেনি? তোমরা তো কামবশত নারীদের ছেড়ে পুরুষের কাছে গমন করো, তোমরা তো সীমা লঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়।’ (সুরা আল-আরাফ, আয়াত : ৮০-৮১)
এইডসের মতো স্পর্শকাতর বিষয় প্রতিরোধে গণমাধ্যমের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। ইসলামের শিক্ষা বাস্তবায়নে পবিত্র কোরআনের সতর্কবাণীকে বিভিন্ন গণমাধ্যম তথা রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রচার-প্রসার করে সচেতনতা সৃষ্টিতে এগিয়ে যেতে হবে। এইডস বিস্তারে বয়সের কোনো বাছবিচার নেই। বিপথগামী মাদকাসক্ত তরুণ-তরুণী থেকে যেকোনো বয়সের ব্যক্তি এ মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারে। দেশের সব নাগরিক এইডস সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে এবং তা কাজে লাগিয়ে নতুন প্রজন্মের মধ্যে এইচআইভির বিস্তার রোধে সাহায্য করতে পারে। এইডস শুধু স্বাস্থ্যজনিত সমস্যাই সৃষ্টি করে না, বরং এটা ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রকেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এইচআইভি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকলে এইডস প্রতিরোধ করা যাবে না। এইডস প্রতিরোধে নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। একমাত্র নৈতিকতার অনুশীলনই হতে পারে এ রোগ প্রতিরোধের প্রধানতম হাতিয়ার।
নৈতিকতার অনুশীলন ও ধর্মীয় অনুশাসন যে সমাজে যত প্রবল, এইডস আক্রমণ সেখানে তত কম। বিভিন্ন ধর্মের ঐক্যবদ্ধ চেতনা থেকে একটি সুন্দর ও সুনির্মল পথ তৈরি হতে পারে; যা এইচআইভি/এইডসের মতো ব্যাধিকে রুখে দিয়ে জাতির জন্য সুন্দর একটি ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ করবে। এইচআইভি সমস্যাকে প্রত্যেকের নিজ নিজ কাঁধে তুলে নিতে হবে, নিজেকে সচেতন রাখার পাশাপাশি অন্যকেও সচেতন করতে হবে। তাই সমাজে ইসলামী অনুশাসন মেনে এইডস-সচেতনতা বৃদ্ধির সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ একান্ত বাঞ্ছনীয়।