আমাদের দেশীয় নতুন ছেলেরা ঘরে ফিরেছে ঈদের দশ-পনেরো দিন আগেই। বিমান, ট্রেনের টিকেট কেটে ওদের যাবার পুরো বন্দোবস্ত করলাম আমরা পুরোনো বন্ধুরা। এক এক করে সবাই চলে গেলো আমাদের ছেড়ে। ফাঁকা হয়ে গেলো দারে জাদিদ, দারুল কোরআন, রোয়াকে খালিদ, শাইখুল ইসলাম মঞ্জিল, শাইখুল হিন্দ মঞ্জিল। মসজিদে রশিদে আজান হয়; আজান হয় মসজিদে কদিমে, সাত্তায় এখনও। কিন্তু নেই জামাতে সেই দলবেঁধে মুসল্লিদের শরিক হবার দৃশ্য। নেই সেই হাজারো শিক্ষার্থীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জমায়েতের অপূর্ব মোহনা। বাবে কাসিম, বাবে মাদানি এখন পুরোই ফাঁকা।
দারুল উলুমের ঐতিহাসিক দাওরায়ে হাদিসের লাল বিল্ডিংটি একলা হাসে। দেখবার মুগ্ধ দর্শক নেই কেউ। নওদারার গলিপথে আর কোনো ছাত্রের দেখা মিলছে না দপ্তরি কাজের প্রতীক্ষায়। এহাতায়ে মুলসুরিতে নবীজির পান করানো শীতল জল-কূপ আর এখন ব্যস্ত নয়। একদম শান্ত, নীরব৷ ইচ্ছেমতোন গ্লাস-গ্লাস সাবাড় করা যায় পেটপুরে।
কাসেমি কবরস্তানে এখন আর সারিবদ্ধ ফাতিহার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। কাউকে দেখছি না আর মাজারে আনওয়ারির সামনে হজরত কাশ্মিরি রহ. কে মধুময় সালাম দিতে। কারিম চিকেন, মায়াজ হোটেল ছুটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নোটিশ জারি করে দিয়েছে। খাবার রান্না করে স্টক সীমিত টাইপ পরিমাণে। নেই আগের সেই হরদম কাস্টমারের ঠেলাঠেলি।
ঘরে ফেরেনি যারা, তাদের অনেকেই কামরায় দিন পার করে শুয়ে, বসে। কেউ বা ঘুরতে বেড়িয়েছে এদিক, ওদিক। দিল্লির লাল কেল্লা, পুরোনো কেল্লা, হুমায়ুঁ কা মাকবারা, গালিব একাডেমি, কুতুব মিনার, শের শাহ কা মাকবারা; আগ্রার তাজমহল, লালকেল্লা, আকবর ফোর্ট, ফতেহপুর সিক্রি; হিমাচলের সিমলা, মানালি; রাজিস্তানের আজমির, জয়পুর, যোধপুর, রেগিস্তান চষে বেড়াচ্ছে এখনও। শিক্ষা নিচ্ছে দেখে দেখে৷ কেউ বা ছুটেছে কাশ্মির, দার্জিলিং, গোয়া, কলকাতা, মেঘালয় ও মুম্বাই নগরীর পথে।
ছুটি কাটাতে কেউ বা ধরেছে কুতুববিনি। আরবি, বাংলা, উর্দু, হিন্দি, মারাঠি, গুজরাতি ভাষার গল্প, উপন্যাসে গড়াচ্ছে সময়। এভাবেই এক এক করে কেটে গেছে ঈদের পূর্ব বেশ ক'টা দিন।
ঘরে না ফেরার বেদনায় গত হয়েছে ঈদ পূর্ব দুদিন। অতি কাছের বন্ধুদের অনেকেই ফিরে গেছে মায়ের কোলে। ট্রেনে চড়িয়ে ওদের বিদেয় জানিয়ে চোখের জল মুছেছি নীরবে নীরবে। কামরার দরোজা বন্ধ করে হাউমাউ করে কেঁদেছি সবাইকে ছেড়ে ঈদ করবার কথা ভেবে ভেবে। সেই কাঙ্খিত ঈদের দিনটি ছিলো গতকাল। কিন্তু দহনের কাব্যখাতা যেনো উবে গেলো গতকালের সেই ভোর হতেই। ফজরের নামাজ বাদে আর চোখে আসেনি ঘুম। তড়িঘড়ি গোসল সেরে হৈচৈ করে বেড়িয়েছি দেওবন্দি বাচ্চাকাচ্চাদের সঙ্গে।
মনটা ছিলো বড় উৎফুল্ল। ঈদগাহে নামাজ আদায় করে মসজিদে রশিদের কামরায় ফিরলাম ন'টার দিকে৷ ফিরনি, সেমাই রান্না করে রেখেছিলো এক সাথী৷ খাবো। কিন্তু দেখি সবাই দৌড়োচ্ছে মাজবাহের দিকে। আমিও পিছু নিলাম সবার মতোন হৈহুল্লোড় করে। বিশাল বড় লাইন দেখলাম রোয়াকে খালিদের পেছনে। সবার মতো আমরা তিনজনও দাঁড়ালাম দীর্ঘ সারিতে৷ টানা ঘণ্টা দেড়েক বাদে হুড়হুড় করে সবাই ঢুকে গেলো ভেতরে। আইডি চেক করে করে ঢুকোবার কথা ছিলো। কিন্তু কে কার আইডি চেক করে! আল্লাহু আকবার বলে দাও ঠেলা। এক ঠেলায় সবাই মাজবাহের পগারপার।
ওয়াক্ফসহ দেওবন্দের অন্যান্য মাদরাসার ছেলেরা নিয়ে গেলো গোটা কয়েক রান। দারুল উলুমের বেশ ক'জন শিক্ষার্থীদের তখনও জোটেনি এক টুকরোও গোশত।
আমি তিনজনের একটা দল গঠন করলাম। সবাই মিলে একসঙ্গে কোরবানির গোশত রান্না করবার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু আমাদের তিনজনের কারোরই কাড়াকাড়ি করবার আদত নেই আগ থেকেই। বলদের মতোন হা করে দাঁড়িয়ে রইলাম তাই ভদ্রস্টাইলে। ফল যা হবার, তাই হলো!
প্রথমবারে গোশত না পেয়ে অপেক্ষায় রইলাম দ্বিতীয় দফার৷ ঘণ্টা চারেক বাদে খান তিনেক রান নিয়ে নিলাম কাঁধে। অপর সাথী নিলো তিনটে মহিষের বুকের গোশত। খানিকটা পথ হেঁটেই তো আমার হালত যায় যায়। কাঁধ ব্যথা হয়ে ভেঙে পড়ার উপক্রম হলো। মসজিদে সাত্তা থেকে শীতল জল পান করলাম কয়েক অঞ্জলি৷ ফের আরম্ভ আবার কামরার দিকে দে ছুটের। পথে দেওবন্দি আমলোক আমায় দেখে মুচকি হেসে বললো—‘মর্দে মুজাহিদ হো তুম৷' আর আমার উচ্ছ্বাস তো সেই দেখার মতোন ছিলো।
ঘরবাড়ি ছেড়ে এখানে থাকলেও আনন্দটা কিন্তু আমাদের কম নয়। দারুল উলুম দেওবন্দ আমাদের মুখে হাসি ফোটায় সবসময়। গোশত কেটে ভূনো করেছি কয়েক কেজি৷ ইচ্ছেমতোন খেলাম মনের সুখে৷ বিপাকে পড়েছি বেশি গোশত নিয়ে৷ দুজন ভিখেরিকে দিয়েছি মহিষের দুটো বুক, একটি রান।
বেশ আনন্দে কাটছে এবারের কোরবানি ঈদ৷ প্রবাসে থাকলেও অনুভূত হচ্ছে না একলা আমি৷ সবই বিশ্বখ্যাত আমাদের প্রাণের কানন দারুল উলুম দেওবন্দের ক্রেডিট৷ গতকাল কাটা হয়েছে দুশোর মতো মহিষ৷ আজ আর কাল কাটা হবে আরও চারশোর মতো৷ যে যতো পারে, নিতে পারে নিঃসঙ্কোচে৷ ইচ্ছেমতোন দেখে দেখে মহিষের রান, বুক, পা নিতে পারে কোরবানির এই তিনটে দিনেই৷ আসাম, বিহার, মনিপুরার ছেলেদের এক একজনেই নিয়েছে দু'তিনটে মহিষের গোশত৷ আসামের একজনকে জিগ্গেস করলাম—‘এতো গোশত দিয়ে কী করবে বন্ধু?'
ওর মুখে ছিলো পান৷ পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললো—‘খিতা আর খরুম! বাড়িত ফাডাইমু৷ আর খাইমু৷'
ওর ‘খাইমু' শব্দের ‘খ'-য়ের উচ্চারণে আমার চেহারায় পানের লাল থুক দাগ বসিয়ে দিলো৷ চুপ রইলাম। আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না৷ আমাদের কামরা এখন মহিষের গোশতমুখর৷ বাঙালি, আফগানি, আরবি বেশ ক'জন বন্ধুকে দাওয়াত করেছি৷ মহিষ বিরিয়ানি, মহিষের টিকা কাবাব, মহিষ ভূনো, মহিষের আচারি, মহিষের কিমা, মহিষের নেহারি, মহিষের হিন্দুস্তানি কাবাব বানাচ্ছি গতকাল ধরেই৷
বাড়ির কথা আর মনে পড়ছে না এখন৷ বন্ধুরা মিলে ব্যস্ত রয়েছি খানা রান্নায়, গল্পগুজবে৷ আড্ডাবাজ হয়ে উঠছি সময়ের তালে তালে৷ গতকাল রাতে ঘুমোবার আগে দেখি মায়ের কল৷ ব্যাক করে শোনালাম পুরো দিনের কাহিনি৷ মা আমার কাণ্ডকারখানা জেনে বেশ হাসলেন৷ খুশি হলেন খুব৷ বললেন—‘এতোসব রান্না করলি কী করে? তুই রান্না করতে জানিস?' বললাম—‘বাড়ি এসে তোমায় রান্না করে খাওয়াবো৷' মা বললেন-‘দরকার নেই তার৷ আমি চাই শুধু সত্যিকারের মানুষ হয়ে আমার সোনা আমার কোলে ফিরে আসুক৷'
মানুষ হবার জন্যই তো এতোটা পথ হাঁটা৷ জীবনের সব সুখ জলাঞ্জলি দিয়ে পরবাসী হওয়া৷ ঈদ নামক সুখের ভেলায় কৃত্রিম হাসির রেখা টানা৷ তবুও কেমন যেনো এক আনন্দ অনুভূত হয়৷ কী যেনো এক সুখচাদর লেপ্টে থাকে দেহাবয়বে— একদিন আসবেই সেই সুদিন, এতোটা বিসর্জন আর ত্যাগের ফলে ইনশাআল্লাহ৷
লেখক : শিক্ষার্থী; দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত
এফএফ