বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ২৮ কার্তিক ১৪৩১ ।। ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


ভারতে হজরত সাবেরি'র দরবারে কিছুক্ষণ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
>
ঢোল-বাদ্যের উচ্চ আওয়াজ হচ্ছে ভেতর বারান্দায়৷ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে গেট থেকেই৷ ঐ তো ‘ভর দো জলি ইয়া মুহাম্মদ' ভেদ করছে কানের পর্দা৷ এগোলাম ভিড়ভাট্টা ঠেলে৷
দ্বিতীয় দফায় আজ এলাম এই দরগাহে৷ দরগাহটি হজরত সাবেরি কালিয়ারি রহ. এর৷ পুরো নাম পীর আলাউদ্দিন সাবেরি কালিয়ারি৷ চিশতিয়া তরিকার বড় পীরদের একজন তিনি৷ ভারতের উত্তরাখাণ্ড প্রদেশের প্রসিদ্ধ এই কালিয়ার এলাকায়ই তাঁর জীবন কাটতো৷
saberi1
অতি ভয়ে ভয়ে পকেট থেকে বের করলাম মোবাইলটি৷ ছবি তুলবার ইচ্ছেয় যেই পজিশন নিলাম, অমনিই এক পুলিশ কঠোর স্বরে বারণ করলো আমায়৷ মোবাইল ভেঙে ফেলবার হুমকি দিলো চোখ রাঙিয়ে৷ যথেষ্ট শান্ত বাছাধন বনে গেলাম মুহূর্তেই৷দেওবন্দিদের বিরুদ্ধে তখনই কমপ্লেন করে বসলো পাশের একজন৷ জানতে চাইলো আমি দেওবন্দি কিনা! বললাম—‘নেহি, কাসেমি হু৷'

যারা দেওবন্দি, তারাই কাসেমি— খবরটি হয়তো লোকটির নলেজে নেই৷ একজনে আমায় হাতের ইশারায় বসতে বললো৷ হয়তোবা ভেবে নিয়েছে তাদেরই আকিদার কেউ৷

মাজার, কবর, পীর, আউলিয়া মানে না দেওবন্দিরা৷ বুড়ো মতোন এক দাড়িহীন লোক বোঝাতে লাগলো আমায়৷ আমিও মুনাফিকের কায়দায় তাল মেলালাম তার বয়ানে৷ মুহতারামের তাকরির বাদ জানতে চাইলাম—‘এতনি গরমি মে এয়সা কারণে সে কিয়া ফায়দা মিলেগা?' মুচকি হেসে লোকটি আমায় বোঝালো হজরত সাবেরির বরকতের কথা৷ কবরে বসেও প্রতিদিন হাজারো লোকের হাজত পূরণ (?) করবার বিষয়৷ তাজ্জব বনে গেলাম৷ চোখ কপালে তুলে উঠে দাঁড়াবার কোশেশ করলাম৷ ততোক্ষণে লোকটি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে আরেকজনকে হেদায়াত (?) দেয়ায়৷

সামনের ঢোলের তালে তালে নাচছে একদল তরুণী৷ মাথার কেশরাজি লম্বা তাদের৷ পরনে সেলোয়ার-কামিজ৷ পেট, পিঠ, বুক— সবই বাবা ও তার আশেকানের জন্য উৎসর্গিত৷ লোকে দেখে৷ লাফিয়ে ওঠে জোশে৷ আমিও ওঠলাম লাফিয়ে৷ মাজারের পুরোটা দেখবার ইচ্ছেয় হাঁটা ধরলাম সামনে৷

বকুলের দুটো বিশাল গাছ নজরে পড়লো আমার৷ পত্রপল্লব সজ্জিত যার হাজার কয়েক পত্রমিতালিতে৷ দু'চারটে মেলে ধরলাম চোখের তারায়৷ পড়তে চেষ্টা করলাম বার কয়েক৷ পড়া গেলো না তবু৷ আরেকটু কাছে এগিয়ে দেখলাম উর্দু, হিন্দি, পাঞ্জাবি, মারাঠি, ইংরেজি ভাষায় লেখা দরখাস্ত, আবেদনপত্র৷ কোনোটায় অভিলাসী প্রেমের কথামালা, কোনোটায় বা যাবতীয় সমস্যা নিরসনে প্রার্থনা কামনা৷

আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে খোদা বলে মানি না৷ মুখে এরাও স্বীকার করে বলে জানালো এক ভদ্রলোক৷ কিন্তু চাওয়ার বেলায় ‘ইয়া সাবেরি, ইয়া কালিয়ারি!' বলে চিৎকার করে৷ শরিক করে আল্লাহর সঙ্গে৷ এ কেমন আচরণ আপন রবের সঙ্গে তাদের?

ভাবতে ভাবতে রোদ্দুর এসে গা ঢাকা দিলো আমার৷ গরমে ঘামতে লাগলাম প্রচণ্ড৷ তবু মাজার শরিফের পবিত্র (?) খেলা দেখতে বেশ আনন্দই লাগছিলো যেনো৷ ক'জন উঠতি কিশোরীকে দেখলাম গড়াগড়ি খাচ্ছে মাজারের চারপাশে৷ মুখে আওড়িয়েই যাচ্ছে—‘ইয়া সাবের, তেরে লিয়ে সব ফিদা হ্যায় মেরা৷'

কে কার জন্য ফিদা, সে হয়তো আমার জানা নেই৷ তবে গরমের তীব্রতায় একটু ছাউনির নিচে বিশ্রাম নিতে এলেই জানতে পারি আরেক কাহিনি৷ দেখা হয় সাহারানপুর মাজাহিরে উলুম থেকে আসা আমাদের এক জাতি ভাইয়ের সঙ্গে৷ বেচারা দেওবন্দি টুপি ছেড়ে পরেছেন বেরেলবি কিশতি৷ মাজারে ঢোকার স্বার্থে বেশভূষায় এনেছেন যথেষ্ট বদল৷

কথায় কথায় ভাইয়াটি আমায় জানালেন এই তরুণীদের আসল হাল-হাকিকত৷ রাতে পতিতা কর্ম, দিনে মদ-গাঁজা খাইয়ে মাতাল করে রাখা হয় এদের৷ অর্থ কামাইয়ের বড় মার্কাজ এই পাক (?) দরবার শরিফ৷ প্রতি রাতে কতো বোতল, আর কতো নারীর ইজ্জতের ফালুদা হয়, তার গণনা কার আছে!

আমাদের আলাপে আলাপে গড়ালো বেশ সময়৷ ততোক্ষণে মাজারের মাইক বেজে ওঠলো হঠাৎ বৃষ্টির মতোন৷ এলান হলো—‘বেরেলবি হজরাত আ রাহে হে৷ আপ লোগ মোনাজাত কে লিয়ে তৈয়ার হো জায়ে৷'

একঝাঁক ফেরেশতা (?) বেশে আলেম (?) পাখিকে হাজির হতে দেখা গেলো মুহূর্তের মধ্যেই৷ পরনে যাদের খয়েরি পোশাক৷ মাথায় কমলা বর্ণের পাগড়ি৷ দু'মিনিট সাবেরি সাবেরি জপলো তারা৷ এরপর কপাল অবধি হাত উঁচিয়ে সেজদা স্টাইলে অভিনয় করলো৷ ফের সোজা হয়ে স্বজোরে মোনাজাত করতে লাগলো উর্দুতে৷ আমার পোশাক, টুপি, চলন দেখে কয়েকজন তাকাচ্ছিলো বেশ আড়চোখে৷ ভিক্ষে চাই না কুত্তো সামলাও৷ নিরুপায় আমিও হাত মেলালাম শেষমেষ তাদের সঙ্গে৷

saberi2

তারা চাইতে লাগলো ধন-দৌলত, সুখশান্তি দুনিয়ার৷ আর আমি মহামহিমের শাহি দরবারে প্রার্থনা করতে লাগলাম এই নর-নারীর অবাধ মেলামেশা-খেলা বন্ধ হবার৷ হঠাৎই হাতে চুমু খাবার শব্দ এলো কানে৷ অসমাপ্ত মোনাজাতের ইতি টানতে হলো তখনই৷

মোনাজাতের পরে আবার হরদম লোকের যাতায়াত আরম্ভ হলো৷ ভিড়ভাট্টা বাড়তে লাগলো চারদিকেই৷ ভিড় ঠেলে দুজন বেরেলবি হজরত (?) আমার কাছে এলো অতি গোপনে৷ আমার কাঁধে হাত রাখলো পেছন দিক থেকে ৷ জানতে চাইলো, কোত্থেকে এসেছি! সোজাসাপ্টা বলে দিলাম আজমির শরিফ গিয়েছিলাম৷ সেখান থেকে এতোদিন বাদে এখানে৷ তবুও কেমন যেনো নজর ফেললো আমার নুরানি চেহারায়৷

তাদের থেকে লুকোতে ধরলাম অন্যপথ৷ সামনে দেখলাম আরেকটি গাছ৷ এর গোড়ায জ্বালানো হয়েছে আগরবাতি আর ধূপ৷ লাইন ধরে সবাই নিয়ে নিচ্ছে ধূপছায়া নামের সাবেরি বরকত (?)৷ এসবের সঙ্গে নাকি হজরত পীর সাহেবের কবরের সরাসরি সংযোগ৷ কতো কি বলে টাকা কামাইয়ের ধান্দায় নেমেছে এরা কে জানে!

রুপি বের করলাম না৷ ভাংতি নেই বলে খোঁড়া অজুহাত দেখালাম৷ ধূপছায়াও কপালে জুটলো না৷ কী আর করা! অগত্যা হাঁটা ধরলাম মূল কবরের বরকত (?) নিতে৷

গেটের গার্ড খুব কড়া৷ নারী-পুরুষ মিলে গোটা দশেক পুলিশ রয়েছেন নজরদারিতে৷ লাইনচ্যুত হলেই মারেন নিতম্বে ঘা৷ লাইনে আমার সামনের খালামনিকে তেমনই খেতে হলো দুটো৷ বেচারি বড় আবেগী৷ ইয়া সাবেরি, ইয়া সাবেরি বলে আগে যেতে চেয়েছিলো সবার৷ পারেনি৷ শেষমেষ কান ধরে পেছনে পাঠানো হলো তার আবেগ এবং তাকে৷ আরেকজন আপামনিকে মনে হলো বেশ ঢঙি টাইপ৷ হয়তো মোটা অংকের মালিকা৷ পুলিশের হাতে হাজারের কয়েকটি নোট ধরিয়ে দাঁড়ালো আমার ঠিক সামনে বরাবর৷

একে একে ঢঙি আপা ঢুকে পড়লো ভেতরে৷ এবার আমার পালা৷ লাঠি দিয়ে আমায় আটকে দেয়া হলো কেনো যেনো৷ জানানো হলো—ভেতরে তোমার কাজ নেই৷ বললাম—‘ফাতিহা পড়না হ্যায়৷' অবশেষে ঢুকতে দেয়া হলো৷

ওপরে চারদিকে এসি৷ সিসি ক্যামেরাও৷ তবুও ভ্যাপসা ভ্যাপসা গন্ধ বেরোচ্ছে ঘামের৷ সবাইকে দেখলাম চারপাশের দেয়াল চুমু খেতে, নিচের মেঝেয় পড়ে সেজদাবনত হতে৷

saberi3

ভিড়ের ভেতর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি আমি রঙখেলা৷ হঠাৎ শিউরে উঠি কেনো যেনো৷ বড় সুঁড়সুঁড়ি লাগে পায়ে৷ পলক নিচে ফেলতেই প্যান্ট-শার্ট পরুয়া এক বোনকে দেখি আমায় সেজদা করছে৷ ভেবেছে হয়তো বা এটাই মাটি৷ মাটি তো বটেই৷ কিন্তু ফ্লোরের মেঝে তো আর নয়!

ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিচ্ছে হজরতের কবরকে সবাই৷ কবরের ঠিক ওপরে মন কয়েক পড়ে আছে ফুল-পাপড়ি৷ পেছনদেশ পেছনে রেখে মোনাজাত স্টাইল করে ভক্ত-অনুরক্তরা৷ মাথা নিচু করে বেরোয় হুজরা থেকে৷ কোনোমতে প্রাণপণে বেঁচে কেটে পড়ি বাইরে আমি৷

দরগাহকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে হাজারো ব্যবসা৷ আবাসিক হোটেল, খাবার রেস্তোরা, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, ফুল বহরের দোকান— আরও কতো কি চড়া মূল্যের বিজনেস! কেনাবেচাও হয় হরদম৷

বেশ জমজমাট থাকে কালিয়ার দরগাহ৷ হাজারো লোকের যাতায়াত হয় নিত্যদিন৷ অর্থ কামাইও হয় প্রচুর৷ আজমিরের পরেই অর্থ হাতানোয় এই দরগাহ এজেন্টরা পারদর্শী৷

হজরত আলাউদ্দিন সাবেরি কালিয়ারি রহ. ছিলেন আগাগোড়া শুদ্ধ মানব৷ বড় পীর, বুজুর্গ৷ হজরত খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতি রহ.—এর পরেই হক্কানি বড় পীর হিসেবে তাকেই গণনা করা হয় পাকভারতে৷ কিন্তু আজ তার মাজার শরিফকে ঘিরে কতো কি ঘটছে দিবানিশি৷ হায়রে মুসলমান, দীন-ইমান আর সুফিসাধকদের নাম ভাঙিয়ে আর কতো কাল ডুবে থাকবে পার্থিব লোভ-লালসার মোহে!

লেখক: শিক্ষার্থী : দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ