|| ওলিউল্লাহ্ মুহাম্মাদ ||
বর্তমান যুগে ইসলামী জ্ঞান ও গবেষণার প্রতি আগ্রহ কিছুটা বেড়েছে বলেই মনে হয়। বিশেষ করে ইফতা বিভাগ ও ফিকহি গবেষণার প্রতি ছাত্রদের ঝোঁক অত্যন্ত লক্ষণীয়। কিন্তু এ ঝোঁকের পেছনে যে বাস্তবিক ইলমী তৃষ্ণার চেয়ে সামাজিক মর্যাদা, “মুফতি” উপাধির মোহ, কিংবা বিবাহের বাজারে নিজের মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্য বেশি কাজ করছে—তা অস্বীকার করা যায় না।
আজকাল অনেক ছাত্রই এক বা দুই বছর ইফতার কোর্সে অংশগ্রহণ করে নিজেকে “মুফতি” দাবি করছে। কেউবা শুধু বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে, কেউ সাপ্তাহিক বা মাসিক কোর্স করে, কেউ আবার অনলাইনে ভিডিও দেখে, গুগল-ইউটিউব ঘেঁটে, অথবা বিভিন্ন ফতোয়ার কিতাব পড়ে নিজেকে একজন যোগ্য মুফতি হিসেবে তুলে ধরছে। আবার দাওরায়ে হাদিসে রাসিব পাওয়া ছেলেটিও সাহস করে ইফতার ইন্টারভিউ দিচ্ছে। আরো উদ্বেগের বিষয় হলো, কিছু প্রতিষ্ঠান অর্থের বিনিময়ে সনদ বিক্রির হাট বসিয়ে দিয়েছে, আর কিছু ছাত্র সনদের নেশায় তাদের দ্বারস্থ হচ্ছে।
ফলে সমাজে এক শ্রেণির তথাকথিত “মুফতি” তৈরি হচ্ছে, যারা ইলম, তাকওয়া, ও গবেষণার মানদণ্ডে দুর্বল; অথচ আত্মবিশ্বাসে টইটম্বুর। তারা ডানে-বামে না তাকিয়ে, কিতাবের মুখস্থ শব্দানুযায়ী, প্রসঙ্গ বিচারে না দেখে, বাস্তবতা অনুধাবন না করেই ফতোয়া প্রদান করছে। এতে করে ইসলামের ভাবমূর্তি যেমন ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, তেমনি সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে।
হাকীকতে “মুফতি” হওয়া শুধু একটি সনদ অর্জনের নাম নয়। এটি একটি শরয়ি উপাধি, যার জন্য দীর্ঘদিনের ইলমী মেহনত, গভীর গবেষণা, উসুলে ইফতা ও কাওয়ায়েদে ফিকহে দক্ষতা, তাকওয়া ও আমানতের মানসিকতা এবং একজন যোগ্য শায়েখের তত্ত্বাবধানে ফতোয়া চর্চা আবশ্যক। শরিয়ত যাকে মুফতি বলবে, সমাজ তাকেই মুফতি বলে মানবে—শুধু সনদের কাগজ দেখিয়ে নয়।
আজ আমাদের প্রয়োজন, ইফতা শিক্ষার্থীদের মাঝে এই বোধ জাগ্রত করা যে, ইলম অর্জন মানে নামের আগে উপাধি বসানো নয়; বরং দায়িত্ব ও আমানতের এক বিশাল ভার বহনের প্রস্তুতি। দরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে খোদাভীতি ও দায়িত্ববোধ জাগানো, যেন তারা অবিবেচনাপ্রসূতভাবে ইফতার সনদ বিলি না করে। তবেই ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব—ফতোয়া প্রদানের কাজটি সুষ্ঠ, নিরাপদ ও কল্যাণকর পথে পরিচালিত হবে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের উচিত ইফতা বিভাগের মান বজায় রাখতে কঠোর ভূমিকা নেওয়া। ইফতা কোর্সে ভর্তির ক্ষেত্রে যোগ্যতা, ইলম ও তাকওয়ার মানদণ্ড যাচাই করা অপরিহার্য। সনদ দেওয়ার আগে ছাত্রদের প্রকৃতভাবে প্রশিক্ষণ ও গবেষণামূলক প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
অনলাইন, সংক্ষিপ্তমেয়াদি বা অর্থের বিনিময়ে সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করতে হবে এবং তাদের কার্যক্রম প্রতিরোধে বোর্ডকে উদ্যোগ নিতে হবে। ফতোয়া একটি ইলমি ও আখিরাতমুখী দায়িত্ব—এই বোধ ছাত্রদের মনে সৃষ্টি করতে হবে।
সবচেয়ে জরুরি হলো, মুফতির উপাধি ব্যবহারে একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ নীতিমালা নির্ধারণ এবং সমাজে এমন একটি মানসিকতা গড়ে তোলা, যাতে মানুষ অযোগ্য ব্যক্তির ফতোয়া গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। দ্বীনের এই স্পর্শকাতর অঙ্গনকে রক্ষা করা আমাদের সবার আমানত।
এমএইচ/