শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


ইতালির ইয়েসিতে মুসলিম কবরস্থান

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
ইতালির ইয়েসিতে সমাধি সেমিট্রি

|| সুলাইমান সাদী ||

পাহাড়ঘেরা সবুজ শহর ইয়েসি। আনকোনা শহরের একটি উপশহর। ইয়েসিতে প্রায় দুই হাজার মুসলিমের বসবাস। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মরক্কোসহ পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে মুসলমানরা এখানে এসে জড়ো হয়েছেন।

সবাই একসঙ্গে জুমাসহ অন্যান্য নামাজ পড়তে একত্রিত হন শহরের একমাত্র মসজিদটিতে। মসজিদের সঙ্গেই গড়ে উঠেছে একটি মাদরাসা। প্রায় পনের বছর বয়স মাদরাসাটির।

স্থানীয় পাবলিক স্কুল বা কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি বিকালবেলা মাদরাসায় পড়তে আসে শিক্ষার্থীরা। নুরানি, ইবতেদায়ি, হিফজ বিভাগ ও বালিকা শাখা মিলিয়ে প্রায় দু’শ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। পাঁচজন শিক্ষক-শিক্ষিকার মেধা ও শ্রমে গড়ে উঠছে শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় মেজাজ। বর্তমানে হিফজ বিভাগে পাঁচজন হাফেজে কুরআন হিফজ রিভিশন করছেন।

গত মে মাস থেকে আমিও মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলাম। জুন-জুলাই-আগস্ট স্থানীয় স্কুল-কলেজগুলোতে গ্রীষ্মকালীন ছুটি ছিল। তবে শিক্ষার্থীরা এই তিনমাস মাদরাসায় আসা বন্ধ করেনি। বরং একবেলার পরিবর্তে তারা  সকাল-বিকাল দুবেলা পড়তে এসেছে। শিক্ষার্থীদের মাঝে ধর্মীয় পড়াশোনার আগ্রহ নজিরবিহীন।

গতকাল আমাদের মসজিদের একজন মুসল্লি ইন্তিকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মসজিদেই গতকাল আসর নামাজের পর জানাযা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এদিকে মাদরাসায় চলছে বার্ষিক পরীক্ষা। আজ বিকালে পরীক্ষা শেষে হিফজ বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থীসহ আমরা সদ্যমৃত মরহুমের কবরসহ অন্যান্য কবর জিয়ারত করতে বের হলাম।

সাধারণত শিক্ষার্থীরা ক্যাজুয়াল পোশাকে মাদরাসায় এলেও পরীক্ষা উপলক্ষে আজ সবাই পাজামা-পাঞ্জাবী পরে এসেছে। তিনজন শিক্ষকসহ শিক্ষার্থীদের ছোট্ট দলটি নিয়ে পথে নামতেই শহরের মানুষদের চোখে পড়ল অন্যরকম এক দৃশ্য। কাতার বেঁধে কিছু মাদরাসা শিক্ষার্থী হেঁটে যাচ্ছে ইউরোপের পথে। অনেকে গাড়ি থেকে বা বাড়ির বেলকনি থেকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে। আমাদের গন্তব্য ইয়েসি সেমিট্রি।


শহরের সমতল থেকে সামান্য উঁচুতে বিশাল স্থাপনা। ত্রিভূজ-চতুর্ভূজ আকৃতির নানান স্থাপত্যে ঘেরা স্থানীয় খ্রিস্টান সেমিট্রি। মূলত স্থানীয় খ্রিস্টান বাসিন্দাদের সমাধি হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে এটি। ইয়েসিতে ক্রমশ মুসলিমদের বসবাস বেড়ে যাওয়ায় মুসলিম কবরস্থানেরও প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। খ্রিস্টান সমাধিস্থলের ভেতরেই মুসলিমদের কবরস্থানের জন্য একটি জায়গা নির্ধারিত করে দেয়া হয়।

কিছুদিন আগে আমি আর আমার এক সহকর্মী হাঁটতে হাঁটতে এদিকটায় এসেছিলাম। তাই জায়গাটা চেনা ছিল। কিন্তু সেমিট্রির ভেতরে সেদিন ঢোকা হয়নি। আজ ঢুকে দেখলাম বিশাল জায়গা। হাজার হাজার নাগরিকের সমাধি সেমিট্রির ভেতরে। প্রত্যেকের সমাধির সামনে মৃতের ছবি, ফুল, বাতি ইত্যাদি রাখা। বাতিগুলো বৈদ্যুতিক হলেও দেখতে ছোট ছোট প্রদীপের মতোই লাগছে।

আমরা এগিয়ে গেলাম মুসলিম কবরস্থানের দিকে। সেখানে জিয়ারত করছিলেন সদ্যমৃত সেই মরহুমের ছেলে। আমরা তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে জিয়ারত শেষে মোনাজাত করলাম। সেখানে বাঙালিসহ বেশ কিছু আরব মুসলিমেরও কবর ছিল।

 

মোনাজাত শেষে আমরা রাস্তার অপরপাশে পুরনো সমাধির দিকে এগিয়ে গেলাম। সেখানেও একটি কবর রয়েছে। কবরটিতে শুয়ে আছেন আমাদের মাদরাসার হিফজ বিভাগের তিন শিক্ষার্থীর বাবা। বড় দুই ভাই আমাদের সাথেই ছিল। তাদের নিয়ে আমরা সেখানে গেলাম।
 

নতুন সেমিট্রিতে সমাধিগুলো কয়েকতলা বিশিষ্ট স্থাপনায় করা হলেও পুরনো সেমিট্রিতে দেখতে পেলাম এক অদেখা দৃশ্য। বিশাল বিশাল ক্রিসমাসট্রি বেষ্টিত বিরাট খোলা এক ঢালুতে শত শত সমাধি। অধিকাংশ সমাধিতে ক্রুশ স্থাপন করা। কিছু সমাধিতে শুধু নামফলক। সেখানে একটিই মুসলিম কবর চোখে পড়ল। গোলাম ফারুক সাহেবের।
 

বিশাল সমাধিক্ষেত্রটিতে দাঁড়িয়ে একজন মুসলিমের কবর জিয়ারত করছিলাম। মোনাজাতে অন্যরকম এক আবেগ আর কান্না ঝরে পড়ল সবার। জিয়ারত শেষে নানান নামের অসংখ্য সমাধি দেখতে দেখতে হাঁটা দিলাম মসজিদের দিকে।

কেএল/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ