|| ওলিউল্লাহ্ মুহাম্মাদ ||
মাদ্রাসা—একটি পবিত্র প্রতিষ্ঠান, যেখানে গড়ে ওঠে জাতির ঈমানী মানসিকতা, যেখানে শিক্ষিত হয় দ্বীনদার সমাজ, এবং যেখানে প্রতিটি শিক্ষক হয়ে ওঠেন রূহানী পথপ্রদর্শক। কিন্তু আজ এই প্রতিষ্ঠানটি অনেক ক্ষেত্রেই রূপ নিচ্ছে এক ধরনের অন্তঃসারশূন্য, শোষণমুখী ও কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার করুণ চিত্রে। যাঁরা ছিলেন নীরব সৈনিক, সেই মাদ্রাসার শিক্ষকগণ আজ হয়ে পড়েছেন অবহেলার প্রতীক।
বর্তমানে দেশের বহু মাদ্রাসায় পরিচালনা পর্ষদের কর্তাব্যক্তিরা নিজেদেরকে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী মনে করেন। মাদ্রাসা যেন তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি, আর শিক্ষক যেন নিছক চাকরিজীবী কর্মচারী। এ এক নিপীড়নমূলক সংস্কৃতি, যেখানে শিক্ষকের মতামতের কোনও মূল্য নেই, স্বাধীনতার কোনও স্থান নেই, এবং ন্যায্য অধিকার চাওয়াটাই যেন অপরাধ।
পরিচালকদের মুখে 'শিক্ষক সম্মানিত'—এমন শব্দ শোনা গেলেও বাস্তবে দেখা যায় এর সম্পূর্ণ বিপরীত রূপ। মাদ্রাসার বাহ্যিক উন্নয়নে, ভবন নির্মাণে কিংবা সৌন্দর্য বর্ধনে তারা উদারহস্তে লক্ষ লক্ষ টাকা বাজেট করেন, কিন্তু সেই মাদ্রাসার প্রাণ, অর্থাৎ শিক্ষক, তাঁর মাসিক বেতন নিয়ে যেন তারা উদাসীন। একজন শিক্ষক জীবনের মূল্যবান সময়, শ্রম ও মেধা ব্যয় করেও মাস শেষে কোনোরকমে টিকে থাকার মতো অপ্রতুল বেতন পান। অথচ তার ঘরে সন্তান, সংসার, চাহিদা ও দায়িত্ব থাকে অন্য সবার মতোই।
ছুটি নিয়েও শিক্ষককে করতে হয় সংগ্রাম। পারিবারিক বিপদে কিংবা জরুরি প্রয়োজনে ছুটি চাইলে তাকে পড়তে হয় জবাবদিহির মুখে, নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়, যেন তিনি কোনো বন্দী, যে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া নড়তেও পারবেন না। মানবিকতার চর্চা যেখানে সবচেয়ে বেশি হওয়ার কথা, সেখানে এই অমানবিক আচরণ একেবারে বেমানান।
সবচেয়ে দুঃখজনক হলো—পরিচালকের কোনও সিদ্ধান্তের গঠনমূলক সমালোচনা করলেও শিক্ষককে ‘অবাধ্য’ ও ‘অযোগ্য’ বলে চিহ্নিত করা হয়। পরিণামে তাঁকে হেনস্তা হতে হয় বা চাকরি হারানোর মতো পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। মাদ্রাসার আভ্যন্তরীণ রাজনীতির শিকার হয়ে যোগ্য শিক্ষকরা পদে পদে অপমানিত হন। পক্ষপাতদুষ্ট পরিবেশে ‘জি হুজুর’ বলা ছাড়া চাকরি টিকিয়ে রাখা দুষ্কর হয়ে পড়েছে।
এখন এমন এক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে যেখানে মেধা, যোগ্যতা ও দ্বীনি গ্রহণযোগ্যতা নয়; বরং পরিচালকের মনরক্ষা, চাটুকারিতা ও তোষামোদই পদোন্নতির মাপকাঠি। যার যত বেশি তেল মারা সক্ষমতা, তার তত বেশি উন্নতির সম্ভাবনা। এই অপসংস্কৃতি কেবল শিক্ষক সমাজকেই হতাশ করছে না, বরং ছাত্রদের মাঝেও নীতিবিবর্জিত মানসিকতার জন্ম দিচ্ছে।
সবচেয়ে লজ্জাজনক দিক হলো—কিছু মুহতামিম সাহেব ছাত্রদের সামনেই শিক্ষকদের উপর অন্যায়ভাবে শাসন করছেন, অপমান করছেন। এর ফলে ছাত্রদের মনে শিক্ষকের প্রতি যে সম্মান থাকা উচিত, তা ভেঙে পড়ছে। শিক্ষকতা পেশার মাহাত্ম্য দিন দিন ধুলোয় লুটাচ্ছে।
এই অবস্থার ফলে অনেক শিক্ষক আজ মাদ্রাসার খেদমত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। তারা ভাবছেন, যেখানে সম্মান নেই, ন্যায্য অধিকার নেই, সেখানে কেবল ইখলাস দিয়ে টিকে থাকা যায় না। তাঁদের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে এক প্রকার বেদনা, ক্লান্তি এবং আত্মসম্মানের সংকট।
এই সংকট কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং জাতীয়। একটি জাতি যতটা না কারুকার্যপূর্ণ ভবনে গড়ে ওঠে, তার চেয়েও বেশি গড়ে ওঠে একজন সম্মানিত, ত্যাগী, ও মর্যাদাবান শিক্ষকের হাতে। যদি সেই হাতই কেটে ফেলা হয়, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা কী দিয়ে গড়ব?
এবার সময় এসেছে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক মাদ্রাসা ব্যবস্থাপনার পথে ফিরে যাওয়ার। শিক্ষককে গোলাম নয়, একজন মর্যাদাসম্পন্ন খেদমতগার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। নতুবা এই নিপীড়ন অব্যাহত থাকলে, খুব শিগগিরই আমরা মাদ্রাসার প্রকৃত রূহকেই হারিয়ে ফেলব। তখন আর উন্নত ভবন বা বাহ্যিক চাকচিক্য দিয়ে ইসলামী শিক্ষার প্রাণ বাঁচানো যাবে না।
লেখক: ফাজেলে জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া ঢাকা।
নাজিমে তালিমাত, পারখাজুরা মাদ্রাসা মণিরামপুর, যশোর।
এমএইচ/