মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৯ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ২১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬


আমরা কি কওমী শিক্ষাধারার বৈশিষ্ট্য ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন ||

     ইদানিং দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন কওমী  মাদরাসায় ছাত্ররা কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মাতবরি শুরু করেছে। উস্তাদ ও মুরব্বী মান্যতার তোয়াক্কা মোটেই করছে না। যেন ছাত্ররাই উস্তাদ ও মুরব্বীদের চেয়ে বেশি জ্ঞানী, বেশি বিচক্ষণ ও বেশি দূরদর্শী হয়ে গেছে। আন্দোলন করে ছাত্রদের কথা মানার জন্য উস্তাদ ও মুরব্বীদেরকে বাধ্য করা হচ্ছে। উস্তাদ ও মুরব্বীদের সঙ্গে বেয়াদবিও করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানে ভাংচুর প্রভৃতি সহিংসতাও চালানো হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় উস্তাদ ও মুরব্বীদের দোষ-ত্রুটি প্রচার করে উস্তাদ ও মুরব্বীদের কাপড় খুলে ফেলা হচ্ছে। আল্লাহর কাছে এসব থেকে পানাহ চাই।

   এসব আন্দোলনকারী নবীনদের অনেক যুক্তি। অন্যায়ের প্রতিবাদ, ন্যায্য দাবি আদায়, ইনসাফ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি যুক্তির দোহাই দিয়ে তারা এগুলো করছে। কিন্তু উস্তাদ ও মুরব্বীদের আনুগত্য, তাদের আদব রক্ষা, তাদের সম্মান রক্ষা, তাদের অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতাকে মেনে নেওয়া- এগুলোর আবশ্যকতার কথা তারা মাথা থেকে একেবারেই ধুয়ে মুছে ফেলছে। আমি কসম করে নয় তবে কসমের কাছাকাছি প্রত্যয় থেকে বলছি এই ধারা চলতে থাকলে এবং ব্যাপকতা পেলে কওমী মাদরাসা শিক্ষাধারা তার শৃঙ্খলা হারাবে, ছাত্র গড়ার ঐতিহ্য হারাবে, বৈশিষ্ট্য হারাবে। কওমী মাদরাসা শিক্ষাধারা ধবংস হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে উস্তাদদের প্রতি ছাত্রদের ভক্তি শ্রদ্ধা এবং ছাত্রদের প্রতি উস্তাদদের স্নেহ-আন্তরিকতা, ছাত্রদের মঙ্গল ও কল্যাণকামিতার চিন্তা-চেতনা এটি হচ্ছে কওমী শিক্ষাধারার প্রতিষ্ঠানসমূহের ঐতিহ্যবাহী বৈশিষ্ট্যসমূহের একটি।  উস্তাদদের বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলন এই বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে দিবে। উস্তাদদের প্রতি ছাত্রদের ভক্তি শ্রদ্ধা না থাকলে, উস্তাদদের সঙ্গে বেয়াদবি করলে, ছাত্রদের প্রতিও উস্তাদদের স্নেহ-আন্তরিকতা থাকবে না, ছাত্রদের মঙ্গল ও কল্যাণকামিতার চিন্তা থাকবে না। তখন উস্তাদদের মধ্যে ছাত্রদেরকে ভালো আলেম হিসেবে গড়ে তোলার স্বযত্ন প্রয়াস ও ব্যাকুলতাও থাকবে না। তখন উস্তাদরা শুধু চাকরি রক্ষার চিন্তায় পরিচালিত হবে। শুধু অফিসিয়াল ডিউটি পালন করেই ক্ষান্ত হবে। অতিরিক্ত আন্তরিকতা নিয়ে ছাত্রদেরকে গড়ে তোলার যে তৎপরতার ফলে কওমী মাদরাসা থেকে যোগ্য আলেম গড়ে ওঠে সেই তৎপরতা চালানোর উৎসাহ উস্তাদদের মধ্যে থাকবে না। তখন কওমী মাদরাসা থেকে উস্তাদদের স্বযত্ন প্রয়াসে যোগ্য আলেম তৈরি হওয়ার ধারা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আর এভাবেই কওমী মাদরাসা শিক্ষাধারা তার ছাত্র গড়ার ঐতিহ্যবাহী বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলবে। জানি না কওমী মাদরাসার সফলতার ধারাকে বিনষ্ট করার জন্য পরিকল্পিতভাবে কোন গোষ্ঠি ছাত্রদেরকে ও নবীনদেরকে উস্তাদ মুরব্বীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছে কি না। বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখা দরকার।

    কওমী শিক্ষাধারাকে তার ঐতিহ্যবাহী বৈশিষ্ট্যে ধরে রাখতে হলে উস্তাদ মুরব্বীদের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন বিশৃঙ্খলা বনাম আত্মঘাতি তৎপরতা অতি অবশ্যই পরিহার করতে হবে। আর যদি আমরা কওমী শিক্ষাধারাকে ধ্বংসের ফাইনাল সিদ্ধান্ত নিয়েই থাকি তাহলে এগুলোই চালিয়ে যাই এবং যুক্তির নামে কুযুক্তি দিয়ে একে উজ্জীবিত করতে থাকি!

   কারও নাম উল্লেখ করে বিতর্কের দিকে যেতে চাই না। তবে মোটাকথা যে, ছাত্রদের এসব উগ্রতা ও সহিংসতার পেছনে অবশ্যই কারো না কারো উগ্র চিন্তা-চেতনার প্রভাব থাকে। সেই পেছনের কুশিলবরা যদি কওমী শিক্ষাধারার শত্রু হয়ে থাকে, তাহলে তাদের ব্যাপারে সকলে সজাগ সচেতন থাকুন। দলীল-প্রমাণসহ তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে থাকুন। আর যদি তারা আমাদেরই কওমী ধারার লোক হন এবং এই ধারার শত্রু না হন কিন্তু মুরব্বীদের বুঝ ও মুরব্বীদের অনুসৃত নীতি ছেড়ে নিজেদের বুঝমত তারা এসব তৎপরতা চালাচ্ছেন- এমন হয়, তাহলে তাদের কাছে বিনীত নিবেদন- জুমহুর মুরব্বীদের বুঝ ও তাদের অনুসৃত নীতি বর্জন করবেন না। কওমী শিক্ষাধারাকে ধ্বংস করে দিবেন না। হক ও হক্কানিয়াতের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এই ধারাকে ধ্বংস করে দিবেন না। যোগ্য আলেম গড়ার এই কারখানাগুলোকে ধ্বংস করে দিবেন না। আকাবিরের রেখে যাওয়া এই আমানতকে ধ্বংস করে দিবেন না।

    মনে রাখবেন জুমহুর মুরব্বীদের বুঝ ও তাদের অনুসৃত নীতি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। আপনাদেরটা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নয়, বরং প্রবল সন্দেহপূর্ণ, নিশ্চিত ঝুঁকিপূর্ণ। হাদীছের ভাষ্য স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি-

دع ما يريبك إلى ما لا يريبك. (رواه الترمذي والنَّسائي، وقال الترمذي: حديث حسن صحيح.)

অর্থাৎ, সন্দেহপূর্ণটা ছেড়ে সন্দেহমুক্তটা ধরো। (সুনানে তিরমিযী ও নাসায়ী)

  উস্তাদ ও মুরব্বীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে উজ্জীবিত কোমলমতি ছাত্র ও নবীনদের বলব, কওমী মাদরাসা ধ্বংসের এই তৎপরতায় তোমরা ব্যবহৃত হয়ো না। কোন মাদরাসায় কোন সমস্যা দেখা দিতে পারে, কোন উস্তাদ বা মুরব্বীর কোন ভুল হতে পারে। অতীতেও কোন প্রতিষ্ঠানে এরকম সমস্যা ও ভুল দেখা দেয়নি তা নয়। কিন্তু তখন যেভাবে মুরব্বীদের মধ্যস্থতায় সবকিছুর প্রতিকার করা হয়েছে, এখনও সেভাবেই এগোতে হবে। ইমাম মালেক রহ.-এর একটা প্রসিদ্ধ উক্তি রয়েছে যা এ ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। উক্তিটি হল-

لن يصلح آخر هذه الأمة إلا بما صلح به أولها.

অর্থাৎ এই উম্মতের শুরুভাগের লোকদের ইসলাহ সংশোধন যে পদ্ধতিতে হয়েছে, শেষভাগের ইসলাহ সংশোধনও সেই পদ্ধতি ছাড়া অন্যভাবে হবে না।

     মনে রাখতে হবে মুরব্বীদের মাধ্যমে কোন সমস্যার সমাধান হলে মুরব্বী মান্যতার ধারায় আর কেউ সাধারণত সেই বিষয় নিয়ে দ্বিতীয়বার ঘাটাঘাটি করতে যায় না। বলে, যা-ই হোক মুরব্বীগণ যখন বলছেন তখন আমরা মেনে নিলাম। এভাবে সমস্যার সমাধান স্থায়িত্ব লাভ করে। বা ন্যুনতম পরিস্থিত শান্ত হয়। কিন্তু ছাত্র ও নবীনদের প্রতি অন্যদের এরূপ মান্যতা হওয়া সম্ভব নয়, হয়ও না। ফলে তাদের আন্দোলনে সাময়িক কোন সমাধানে পৌঁছনো হলেও পরবর্তীতে আরেক নবীন গোষ্টি সময় সুযোগে আবার পাল্টা আন্দোলন গড়ে তোলে। সমস্যার সমাধান স্থায়িত্ব লাভ করে না। পরিস্থিতি শান্ত হয় না। যেমনটা ইদানিং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আমরা লক্ষ করছি একই বিষয় নিয়ে কিছুদিন পরপর কাউন্টার রিকাউন্টার আন্দোলন চলছে।

    উস্তাদ মুরব্বীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন প্রয়াসী ছাত্র ও নবীনদের বলব, তোমরা এখন ভাবছো উস্তাদ মুরব্বীদের চেয়ে তোমরা বেশি বোঝ, হয়তো খুব বেশি দিন যাবে না তোমাদের এই ভুল ভাঙ্গবে, যখন দেখবে তোমাদের ছাত্র ও অধীনস্থরা তোমাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে এই বলে যে, তোমরা বোঝ না। তখন তোমরা ঠিকই বুঝবে তোমাদের ছাত্ররা না-বুঝ তাই এমন বলছে। এবং এ-ও বুঝবে অতীতে তোমরাও তোমাদের ছাত্রদের মতো ভুল বুঝেছিলে এবং সেই ভুল বুঝের উপর নির্ভর করে কতোকিছু করেছিলে। তখন আফসোস করবে। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা তো ইতিমধ্যে হয়েই গিয়ে থাকবে। অতএব সময় থাকতেই হূঁশে আসো। বুদ্ধিমত্তা, ভারসাম্য, আদব, শৃঙ্খলা সাথে রাখো।

এনএ/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ