পেহেলগামে পর্যটক হত্যার দায়ভার কি ভারত এড়াতে পারে?
প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল, ২০২৫, ০৮:২৪ রাত
নিউজ ডেস্ক

হামিদ মীর

'পেহেলগাম' মানে গরুপালকদের গ্রাম। কাশ্মীরি ভাষায় গরুপালককে বলা হয় 'পেহেল' আর 'গাম' মানে গ্রাম বা বসতি। প্রাচীনকালে পেহেলগাম ছিল এক মনোরম চারণভূমি, যেখানে কিছু গরুপালকের ঘরবাড়ি ছিল। কিন্তু ২২ এপ্রিল ২০২৫-এর পর থেকে ভারতীয় মিডিয়া এই সুন্দর স্থানটিকে হিন্দুদের হত্যাকাণ্ডের স্থান হিসেবে তুলে ধরে কোনো প্রমাণ ছাড়াই পাকিস্তানের ওপর দোষ চাপাচ্ছে। ২২ এপ্রিল দুপুরে পহেলগামে ২৮ জন ভারতীয় পর্যটকের নৃশংস হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত নিন্দনীয়। এই ঘটনা অমানবিক ও ইসলামবিরোধী, কারণ ইসলাম নিরস্ত্র অমুসলিমদের হত্যার অনুমতি দেয় না।

সন্ত্রাসবাদের কোনো ধর্ম নেই। তাই যদি আমরা বেলুচিস্তানে জাফর এক্সপ্রেসে নিরীহ যাত্রীদের ওপর হামলার নিন্দা করি, তবে পেহেলগামে নিরীহ পর্যটকদের ওপর হামলারও নিন্দা করা উচিত।

এই সন্ত্রাসী ঘটনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, বন-আবৃত, উঁচু পাহাড়ের গরুপালকদের এই গ্রামে তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র ও অন্যান্য রাজ্য থেকে আগত পর্যটকদের জন্য যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা কেন করা হয়নি? জম্মু ও কাশ্মীরের ইতিহাস ও ভূগোল সম্পর্কে যারা জানেন, তারা জানেন যে, পেহেলগাম বহু দশক ধরে ভারতীয় নাগরিকদের জন্য নিরাপদ নয়। ভারত সরকার তাদের নাগরিকদের এই সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে আগে থেকে সতর্ক করেনি কেন?

এই হামলা কি ভারতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতা নয়? কীভাবে হঠাৎ করেই জঙ্গলের ভেতর থেকে এম-৪ এবং একে-৪৭ রাইফেলধারী সশস্ত্র জঙ্গিরা বেরিয়ে এসে হাস্যোজ্জ্বল পর্যটকদের ঘিরে ধরে শুধু পুরুষদের গুলি করে হত্যা করল? নারীরা ও শিশুরা তাদের নিশানা হয়নি। একজন নারীর চোখের সামনে তার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করা হলে, তিনি আতঙ্কিত হয়ে বলেছিলেন, ‘আমাকেও গুলি করো,’ কিন্তু জঙ্গিরা তাকে গুলি করেনি।

সম্প্রতি জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভায় জানানো হয়েছিল, ২০২৪ সালে ৩৫ লাখ পর্যটক রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছেন, যার মধ্যে ৪৩ হাজার ছিলেন বিদেশি। এই পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে ভারতীয় মিডিয়া কাশ্মীরি স্বাধীনতা আন্দোলনের অবসান ঘোষণা করে বসে।

পেহেলগামে নিরীহ ভারতীয় পর্যটকদের হত্যার দায়ভার একদিকে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর, অন্যদিকে সেই নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার, যারা জনগণকে এই অঞ্চল সম্পর্কে সঠিক তথ্য দেয়নি।

পেহেলগাম সব সময় অনিরাপদ ছিল না। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদে চরমপন্থী হিন্দুদের আক্রমণের পর, প্রথমবার ১৯৯৩ সালে পেহেলগামে অমরনাথ যাত্রীদের ওপর হামলা হয়। এর আগে, এটি ছিল ধর্মীয় সহনশীলতার এক অনন্য নিদর্শন। পেহেলগাম শ্রীনগর থেকে ৯৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এবং এটি অনন্তনাগ জেলার অংশ। ১৬৬৪ সালে ইসলাম খান এই জেলার নাম দেন ইসলামাবাদ। অনন্তনাগ মানে অগণিত ঝর্ণার শহর। কিছু হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে এই এলাকায় বিষ্ণু দেবতার অবস্থান ছিল।

হিন্দুদের বিখ্যাত তীর্থ অমরনাথ পেহেলগাম থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে হিমালয়ের পাহাড়ে অবস্থিত। প্রতি বছর শ্রাবণ মাসে পূর্ণিমার দিনে হিন্দু যাত্রীরা এখানে আসেন। তারা পেহেলগাম থেকে যাত্রা শুরু করেন, লিদার উপত্যকায় গণেশবল নামক স্থানে স্নান সেরে চন্দনওয়ারিতে পৌঁছান। সেখান থেকে শুরু হয় খাড়া পাহাড়ি পথ। এরপর শেশনাগ হ্রদে স্নান করে, তারা পৌঁছান পাঞ্জতারনি, যার মানে পাঁচ নদীর উপত্যকা। সেখান থেকে ভজন গাইতে গাইতে তারা পৌঁছান এক বিশাল গুহার সামনে, যেখান থেকে যদি বুনো কবুতর বের হয়, তাহলে বিশ্বাস করা হয় অমরনাথের দর্শন হয়েছে। 

অনন্তনাগে একটি ঝর্ণা আছে যার নাম নাগবল—সেখানে হিন্দু মন্দির, মুসলিম মসজিদ এবং শিখ গুরুদ্বারা পাশাপাশি অবস্থিত। ধর্মীয় সহনশীলতার আরেকটি উদাহরণ হলো বাবাদাউদ খাকি মসজিদ, যার প্রাঙ্গণে একটি হিন্দু মন্দিরও আছে। একই এলাকায় রয়েছেন সুফি সাধক রিশি মোল, যার ভক্তদের মধ্যে মুসলমান ও হিন্দু দু’ধরনের মানুষই রয়েছেন।

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বাবরি মসজিদের ঘটনার পর ধর্মীয় সহনশীলতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ১৫ আগস্ট ১৯৯৩ সালে অমরনাথ যাত্রীদের ওপর হামলায় ৮ জন নিহত হন। ১৯৯৪ সালে ৫ জন, ১৯৯৮ সালে ২০ জন, ২০০০ সালে ৩২ জন, ২০০১ সালে ১৩ জন, ২০০২ সালে ৯ জন, ২০০৬ সালে ৫ জন, ২০১২ সালে ৭ জন, ২০২২ সালে ৪ জন এবং ২০২৪ সালে ১০ জন যাত্রী নিহত হন।

গত বছর ১৯ মে ২০২৪ সালে শোপিয়ান ও অনন্তনাগে পর্যটকদের ওপর হামলার পর পর্যটকদের সতর্ক করা উচিত ছিল। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনী এবং ভারতীয় নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া সেই দায়িত্ব পালন করেনি। অথচ পহেলগামের জঙ্গলে নিয়মিত তল্লাশি অভিযান চলে।

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অনন্তনাগের কুকারনাগ এলাকার পাহাড়ি জঙ্গলে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও স্থানীয় পুলিশ এক যৌথ অভিযান চালায়, যেখানে ড্রোন ব্যবহার করা হয়। সেখানে কয়েক দিন ধরে তীব্র লড়াই হয়, যাতে রাষ্ট্রীয় রাইফেলসের কর্নেল মনপ্রীত সিং এবং কাশ্মীর পুলিশের এসপি হুমায়ুন ভাটসহ অনেক কর্মকর্তা নিহত হন। এই লড়াই সেই গ্রুপের সাথেই হয়েছিল, যারা পহেলগামের হামলার দায় স্বীকার করেছে।

এই গোষ্ঠী ২০১৯ সালে ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলুপ্তির পর 'মোর্চা ফর রেজিস্ট্যান্স' নামে গঠিত হয়। তাদের কমান্ডার শেখ সাজাদ গুল শ্রীনগরের বাসিন্দা, যিনি দিল্লির তিহার জেলে চার বছর বন্দি ছিলেন এবং ২০০৬ সালে মুক্তি পেয়ে ৫ আগস্ট ২০১৯ থেকে আবার সক্রিয় হন। এই গ্রুপ জম্মু-কাশ্মীরে অ-স্থানীয় হিন্দুদের ডোমিসাইল দেওয়ার নীতির বিরুদ্ধে কাজ করছে।

তবে নিরস্ত্র পর্যটকদের ওপর হামলা কোনোভাবেই স্বাধীনতার যুদ্ধ বলা যায় না। এমন হামলা যেখানেই হোক, হামলাকারীদের জাতি, ধর্ম বা জাতীয়তার জন্য লজ্জাজনক।

২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামায় সিআরপিএফ-এর কনভয়ের ওপর হামলার পর ২৬ ফেব্রুয়ারি ভারত পাকিস্তানের ওপর বিমান হামলা চালিয়ে নিজেরই ক্ষতি করেছিল। ২২ এপ্রিল পেহেলগামের হামলার পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আবার কোনো অভিযান বা ‘অ্যাডভেঞ্চার’ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে মনে রাখা উচিত, কাশ্মীর সমস্যা কোনো অ্যাডভেঞ্চারের মাধ্যমে নয়, বরং শেষ পর্যন্ত সংলাপের মাধ্যমেই সমাধান হতে পারে।

[পাকিস্তানের প্রথম সারির উর্দু দৈনিক জং থেকে লেখাটি অনুবাদ করেছেন: সাইমুম রিদা]

এমএইচ/