কওমি মাদরাসায় বেড়েছে ছাত্র ভর্তির হার
প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল, ২০২৫, ১১:১১ দুপুর
নিউজ ডেস্ক

 

।। মুহাম্মদ হুজাইফা ।।


দেশের কওমি মাদরাসাগুলোর শিক্ষাবর্ষ শুরু হয় পবিত্র রমজানের পর। সে হিসেবে দেশের বেশির ভাগ মাদরাসায় ইতোমধ্যে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে পাঠদানও। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবার কওমি মাদরাসাগুলোতে ছাত্র ভর্তির হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এই প্রবণতা সমাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতিতে বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। 

কিছু মাদরাসায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবছর ছাত্র ভর্তির হার অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি। এর মধ্যে অনেক মাদরাসা কোটা সীমিত হওয়ায় বহু ছাত্রকে ফিরিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলের নামকরা মাদরাসাগুলোর ক্ষেত্রে এই প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা গেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অতিরিক্ত হওয়ায় অনেকেই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেও ভর্তি হতে পারেনি।

গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে অনেক পরিবারেই ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি সচেতনতা বেড়েছে। ছাত্র ভর্তির হার বেড়ে যাওয়ার পেছনে এটাকে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি, অনেক মাদরাসার শিক্ষা কার্যক্রমে আধুনিক শিক্ষাও যুক্ত হয়েছে। যেমন প্রযুক্তিনির্ভর পাঠদান, ইংরেজি ও গণিতের উন্নত কোর্স এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রম—যা সাধারণ লোকদের আকৃষ্ট করেছে।

কওমি মাদরাসায় ভর্তির হার কেন বাড়ছে?

কওমি মাদরাসাগুলো ছাত্র সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। যেমন-

১. শিক্ষার ব্যয়: বাংলাদেশের যেকোনো কওমি মাদরাসায় মাসিক খরচ সহনীয় পর্যায়ে থাকে। আর্থিকভাবে অসচ্ছল ও সমাজের ছিন্নমূল ছেলে-মেয়েদের বিশেষ ব্যবস্থাপনায় বিনা খরচে পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়। 

২. ধর্মীয় শিক্ষা:  এই মাদরাসাগুলো শুধু ধর্মীয় জ্ঞানের কেন্দ্র নয়, বরং নৈতিক চরিত্র গঠনের একটি শক্তিশালী মাধ্যম। কওমি মাদরাসায় যারা পড়াশোনা করে তারা আত্মনিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা ও সেবামূলক মনোভাব নিয়ে সমাজে বেড়ে ওঠে। আধুনিক সমাজে যেখানে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা অনেক সময় বিলীন হয়ে যায়, সেখানে কওমি মাদরাসা এক অনন্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

৩. করোনা মহামারির প্রভাব: করোনা মহামারির সময় দেশের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি আদেশে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তবে বিকল্প ব্যবস্থাপনায় খোলা ছিল বেশির ভাগ মাদরাসা। মহামারি চলাকালে মানুষ কিছুটা সংবেদনশীল ও আল্লাহমুখী হয়ে মাদরাসার দিকে বেশি ঝুঁকে। ধর্মীয় জ্ঞান শেখার প্রতি মনোনিবেশ করে। করোনাকাল থেকে নিয়ে পরবর্তী সময়ে মাদরাসাগুলোতে তুলনামূলক ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে। 

৪. হাফেজদের বিশ্বজয়: কওমি মাদরাসাগুলো বিশুদ্ধভাবে কোরআন তেলাওয়াতের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেয়। কওমি মাদরাসার এই সুনামটুকু সবখানেই রয়েছে। কওমি মাদরাসায় পড়াশোনা করা ছোট ছোট শিশুরা বিশ্ব দরবারে প্রতিযোগিতায় ঈর্ষণীয় ফলাফল করছে। এর একটা প্রভাব পড়ছে সমাজে। অনেক বাবা-মা চান তাদের সন্তানটি যেন এমন হাফেজে কোরআন হয়। 

৫. মক্তব শিক্ষায় জোর: মক্তব শিক্ষায় কওমি মাদরাসা বরাবরই জোর দিয়ে থাকে। বিশেষ করে নূরানী সিলেবাসের মাদরাসাগুলো দীনি জ্ঞানের পাশাপাশি শিশুদের জাগতিক জ্ঞানও দিচ্ছে। এর কারণে অনেক অঞ্চলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী সংকটে ভুগছে। 

কওমি মাদরাসার আশাব্যঞ্জক কিছু দিক

কওমি মাদরাসা বিশাল এনজিও প্রতিষ্ঠানও। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ওপর বোঝা না হয়ে নিরক্ষরতা দূরীকরণ, নৈতিক শিক্ষার প্রসার, মানবসম্পদ উন্নয়নসহ নানা ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলছে। শুধু বাংলাদেশ নয় বরং পুরো উপমহাদেশে কওমি মাদরাসার উলামায়ে কেরাম ধর্মীয় ক্ষেত্রে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। ধর্মীয় বিষয়ে রাষ্ট্র এবং জনগণ তাদের ওপরেই সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে। এটা অনেক বড় সফলতা। সব ধরনের বাতিল প্রতিরোধে কওমি মাদরাসার অ্যাকটিভিটি সবচেয়ে বেশি। এজন্য সব বাতিল তাদেরকেই সবচেয়ে বেশি মাথাব্যথার কারণ মনে করে।

বর্তমানে বাংলাদেশে কওমি মাদরাসায় ইলমি বিষয়ে তাহকিক বা গবেষণা বেশ উন্নতির পথে রয়েছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মাত্রা স্পর্শ করতে যাচ্ছে।
মহিলা মাদরাসার মাধ্যমে নীরবে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে কওমি মাদরাসা অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। সমাজে মহিলাদের মাধ্যমে অশ্লীলতার যে সয়লাব বয়ে যাচ্ছে মহিলা মাদরাসার মাধ্যমে তা অনেকটা রোধ হচ্ছে। 

বিভিন্ন পেশায় কওমি শিক্ষার্থীরা
কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা এখন নানা কর্মক্ষেত্রে যেতে পারছে। কিছুদিন আগে কওমি উদ্যোক্তার অনুষ্ঠান দেখেই সেটা আন্দাজ করা গেছে। তারা ইমামতি, বেসরকারি ধর্মীয় শিক্ষকতা, শিক্ষা উদ্যোক্তা, ওয়াজ নসিহত, ধর্মীয় সাহিত্য তৈরি ইত্যাদি পেশায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী হিসেবেও তারা অন্যদের তুলনায় অধিক সামঞ্জস্যতা প্রদর্শন করছে। বর্তমানে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও তারা সফলতার স্বাক্ষর রাখছে।
অনলাইন অ্যাকটিভিটি ও আইটি সেক্টরেও তাদের পদচারণা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া সাংবাদিকতাকে আজকাল কওমি মাদরাসার অনেক শিক্ষার্থী পেশা হিসেবে গ্রহণ করছে এবং মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হচ্ছে। 

সরকার চাইলেই কওমি মাদরাসা থেকে বিভিন্ন বাহিনীতে সৈনিক নিতে পারে। ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে সরকারি মাদরাসা থেকে কওমি মাদরাসার ছাত্ররা অধিক সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারবে। সামান্য কিছু ট্রেনিং দিয়ে ব্যাংকিং সেক্টরেও কওমি মাদরাসা থেকে কর্মী নেওয়া যায়। আল  আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক এক সময় কর্মী নিয়েছে এবং দারুণভাবে সফল হয়েছে।

তবে বর্তমানে কওমি শিক্ষায় কারিগরি শিক্ষা যোগ করার দাবি উঠছে। বলা হচ্ছে, কওমি শিক্ষার্থীরা কারিগরিতে পারদর্শী হলে কর্মসংস্থান নিয়ে তাদের চিন্তা অনেক কমে যাবে। তাই কওমি মাদরাসার দায়িত্বশীলদের প্রতি সুপারিশ, কারিগরি শিক্ষা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এমএম/