এখনো ছবি হাতে অপেক্ষা করেন শহীদ হাফেজ মাসুম রেজার বাবা
প্রকাশ: ০৯ মার্চ, ২০২৫, ০১:২১ দুপুর
নিউজ ডেস্ক

‘আমার নিরপরাধ, পবিত্র কোরআনের হাফেজ পুত্র মো. মাসুম রেজা অন্তর (১৬) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নিয়ে দেশের জন্য শহীদ হয়েছে। তার ছবি নিয়ে এখনও রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকি, এই বুঝি আমার ছেলে বাড়ি ফিরে এসে বাবা বলে ডাকবে। কিন্তু ‘বাবা’ বলে ডাক তো আর কোনো দিন শুনতে পাব না।’

দিনাজপুরের বিরল উপজেলার করলা গ্রামে ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে শহীদ মো. মাসুম রেজা অন্তরের (১৬) বাবা মো. মিজানুর রহমানের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, ২০০৫ সাল থেকে তিনি ঢাকার কোনাপাড়া এলাকায় বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ করতেন। সেখানে থাকাকালীন শহীদ অন্তরের নানা পরিবারের সঙ্গে পরিচয় হয় এবং কথাবার্তার মাধ্যমে ২০০৭ সালের জানুয়ারির প্রথম দিকে মোছাম্মৎ নাহিদা বেগমের সঙ্গে তার বিয়ে হয়।

 বিয়ের পর দাম্পত্য জীবন ভালোই চলছিল। বিয়ের দুই বছর পর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে তাদের ছেলে মাসুম রেজা অন্তরের জন্ম হয়। কিন্তু অন্তরের বয়স যখন চার বছর, তখন তার মা-বাবার মধ্যে বনিবনা না হওয়ায় প্রায়ই ঝগড়া হতো। এরপর স্বামী-স্ত্রী ঢাকার কোনাপাড়া এলাকায় আলাদা ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করেন। একপর্যায়ে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে।

চার বছরের শিশু অন্তরকে মায়ের কাছে রাখা নিরাপদ মনে না করায় মিজানুর রহমান তাকে নিজের কাছে রেখে দিনাজপুরের বিরল উপজেলার নিজ গ্রামে চলে আসেন তিনি। পরে নিজের পিতৃস্নেহে অন্তরকে লালন-পালন করতে থাকেন।

পরবর্তীতে মিজানুর রহমান বিরল উপজেলার ধর্মপুর গ্রামের সুলতান আহমেদের কন্যা সুলতানা বেগমকে বিয়ে করেন। এই সংসারে তাদের দুটি কন্যাসন্তান রয়েছে,প্রথম কন্যা মোছাম্মৎ মিনু আক্তার (৯) ও দ্বিতীয় কন্যা মাহিমা আক্তার (৪)। তারা স্থানীয় একটি মহিলা মাদ্রাসায় পড়ালেখা করছে।

দ্বিতীয় স্ত্রী সুলতানা বেগম প্রথম পক্ষের সন্তান অন্তরকে নিজের সন্তানের মতোই দেখাশোনা করতেন। মিজানুর রহমান কখনো অন্তরকে তার স্নেহ-ভালোবাসার কমতি অনুভব করতে দেননি।

তিনি অন্তরকে ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে ঢাকা হাজারীবাগ ঝাউচর এলাকার আল-নূর কওমি মাদ্রাসায় ভর্তি করান। আট বছর ধরে সেখানে হাফেজিয়া পড়াশোনা শেষে অন্তর একজন পূর্ণাঙ্গ হাফেজ হয়ে ওঠে। এরপর কওমি ধারায় আলেম হওয়ার জন্য বিভিন্ন কিতাব নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিল।

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর দিন ৬ আগস্ট অন্তরের বাবা মিজানুর রহমান ফেইসবুকে তার ছেলে অন্তর আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে বলে জানতে পারেন। জানতে পারেন, ঢাকা হাজারীবাগ ঝাউচর আল-নুর মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড়ে গত ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়ে অনেক শিক্ষার্থী শহীদ হয়েছেন। অনেকেই গুরুতর আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

এই সংবাদ পাওয়ার পর মিজানুর রহমান দিনাজপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন। ৬ আগস্ট বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে তিনি ছেলের খোঁজ করেন। কিন্তু চিকিৎসাধীন কোনো গুলিবিদ্ধ রোগীর তালিকায় তার সন্তানের নাম ছিল না। পরে মর্গে গিয়ে অন্তরের লাশ খুঁজতে শুরু করেন।

প্রায় দেড় ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পর তিনি, অন্তরের নানা মোহাম্মদ আলী ও মামা মোসলেম উদ্দিন মর্গে পচন ধরা অবস্থায় অন্তরের লাশ শনাক্ত করেন। মর্গের লোকজন তাদের  বলেন, এই ছেলে গত ৪ আগস্ট ঘটনাস্থলে মারা গিয়েছে। সেদিন থেকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ময়না তদান্ত শেষে লাশ-ঘরে পড়ে রয়েছে।

ঢাকা মেডিকেলের মর্গ থেকে মিজানুর ও তার অন্তরের মামা মোসলেম উদ্দিন ও নানা মোহাম্মদ আলী কাঁধে করে মর্গ থেকে লাশ এম্বুলেন্সে ওঠান। গত ৬ আগস্ট বাদ মাগরিব নামাজে জানাজা শেষে মাসুম রেজা অন্তরের লাশ তার মা ও নানা-মামার কথামতো নানাবাড়ি পাশে ঢাকা কোনাপাড়া ডগাই সরকারি কবরস্থানে দাফন করা হয়।

শহীদ অন্তরের বাবা মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমার শহীদ পুত্র অন্তর একজন পবিত্র কোরআনের হাফেজ। সে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ইসলামের জন্য পড়াশোনা ও কাজ করেছে। আল্লাহ তাআলা তাকে শহীদের মর্যাদা দেবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।’

তিনি দাবি জানিয়ে বলে, ‘যারা আমার নিরপরাধ সন্তানকে নির্মমভাবে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে, তাদের যেন এ দেশের মাটিতে ন্যায়বিচারের আওতায় আনা হয়। তাহলেই আমার সন্তানের আত্মা শান্তি পাবে।’

এনআরএন/