তাওহীদ আদনান ইয়াকুব
(সূরা নিসা:৮৭-১৭৬ ও সূরা মায়িদা:১-৮২)
আল-কুরআন মানবজাতির জন্য এক পূর্ণাঙ্গ সংবিধান, যেখানে রয়েছে আধ্যাত্মিক নির্দেশনা, সামাজিক নীতিমালা ও ন্যায়বিচারের বিধান। প্রতিটি আয়াতে রয়েছে গভীর জ্ঞান ও হিকমত, যা মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দেয়। চতুর্থ তারাবির তেলাওয়াতে থাকবে ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক—বিশেষ করে ন্যায়বিচার, পারিবারিক আইন, মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্ক, হালাল-হারামের বিধান এবং আহলে কিতাবদের সঙ্গে আচরণের আদর্শনীতি। এই অংশে মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র, ইসলামী সমাজব্যবস্থার মূলনীতি, প্রতিশ্রুতি রক্ষার গুরুত্ব, শত্রুদের মোকাবিলার নীতি এবং নৈতিকতার মৌলিক শিক্ষা বর্ণিত হয়েছে। পাশাপাশি, মুসলমানদের সতর্ক করা হয়েছে যেন তারা বিভেদ সৃষ্টি করা শক্তির কবলে না পড়ে এবং নিজেদের পরিচ্ছন্ন ও সৎ চরিত্র গঠনে মনোযোগী হয়।
কুরআনের এই নির্দেশনাগুলো আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে কীভাবে আলোকবর্তিকা হয়ে উঠতে পারে, সেটিই আজকের তেলাওয়াতের মূল শিক্ষা।
১. সূরা নিসার শেষ অংশ (৮৭-১৭৬) – সমাজ, আইন ও ন্যায়বিচার ঈমান, মুনাফিক ও দ্বিমুখী আচরণ (৮৭-১০০)
- আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই, তিনি অবশ্যই সবাইকে পুনরুত্থিত করবেন।
- মুনাফিকরা কথায় ও কাজে দ্বিমুখী আচরণ করে, তারা মুসলমানদের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চায়।
- মুসলমানদের সতর্ক করা হয়েছে যেন তারা মুনাফিকদের ফাঁদে পা না দেয়।
- ন্যায়বিচারের অন্যতম অংশ হলো মুসলিমদের উচিত একজন মুসলিমকে অন্যায়ভাবে হত্যা না করা, এবং যদি ভুলবশত হত্যা করা হয়, তবে এর ক্ষতিপূরণের বিধান রয়েছে। শত্রুর মোকাবিলা ও ইসলামী সমাজের রীতিনীতি (১০১-১১৫)
- শত্রুপক্ষের আক্রমণের আশঙ্কা থাকলে সংক্ষিপ্ত সালাত পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
- মুসলমানদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে এমন ষড়যন্ত্রকারীদের বিষয়ে হুঁশিয়ার করা হয়েছে।
- আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অসীম দয়ালু, তবে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যের অধিকার নষ্ট করলে বা অন্যায়ভাবে হত্যা করলে সে কঠোর শাস্তি পাবে।
- ইসলাম সত্য ন্যায়ের ধর্ম; যারা অন্যায় ও বিদ্রোহের পথ অবলম্বন করে, তারা অবশ্যই আল্লাহর শাস্তির সম্মুখীন হবে।
নারী ও সম্পত্তির অধিকার (১১৬-১৭৬)
- সম্পত্তির উত্তরাধিকারের নিয়মাবলি পুনরায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
- এতিমদের সম্পত্তি হেফাজত করতে বলা হয়েছে, এবং অন্যায়ভাবে তা আত্মসাৎ করলে কঠিন শাস্তির হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
- সম্পত্তির বণ্টনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যেন কেউ অবিচারের শিকার না হয়।
- মুসলিম সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষা ও পারস্পরিক সহানুভূতি বজায় রাখার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
২. সূরা মায়িদার প্রথম অংশ (১-৮২) – আইন, নৈতিকতা ও আহলে কিতাব
প্রতিশ্রুতি ও চুক্তি রক্ষার নির্দেশ (১-১১)
- ইসলামে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- পশু শিকার ও খাদ্য গ্রহণ সংক্রান্ত বিধান বর্ণিত হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে যে, যেসব পশু আল্লাহর নামে জবাই করা হয়েছে, তা হালাল।
- আহলে কিতাবদের জবাই করা পশুও মুসলমানদের জন্য হালাল করা হয়েছে।
- মুসলমান পুরুষদের জন্য আহলে কিতাবদের নারীদের বিয়ে করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
ইসলামের আইনি বিধান ও সামাজিক শৃঙ্খলা (১২-৫০)
- ওজু, তায়াম্মুম ও পবিত্রতা সম্পর্কিত বিধান বর্ণিত হয়েছে।
- চুরি ও ডাকাতির শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে, যেখানে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে।
- মদ, জুয়া ও ভাগ্য নির্ধারণকারী পদ্ধতিগুলো হারাম ঘোষণা করা হয়েছে।
- নবীদের প্রতি বিশ্বাস রাখার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং যারা নবীদের মেনে চলে না, তাদের জন্য শাস্তির হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
আহলে কিতাব ও তাদের অবস্থান (৫১-৮২)
- মুসলমানদের সতর্ক করা হয়েছে যেন তারা ইহুদি ও খ্রিস্টানদের অতিরিক্ত বিশ্বাস না করে এবং তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রম সম্পর্কে সতর্ক থাকে।
- ইহুদিদের শাস্তির কারণ উল্লেখ করা হয়েছে—তারা নবীদের হত্যা করেছে, সত্যকে গোপন করেছে এবং সুদ ও ঘুষের মাধ্যমে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে।
- খ্রিস্টানদের মধ্যে কিছু লোক সত্যের অনুসারী, যারা ইসলামকে সম্মান করে এবং নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি আন্তরিক থাকে।
মূল শিক্ষা ও বার্তা:
- ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা ইসলামের মৌলিক শিক্ষা।
- মুনাফিকদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে, কারণ তারা মুসলমানদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে।
- ইসলামী সমাজব্যবস্থায় পারিবারিক ও উত্তরাধিকার আইন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- আল্লাহর বিধান মেনে চলা ছাড়া প্রকৃত মুক্তি নেই।
- ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মধ্যে যারা সত্যের অনুসারী, তাদের প্রতি সদয় হওয়া উচিত, তবে ইসলামবিরোধী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক থাকা জরুরি।
উপসংহার:
এই তেলাওয়াতের অংশ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ইসলামের বিধান পরিপূর্ণ ও সুবিচারপূর্ণ। পারিবারিক জীবন, সামাজিক ন্যায়বিচার, আর্থিক লেনদেন, ওজু, তায়াম্মুম, হালাল-হারামের সীমারেখা—এসব কিছুই মানুষের কল্যাণের জন্য নির্ধারিত হয়েছে। আমরা যেন এই শিক্ষাগুলো নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করি এবং আল্লাহর বিধান মেনে চলার চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের সত্য পথে পরিচালিত করুন—আমিন!
লেখক, ফাযেলে দারুল উলুম দেওবন্দ ও নদওয়াতুল উলামা লাখনৌ,
মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া আহলিয়া নশাসন, শরীয়তপুর
হাআমা/