প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ৭ ইসলামি দলের বৈঠক, জানিয়েছিল ৪৯ প্রস্তাবনা
প্রকাশ: ৩১ আগস্ট, ২০২৪, ১০:০৩ রাত
নিউজ ডেস্ক

|| হাসান আল মাহমুদ ||
চিফ রিপোর্টার

দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার আমন্ত্রণে শনিবার (৩১ আগস্ট) বিকেল ৩টা থেকে সরকারি বাসভবন যমুনায় দেশের ৭টি ইসলামী দলের নেতৃবৃন্দ বৈঠকে অংশ নেন। ৭ ইসলামি দলগুলো হচ্ছে- হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টি।

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন সময়ের বৈঠকে ইসলামি দলগুলোর পক্ষ হতে ৪৯টি প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়।

হেফাজতে ইসলামের ৫ দাবি

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে ছিলেন মহাসচিব মাওলানা সাজেদুর রহমান। তার সঙ্গে ছিলেন সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী ও কেন্দ্রীয় নেতা মুনীর হোসেন কাশেমী। প্রধান উপদেষ্টার নিকট হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য তুল ধরা হয়। এতে অরাজনৈতিক বৃহৎ এ সংগঠনটি থেকে ৫টি দাবি জানানো হয় :

১. সংবিধানের বৈপ্লবিক সংস্কার বা পরিবর্তন: আপনি অবগত আছেন, অতীতের বিভিন্ন সরকার তাদের ক্ষমতামুখী স্বার্থে দেশের সংবিধানকে নানা সংশোধনীর নামে ইচ্ছেমতো কাটাছেঁড়া করেছে। ফলে নানা কারণে বিদ্যমান সংবিধান বিতর্কিত এবং ফ্যাসিবাদের রক্ষাকবচ হিসেবে পরিণত হয়েছে। তাই, আমাদের দাবি, এই ত্রুটিপূর্ণ ও প্রশ্নবিদ্ধ সংবিধানের বিলোপ করে মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পূণস্থাপন পূর্বক একটি গ্রহণযোগ্য গণসংবিধান তৈরির দাবি জানাচ্ছি, যা ভবিষ্যতে কোনো ধরনের নয়া ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারিতার জন্মের পথ বন্ধ করে দিবে।

২. জাতীয় মীমাংসাপত্র প্রণয়ন: গণ-অভ্যুত্থানে দেশে যেভাবে একটি অভূতপূর্ব জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল, সেই ঐক্যকে আরো সুসংগত করার লক্ষ্যে একটি ‘জাতীয় মীমাংসাপত্র’ (ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন চার্টার) প্রণয়ন জরুরি। কারণ, এখনো আমরা দেশে অস্থিরতা ও তীব্র জিঘাংসা দেখতে পাচ্ছি। এখনো এক পক্ষের ব্যাপারে অন্য পক্ষের ভীতি, বিদ্বেষ ও আশঙ্কা রয়ে গেছে। মানবিকতা, প্রতিটি মানুষের নাগরিক নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত করতে এবং অতীতের সমস্ত ভেদবুদ্ধি দূর করতে অতিসত্বর একটি জাতীয় মীমাংসাপত্র প্রণয়নের উদ্যোগ নিন।

৩. জাতীয় শিক্ষানীতি ও পাঠ্যবইয়ের আমূল পরিবর্তন: আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামলে জাতীয় পাঠ্যবই নিয়ে একের পর এক বিতর্ক উঠেছিল। সর্বশেষ নতুন জাতীয় পাঠ্যবইয়ে হিন্দুত্ববাদ ও ফ্যাসিবাদের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সেই বিতর্কিত বিষয়সমূহ বাদ দিয়ে বিজ্ঞ শিক্ষাবিদ ও পণ্ডিতদের তত্ত্বাবধানে নতুনভাবে জাতীয় শিক্ষানীতি ও পাঠ্যবইয়ের সংস্কার সাধন করুন, যা আমাদের ধর্ম, জাতীয় চেতনা ও ঐতিহ্য এবং দেশের কর্মসংস্থানের প্রয়োজনীয়তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।   

৪. মামলা প্রত্যাহার: হেফাজত নেতা কর্মী ও আলেমদের বিরুদ্ধে ২০১৩ ও ২০২১ সালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের দায়েরকৃত সমস্ত মিথ্যা মামলা দ্রুত প্রত্যাহার করুন। আপনি জানেন, আলেম-ওলামা ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলে কতটা নির্যাতন, হত্যা ও গুম-খুনের শিকার হয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দশ্যপ্রণোদিত শত শত মিথ্যা মামলা আলেমদের বিরুদ্ধে করা হয়েছে। অতিসত্বর সেই মিথ্যা মামলাগুলো প্রত্যাহার করার জন্য দাবি জানাচ্ছি।          

৫. শাস্তি দাবি: গণহত্যাকারী ও ফ্যাসিস্টদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ১৩ প্রস্তাবনা :

আজ শনিবার (৩১ আগস্ট) বিকেল ৩টায় অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার রাজনৈতিক সংলাপে অংশ নেয় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দলটির আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম পীর সাহেব চরমোনাই’র নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল বৈঠক করেছে। প্রতিনিধি দলের অন্য সদস্যরা হলেন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম, মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমদ, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, যুগ্ম-মহাসচিব ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মদ আশরাফুল আলম। বৈঠকে দলটির পক্ষ হতে ১৩টি প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয় :

১. বিদ্যমান সংবিধান নিয়ে নানাবিধ বিতর্ক আছে। তাছাড়া বিগত দিনের ক্ষমতাসীনরা দলীয় স্বার্থে সংবিধানে নানারকম পরিবর্তন করেছে। এ জন্যে বর্তমান সংবিধানকে বাতিল করে একটি সাংবিধানিক কমিশন গঠন করে নতুন সংবিধানের খসড়া তৈরি করা এবং গণভোটের মাধ্যমে তা অনুমোদন করা।

২. গ্রহণযোগ্য তদন্ত কমিশন ও স্বতন্ত্র ট্রাইব্যুনাল গঠন করে জুলাই গণহত্যাকান্ডের বিচার করতে হবে। একই সাথে গত ১৬ বছরে সংগঠিত সকল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক হত্যাযজ্ঞ, গণহত্যা, গুম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার করতে হবে। এক্ষেত্রে যে সকল ব্যক্তি বা সংগঠন দোষী সাব্যস্ত হবে, তাদেরকে রাজনীতি ও নির্বাচন থেকে নিষিদ্ধ করতে হবে।

৩. তদন্ত সাপেক্ষে বিগত বছরের সকল দুর্নীতিবাজ ও বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের সকল সম্পত্তি ক্রোক করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করতে হবে এবং বিদেশে পাচারকৃত টাকা ফেরত আনবার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিগত বছরে যারা ক্ষমতায় ছিলেন তাদের সম্পদের হিসাব নিতে হবে। সকল দুর্নীতি ও টাকা পাচারের শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে।

৪. আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন, বিচার বিভাগসহ প্রজাতন্ত্রের যে সকল কর্মচারী আইন, সংবিধান, শপথ লঙ্ঘন করে অপেশাদার আচরণ করেছেন তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।

৫. পতিত ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচার আওয়ামী সরকার নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসনকে ব্যবহার করে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি ৩টি ভুয়া জাতীয় নির্বাচন করেছে। এসব একতরফা, ভুয়া, পাতানো ও ডামী নির্বাচনের মাধ্যমে তারা তাদের অবৈধ ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করেছে। যারা তাদের এসব অবৈধ ও প্রহসনের নির্বাচনে সহযোগিতা করে আওয়ামী লীগকে অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকার সুযোগ করে দিয়েছে তারাও সমান অপরাধী। অতএব, ৩টি অবৈধ ও প্রহসনের নির্বাচন পরিচালনাকারী ৩টি নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তা তাদের অবৈধ কাজের কুশিলব ছিল, তাদেরকে আইনের আওতায় এনে শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে কেউ অবৈধ নির্বাচনের সাহস না করে।

৬. বর্তমান নির্বাচন কমিশন বাতিল করে নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠন করতে হবে এবং অবাধ, সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন (চজ) পদ্ধতি চালু করতে হবে।

৭. নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গণমাধ্যম এই পাঁচটি ক্ষেত্রে আমূল এবং ব্যাপক সংস্কারের কথা বলেছেন মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা। আমরাও মনে করি এসব প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। কারণ, বিগত সরকার অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে ফেলেছে। অর্ন্তর্র্বতীকালীন সরকার এসব প্রতিষ্ঠানগুলো কতদিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন করবে তা নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন। অতএব, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ প্রত্যাশা করে, অর্ন্তর্র্বতীকালীন সরকার তাদের সংস্কার কার্যক্রমের ধরণ ও প্রক্রিয়া কি হবে এবং কতদিনের মধ্যে সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করবে, তা অতিদ্রুত প্রকাশ করবে এবং জাতীয় নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করবে।

৮. আওয়ামী দুঃশাসনে বিগত ১৬ বছরে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এদেশের সাধারণ শিক্ষাখাতের মান ও নৈতিকতা। এই ক্ষতি দ্রুত সময়ের মধ্যে কাটিয়ে উঠার লক্ষ্যে দেশপ্রেমিক শিক্ষাবিদ ও উলামায়ে কেরামের সমন্বয়ে একটি জাতীয় শিক্ষাকমিশন গঠন করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

৯. ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর ঢালাওভাবে রাতারাতি যে সব নিয়োগ, বদলি ও অব্যাহতি দেয়া হয়েছে এসব বিশ্লেষণের জন্য একটি কমিশন গঠন করতে হবে।

১০. ঢালাওভাবে হয়রানীমূলক এবং মিথ্যা মামলা করা যাবে না। ইতিমধ্যে যদি কোন নিরপরাধ ব্যক্তির বিরুদ্ধে শুধু রাজনৈতিক কারণে মিথ্যা মামলা হয়ে থাকে তা প্রত্যাহার করতে হবে।

১১. দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনা ও অনুভূতির বিরুদ্ধে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না।

১২.নতুন করে চাঁদাবাজি, দখলদারি ও হয়রানী কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।

১৩. নব্য চাঁদাবাজ, দখলবাজ, অবৈধ অস্ত্রধারী ও সন্ত্রাসীদের দমন করতে সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্রুত যৌথ অভিযান শুরু করতে হবে।

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ৬ প্রস্তাবনা :

শনিবার (৩১ আগস্ট) বিকেলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মতবিনিময় করে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের নেতৃত্বে ছিলেন দলটির আমির মাওলানা ইউসুফ আশরাফ। তার প্রতিনিধি দলে ছিলেন মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক ও যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা জালাল উদ্দিন। মতবিনিময় সভায় লিখিত আকারে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের পক্ষ থেকে দলটির মহাসচিব মুহাম্মদ মামুনুল হক প্রধান উপদেষ্টা বরাবর লিখিতভাবে ৬টি প্রস্তাব তুলে ধরেন :

১. প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা :

ক. নির্বাচন সংক্রান্ত সংস্কার: জাতীয় নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগকারীদের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। সে জন্য আসনভিত্তিক বিজয়ী সংসদ সদস্যদের বাইরে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলসমূহের প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে সংসদে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা।

খ. নির্বাচন বিধি সংক্রান্ত সংস্কার: প্রার্থীদের নিজস্ব প্রচারণার পরিবর্তে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে প্রতিদ্বন্দি প্রার্থীদের প্রচার ও প্রকাশনার ব্যবস্থা করা। যোগ্য সৎ ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা।

২. সাংবিধানিক সংস্কার :

ক. বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে প্রদত্ত একচ্ছত্র ক্ষমতা স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দেয়। তাই এ ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ভারসাম্য সৃষ্টি করা।

খ. দুই মেয়াদের বেশি একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের ব্যবস্থা বন্ধ করা।

গ. প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দলীয় পদ থেকে পদত্যাগের বিধান করা।

ঘ. সংসদ সদস্যদের দলীয় সিদ্ধান্তের বাহিরে ভোট দেওয়ার সুযোগ রাখা।

৩. বিচার ব্যবস্থা: বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করা। বিচার বিভাগে সরকারের হস্তক্ষেপ মুক্ত রাখার স্বার্থে বিচারপতি নিয়োগ ও বিয়োগের জন্য জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা।

৪. শিক্ষা ব্যবস্থা: শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক বিতর্কিত বিষয়সমূহ বাদ দিয়ে ধর্মীয় ও নৈতিকতা শিক্ষা সংযোজন করা।

৫. পুলিশ ও প্রশাসন: পুলিশ ও প্রশাসনকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত রাখা। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাদেরকে ব্যবহারের পথ বন্ধ করা।

৬. কুরআন সুন্নাহ বিরোধী আইন/নীতি প্রনয়ণ না করা।

বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের ৬ দাবি  

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আজ ৩১ আগস্ট, শনিবার, বিকাল ৪ টায় খেলাফত আন্দোলনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদীর পক্ষ হতে ৬টি দাবি জানানো হয়।

(১) একটি অবাধ অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা।

(২) রাষ্ট্র সংস্কার ও সকল ক্ষেত্রে শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে ঘুষ চাঁদাবাজি, দুর্নীতির পথ চিরতরে বন্ধ করা,

(৩) বিগত সরকারের বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনা এবং

(৪) জড়িত অপরাধীদের বিচার, হেফাজতে ইসলাম এবং বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী সরকারের বর্বর হত্যাকান্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচার,

(৫) আলেম-ওলামাসহ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে সকল মিথ্যা ও রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার এবং

(৬) দ্রব্যমূল্য কমিয়ে জনগণের ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যে আনা।

খেলাফত মজলিসের ১৯ প্রস্তাবনা

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক হয় খেলাফত মজলিসের। দলটির নেতৃত্বে ছিলেন আমীর মাওলানা আব্দুল বাছিত আজাদ। প্রতিনিধি দলে ছিলেন দলটির মহাসচিব অধ্যাপক আহমেদ আবদুল কাদের, নায়েবে আমির মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব জাহাঙ্গীর হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব মুনতাসীর আলী ও প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক কাজী মিনহাজুল ইসলাম মিলন। সংলাপে উপস্থাপন করা হয় ১৯ প্রত্যাশা ও সংস্কার প্রস্তাবনা :

১. মানবতাবিরোধী ও গণহত্যাকারী খুনী হাসিনাকে দ্রুত দেশে এনে বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা এবং স্বৈরাচারের দোসর, লুটেরা ও দুর্নীতিবাজদের ‘বিশেষ ট্রাইবুনালে’ দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার ব্যবস্থা করতে হবে।

২. ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকালে শহীদ, চিরতরে অক্ষম ও আহতদের দ্রুত তালিকা প্রণয়নপূর্বক ক্ষতিগ্রস্তদের অবস্থা অনুযায়ী আশু ও ক্ষেত্র বিশেষে দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা এবং আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে জুলাই বিপ্লবে শহীদদের ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণা করতে হবে।

৩. দেশের ধ্বংসপ্রায় বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ, প্রশাসনিক বিভাগ, অর্থ ও ব্যাংকিং বিভাগ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিভাগসহ সকল বিভাগকে দ্রæত সংস্কারের আওতায় এনে মানুষের কল্যাণে কর্মক্ষম করে তুলতে হবে।

৪. দেশের আইন সভা-জাতীয় সংসদ, বিচার বিভাগ ও প্রশাসনিক বিভাগ যেনো স্বাধীনভাবে ও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সমন্বয় করে স্বার্থক ও সুন্দরভাবে চলতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। একই সাথে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে।

৫. ভারতের সেবাদাস পতিত হাসিনা সরকারের সাথে ভারতের সম্পাদিত সকল চুক্তি পুণর্মূূল্যায়ন এবং দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিল ও ক্ষেত্র বিশেষে চুক্তির ধারা সংশোধন করতে হবে।

৬. বিডিআর হত্যাকাণ্ডের অপ্রকাশিত তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ, প্রয়োজনে নতুন তদন্ত কমিশন গঠন এবং প্রকৃত দায়ীদের সনাক্ত করে দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে। একই সাথে শাপলা চত্ত্বর হত্যা, সাগর-রুনি হত্যা, ‘আয়না ঘর’ কাণ্ডসহ সকল গুম ও খুনের যথাযথ বিচার করতে হবে।

৭. রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও দমন-পীড়নের উদ্দেশ্যে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মী, আলেম-উলামাসহ বিরোধী মতের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের সময়ে দায়েরকৃত সকল মিথ্যা মামলা দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রত্যাহার করতে হবে।

৮. জুলাই বিপ্লবের মূল নিয়ামক ছাত্র-জনতার ঐক্যকে সংহত ও এগিয়ে নিতে হবে। বিপ্লব বিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে গড়ে উঠা ঐক্যকে শক্তিতে পরিণত করতে হবে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখতে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে আরো আধুনিক ও শক্তিশালী করা এবং সক্ষম সকল নাগরিককে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের স্থায়ী ব্যবস্থা করতে হবে।

৯. দ্রুত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে দ্রব্যমূল্য কমানো, ভারতের পানি আগ্রাসন মোকাবিলা ও পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সাম্প্রতিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।

১০. বিপ্লব পরবর্তী পরিস্থিতির উপর দ্রুত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, সংস্কার কার্যক্রম জোরদার এবং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে যৌক্তিক দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।

১১. আওয়ামী দলীয় ক্যাডারদের হাতে থাকা সকল বৈধ-অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

১২. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।

রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আশু সংস্কার বিষয়ে খেলাফত মজলিসের প্রস্তাবনা

১. সরকার ব্যবস্থায় সংস্কার: দেশের বর্তমান ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীকে যে ব্যাপক ক্ষমতা ও স্বেচ্ছাচারী হওয়ার প্রভূত সুযোগ দেয়া হয়েছে তা দূরীকরণের জন্য প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য বিধান করতে হবে। একই সাথে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি কেউই যেন একাধিক্রমে দুই মেয়াদের বেশী স্বপদে থাকতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। কোন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি দলীয় প্রধান থাকতে পারবেন না।

২. নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার: অবিলম্বে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে দ্রুত এগিয়ে নেয়ার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একই সাথে দীর্ঘ মেয়াদে দল নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থা চালু করা। সৎ ও যোগ্য প্রার্থীরা যাতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে সেজন্যে নির্বাচনী ব্যয় কমানো, শুধু নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে প্রার্থীদের নির্বাচনী সভার আয়োজন করা এবং অর্থ ও পেশী শক্তির দাপট নিবারণ-সহ সকল অব্যবস্থাপনা দূর করতে হবে। নিম্ন কক্ষে সংসদীয় আসন ৫০০ তে উন্নীত করার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারী দল থেকে স্পীকার ও বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পীকার করতে হবে।

৩. স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সংষ্কার: স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তাকে স্থানীয় উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন বিভাগ স্থানীয় সরকারের অধীনে দিতে হবে। সংসদ সদস্যগণ যাতে দেশের আইন ও নীতি প্রণয়নের কাজে ব্যস্ত থাকেন ও স্থানীয় সরকারের কাজে কোনরূপ হস্তক্ষেপ না করেন তার কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

৪. প্রশাসনিক সংষ্কার: সীমাহীন দলীয়করণের মাধ্যমে প্রশাসনের সর্বস্তরে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার যে প্রচণ্ড ক্ষতের সৃষ্টি করে গেছে তা দ্রæত দূর করার জন্য প্রশাসনিক সংষ্কার কমিশন গঠন করে জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন-সহ সর্বত্র সুষ্ঠু নিয়মনীতি প্রতিষ্ঠা ও শৃঙ্খলা বিধান নিশ্চিত করতে হবে যাতে প্রশাসন ক্ষমতাসীন দলের লেজুড়বৃত্তির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।

৫. অর্থ ও ব্যাংক ব্যবস্থা সংস্কার: দুর্নীতিবাজ মাফিয়া হাসিনা সরকার দেশের সামগ্রীক অর্থনীতি ও ব্যাংক ব্যবস্থায় যে সীমাহীন দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা ও দূরাবস্থা সৃষ্টি করেছে দ্রুত আর্থিক সংস্কার কমিশন গঠন করে তা উত্তরণে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও ইতিবাচক ও আস্থার পবিবেশ দ্রুত ফিরিয়ে আনতে হবে। দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রণয়নে গঠিত জাতীয় কমিটি যাতে দ্রুত তা প্রণয়ন ও প্রকাশ করে তার ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্নীতিগ্রস্থ ব্যক্তিদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে।

৬. শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কার: দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে মানসম্মত নৈতিক, কারিগরী ও তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর যুগোপযোগী শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে দ্রুত শিক্ষা কমিশন গঠন, নতুন শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তণ এবং চলমান শিক্ষানীতি ও ক্রম বাতিল করতে হবে।

৭. আইনী সংস্কার: ব্যাপকভাবে সমালোচিত বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল, আইসিটি ও ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট সংশোধন এবং অনাস্থা প্রস্তাব ও বাজেট প্রস্তাব পাশের ক্ষেত্র ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ প্রয়োগের ধারা বাতিল করতে হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সমুন্নত করার জন্য ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার প্রবর্তিত বিচারপতি অভিশংসন আইন বাতিল করতে হবে। বিকেন্দ্রীকরণের অংশ হিসেবে প্রতিটি প্রশাসনিক বিভাগে হাইকোর্টের বেঞ্চ স্থাপন করতে হবে।

উল্লেখ্য, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জমিয়তে উলামে ইসলামের একাংশের নেতৃত্ব দিয়েছেন সংগঠনের মহাসচিব মাওলানা মনজুরুল ইসলাম আফেন্দী। অপরদিকে নেজামে ইসলামের নেতৃত্ব দিয়েছেন নির্বাহী সভাপতি মাওলানা আশরাফুল হক। তার সঙ্গে আছেন মহাসচিব মাওলানা মোমিনুল ইসলাম। দল দুটোর পক্ষ হতে কী দাবি জানানো হয়েছিল তা জানা যায়নি। এ বিষয়ে জানতে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে সাড়া পাওয়া যায়নি।

হাআমা/