ফাজায়েলে আমল : অভাবিত বিপ্লবের কথামালা!
প্রকাশ:
০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ০৪:৩০ দুপুর
নিউজ ডেস্ক |
|| আবুল ফাতাহ কাসেমী || পূর্বসূরির চিন্তা ও চেতনার দিকপাল শায়খুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়া রহ.। বিশ্বব্যাপী দাওয়াত তাবলিগের প্রধান মুরব্বি ও দিকনির্দেশক ব্যক্তি হিসেবে তিনি সারা বিশ্বে পরিচিত ছিলেন। আন্তর্জাতিক এই ঈমানি আন্দোলনের সিলেবাস তাঁর হাতে তৈরি হয়েছে। উপমহাদেশের প্রখ্যাত এই হাদিস বিশারদ তাঁর ইলমি গবেষণা, আত্মশুদ্ধি অর্জন ও বিতরণ এবং সামগ্রিক দীনি কাজের জন্য প্রাসঙ্গিক হয়ে আছেন যুগ যুগ ধরে। দাওয়াত তাবলিগের নেসাবের জন্য রচিত তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ ফাজায়েলে আমল লাখো-কোটি মানুষের জীবন পরিবর্তন করেছে। চুম্বক শক্তির মতো দীনভুলা মানুষকে এই গ্রন্থ দীনের পথে এনেছে। লাখো হৃদয় জয় করে পৃথিবী সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে ফাজায়েলে আমল। এই গ্রন্থ তাঁর অতল-ছোঁয়া জ্ঞান পাণ্ডিত্যের উজ্জ্বল সাক্ষী। এ গ্রন্থের মাধ্যমে পৃথিবীব্যাপী তৈরি হয়েছে লাখ লাখ স্বপ্ন-সিদ্ধতার গল্প। মজার বিষয় হলো, এই গ্রন্থ গ্রামের মজদুর শ্রেণি কিংবা শহুরে এলিট শ্রেণি সবাইকে একসাথে টানে। একজন বিদগ্ধ শাস্ত্রীয় পণ্ডিত কীভাবে সাধারণ মানুষের ভাষায় সহজ করে কথা বলেন কিংবা দীনের জটিল বিষয় পানির মতো সহজ করে উম্মাহর সব শ্রেণির সামনে পেশ করেন তা এই গ্রন্থ পাঠ করলে সহজেই বোঝা যায়। ফাজায়েলে আমল এ যেন বিশ্বাসের হৃদিপদ্ম কিংবা প্রেমকাব্য! এ গ্রন্থ উম্মাহকে সাধনায় বিশ্বাসে আদর্শে ও শপথে বলীয়ান করে অনায়াসে। এ গ্রন্থের কাছে মুগ্ধতায় পরাজিত পৃথিবীর তাবৎ মানুষ। বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এই গ্রন্থ নিয়ে কপালে ভাঁজ পড়ার মতো কিছু তথ্য রয়েছে। সর্বশেষ ২০০২ সালে প্রকাশিত একটি তথ্য ও গবেষণায় উঠে এসেছে এই কিতাব বিশ্বব্যাপী মাকবুল হওয়ার অভাবিত দলিল! ফাজায়েলে আমল কিতাবটি সর্বমোট নয়টি কিতাবের সমন্বয়ে রচিত। ফাজায়েলে কুরআন, ফাজায়েলে রমজান, ফাজায়েলে তাবলিগ, হেকায়েতে সাহাবা, ফাজায়েলে নামাজ, ফাজায়েলে জিকির, ফাজায়েলে হজ, ফাজায়েলে সাদাকাত ও ফাজায়েলে দরুদ শরিফ। প্রত্যেকটি কিতাব লেখার রয়েছে আলাদা আলাদা প্রেক্ষাপট ও সময়। ২০০২ সালের সর্বশেষ তথ্যমতে পৃথিবীর প্রায় একত্রিশটি ভাষায় এই গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সৌদি আরব, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, ইরান, উজবেকিস্তান, বার্মা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইংল্যান্ড, আফ্রিকা, আমেরিকা, কানাডা, তুরস্ক, জাপান, জাম্বিয়া, শ্রীলংকা, ফ্রান্স, ফিলিপাইন, কম্বোডিয়া, কেনিয়া, পর্তুগালসহ পৃথিবীর প্রায় ত্রিশটি দেশের ১৪৫ জন বিদগ্ধ আলেম এই গ্রন্থের ওপর ইলমি কাজ ও অনুবাদ আঞ্জাম দিয়েছেন। তাছাড়া ১৯টি দেশের ২১৫টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এই কিতাবের প্রকাশনার কাজ করে যাচ্ছে। প্রাপ্ত রেকর্ড অনুযায়ী, কেবল ভারত-পাকিস্তানের ৭৪টি লাইব্রেরি এ গ্রন্থটি যুগ যুগ ধরে মুদ্রণ করে যাচ্ছে। (তথ্যটি ২০০২ সালের। বর্তমানে এ সংখ্যা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা সহজেই অনুমেয়) হজরত শাইখুল হাদিস জাকারিয়া রহ. ফাজায়েলে কুরআন কিতাবটি আজ থেকে ৯৫ বছর আগে ১৩৮৪ হিজরি মোতাবেক ১৯২৯ সালে লেখেন। এভাবেই ধীরে নয়টি সিরিজ তিনি পূর্ণ লেখা শেষ করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ইতিপূর্বে সবগুলো আলাদা আলাদা ছেপে এলেও বর্তমানে একসাথে এক ভলিয়মে ছেপে আসছে। ফাজায়েলে আমল কিতাবটি নিয়ে বিশ্বের বিদগ্ধ মনীষীদের মূল্যায়ন ও গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপ্তি যেমন আছে ঠিক তেমনি অনেক অপাঙ্ক্তেয়দের রয়েছে বিভিন্ন প্রশ্ন ও যুক্তিতর্ক। অনেকে এই কিতাবের অনেক রেফারেন্সের ওপর প্রশ্ন তুলেছেন। আবার অনেক মুহাক্কিক আলেম এর জবাবও দিয়েছেন। জবাবি গ্রন্থের সংখ্যাও কম নয়। ১. এ বিষয়ে প্রথম কিতাব লিখেছেন লেখক নিজেই। তাঁর সেই জবাবি লেখাগুলো সংকলন করেছেন মাওলানা মুহাম্মদ শাহেদ সাহারানপুরি। ‘কুতুব ফাজায়েল পর ইশকালাত আওর উনকে জওয়াবাত’ নামে এ কিতাবটি প্রথম প্রকাশিত হয় ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫ মোতাবেক ১৩৯৫ হিজরিতে। কুতুবখানা ইশাআতুল উলুম সাহারানপুর থেকে এটি প্রকাশিত হয়। ২. ‘ফাজায়েলে আমাল পর চান্দ শুবুহাত কা জওয়াব’ নামে লেখেন বিদগ্ধ মনীষী মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ লুধুয়ানবী রহ.। করাচির নাজিমাবাদের একটি লাইব্রেরি এটি প্রকাশ করে। ৩. ‘ফাজায়েলে আমল পর ইতিরাজাত কে জওয়াবাত’ নামে লেখেছেন মাওলানা আবদুল কারি মিফতাহি রহ.। মহারাষ্ট্রের খলিল বুকডিপো এটি প্রকাশ করে। ৪. তাবেশ মাহদি নামক এক ব্যক্তির কিছু প্রশ্নের জবাবে ‘হাসেলে মুতালাআ’ নামে কিতাব লেখেন আগুরার মুফতি মাওলানা আবদুল কুদ্দুস রহ.। শুহাইব ব্রাদার্স ১৯৪৮ সাল মোতাবেক ১৪০৪ হিজরিতে কিতাবটি প্রকাশ করে। ৫. ‘তাবলিগি নেসাব এক মুতালাআ কা তাআকুবি জায়িজাহ’ নামে মহারাষ্ট্র বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার মহাসচিব মাওলানা আবদুল্লাহ কাসেমী রহ. একটি কিতাব লেখেন। মাদরাসা জিয়াউল উলুমের প্রকাশনা বিভাগ ১৪০৪ হিজরি মোতাবেক ১৯৮৪ সালে এটি প্রকাশ করে। ৬. ‘ফাজায়েলে আমল পর ইতিরাজাত কে মুহাক্কাকানা জওয়াবাত’ নামে দারুল উলুম করাচির মুফতি মাওলানা আসগর আলি রাব্বাানি একটি কিতাব লেখেন। দারুল উলুম করাচির রাব্বানি একাডেমি ১৯৯২ সালে এটি প্রকাশ করে। ৭. ‘ফাজায়েলে আমল ইতিরাজাত এক উসুলি জায়িজাহ’ নামে দারুল উলুম দেওবন্দের হাদিস বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক বিদগ্ধ আলেম মাওলানা আবদুল্লাহ মারুফি একটি কিতাব লেখেন। দেওবন্দের মাকতাবায়ে উসমানিয়া ২০০৫ সালে এটি প্রকাশ করে। এ কিতাবটির বাংলা ভাষায় অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছে। ৮. ‘তাহকিকুল মাকাল ফি তাখরিজি আহাদিসি ফাজায়িলিল আমল’ নামে আরবিতে শায়েখ লুতফুর রহমান নামে এক আলেম এটি রচনা করেছেন। ৯. ফতোয়া মাহমুদিয়ার পাঁচ নাম্বার খণ্ডে তাবলিগ জামাতের ওপর উত্থাপিত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন মুফতিয়ে আজম মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহি রহ.। এছাড়াও পৃথিবীর আনাচে কানাচে এ জাতীয় আরও বহু গ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে। ১০. এক আলমি ও বাইনাল আকওয়ামি কিতাব ফাজায়েলে আমাল। সাহারানপুর মাদরাসার সেক্রেটারি মাওলানা শাহেদ সাহারানপুরি এ কিতাবটি লেখেন। ২০০২ সালে সাহারানপুরের মাকতাবায়ে ইয়াদগারে শায়েখ এটি প্রকাশ করে। ফাজায়েলে আমল নয়টি কিতাবের সংকলন। প্রত্যেকটি কিতাব বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। প্রত্যেকটি কিতাব লেখার পেছনের তথ্য ও চমৎকার কিছু স্বপ্ন রয়েছে। যেমন নয়টি কিতাবের মধ্যে সর্বপ্রথম এ কিতাবটি লেখেন হযরত শাইখুল হাদিস জাকারিয়া রহ.। কুতবে আলম রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি রহ.-এর বিশিষ্ট খলিফা মাওলানা ইয়াসিন রহ.-এর নির্দেশে ১৯৩০ সালে এক মাসে এই কিতাবটি লেখেন। এই কিতাব লেখার সময় শায়েখ মুয়াত্তা মালেকের বিখ্যাত শরাহ আওজাযুল মাসালিকের কাজও করছিলেন। এ কিতাবে প্রথমে কুরআনের ফজিলত বিষয়ক চল্লিশ হাদিস, কুরআনের হুকুম আহকাম সংশ্লিষ্ট সাতটি আয়াত অর্থ ও ব্যাখ্যাসহ লেখেছেন। শেষে চল্লিশ হাদিস আরও যুক্ত করেছেন। এ কিতাবের প্রথম এডিশন ১৩৫০ হিজরিতে সাহারানপুরের মাকতাবায়ে ইয়াহইয়াবী থেকে প্রকাশিত হয়। এরপর ভারতের ২৯টি, পাকিস্তানের ৪৫টি প্রকাশনী তা বের করে। এছাড়াও পৃথিবীর বিশের অধিক ভাষায় এর অনুবাদ প্রকাশিত হয়। সবচেয়ে বেশি অনুবাদ হয় বাংলা ভাষায়। বাংলাদেশে ফাজায়েলে কুরআনের অনুবাদ আবার হেকায়েতে সাহাবা কিতাবটি ১৩৫৩ হিজরি থেকে আলা হযরত আবদুল কাদের রায়পুরী রহ. হজরত শায়েখ রহ.কে এই কিতাবটি লেখার জন্য বারংবার তাগাদা দিচ্ছিলেন। দীর্ঘ চার বছরের নির্দেশ সত্ত্বেও শায়েখ নিজের বিনয়ের কারণে অপারগতা প্রকাশ করছিলেন। ১৩৫৭ হিজরির সফর মাস মোতাবেক ১৯৩৮ সালের ২১ এপ্রিল মিরাঠের এক সফরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তাররা কয়েক মাস ব্রেনের ওপর চাপ নিতে নিষেধ করেন এবং রেস্টে থাকতে বলেন। কিন্তু এ সময়কে গনিমত মনে করে অসুস্থতার মধ্যেই কিতাবটি লেখা শুরু করেন এবং ১৩৫৭ হিজরির শাওয়াল মোতাবেক ১৯৩৮ সালের ৫ ডিসেম্বর শেষ করেন। কিতাবে বারটি পরিচ্ছেদ ও একটি পরিশিষ্ট রয়েছে। কিতাবে হজরত সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর তাকওয়া, দুনিয়াবিমুখতা, ইলমি ও দীনি ব্যবস্থা, জান মাল কুরবানি করার অসামান্য ঘটনা ইত্যাদি খুবই সাবলীল ভাষায় লেখা হয়েছে। শেষে সাহাবায়ে কেরামের ফজিলত তাদের ব্যাপারে উম্মাহর দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। লাখনুর বিখ্যাত নওল কিশোর প্রেস থেকে হেকায়েতে সাহাবার তৃতীয় এডিশন ১৩৬৩ হিজরিতে প্রকাশিত হয়। এরপর ভারতে প্রায় ৭৪টি লাইব্রেরি থেকে ধারাবাহিক প্রকাশিত হতে থাকে। ভারতে এই কিতাবের প্রায় ১৩টি অনুবাদ ও ভারতের বাইরে ৩৫টি অনুবাদ বের হয়। এভাবে ফাজায়েলে আমলের প্রত্যেকটি কিতাবই পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে মুসলিম উম্মাহকে হেদায়েতের পথে টেনে আনছে। অনেক বিদগ্ধজনদের অভিমত, বর্তমানে পৃথিবীতে কুরআনের পর সবচেয়ে পঠিত গ্রন্থ এ ফাজায়েলে আমল। একটি গ্রন্থ ও গ্রন্থের লেখক কীভাবে পৃথিবীর লাখো মানুষের হৃদয় জয় করে চলেছে সেটা ভেবে কূল-কিনারা পাওয়া যায় না। লেখক: মাদরাসা শিক্ষকসস, লেখক ও অনুবাদক কেএল/ |