গাজা সংকট: নেতানিয়াহু সরকারের জন্য যে পরিণতি ডেকে আনতে পারে
প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর, ২০২৩, ০৩:৫৪ দুপুর
নিউজ ডেস্ক

ইহুদিবাদী ইসরাইল বহুদিন ধরে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তারা নানা উপায় খুঁজছিল। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আরব দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক স্থাপন। কিন্তু সাম্প্রতিক গাজা পরিস্থিতি ইসরাইলের সেই চেষ্টাকে কার্যত ব্যর্থ করে দিয়েছে। এ কারণে ইসরাইল সীমাহীন বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে গাজায়। তবে হামাসের সফল অভিযানে নেতানিয়াহু সরকারের জন্যও খারাপ পরিণতি অপেক্ষা করছে।

ইহুদিবাদী ইসরাইল ফিলিস্তিনের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের কাছে ঐতিহাসিক পরাজয়ের পর, এখন সেই লজ্জা ঢাকার জন্য তারা গাজার বেসামরিক মানুষজনের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা চালানোর পথ বেছে নিয়েছে। ইসরাইল গাজা অবরোধ আরো জোরদার করেছে এবং এই এলাকার লাখ লাখ  মানুষের কাছে পানি, বিদ্যুৎ, খাদ্য ও ওষুধ পৌঁছতে দিচ্ছে না। পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। এভাবেই দিন দিন ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধের পাল্লা ভারি হচ্ছে। ইসরাইল আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত ফসফরাস বোমার ব্যবহার করে বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের হত্যা করে নির্মমতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।  গাজায় ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য উপমন্ত্রী 'আনাতোলিয়া নিউজ এজেন্সিকে' বলেছেন যে, গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনে আহতদের মধ্যে ৬০ শতাংশই হচ্ছে নারী ও শিশু। বিদ্যুৎ বিভ্রাট, জেনারেটর ও অ্যাম্বুলেন্সের জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানীর অভাব, ইসরাইলি আক্রমণ প্রভৃতি কারণে প্রতিদিন হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। পরিস্থিতি এতোটাই ভয়াবহ যে আহতদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমে আসছে। 

ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত গণহত্যা চালানো  ছাড়াও সেখানে এখন ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে গাজা খুবই ক্ষুদ্র একটি এলাকা এবং ঘন জনবসতির কারণে বিপর্যয়ের মাত্রা অনেক বেশি। মাত্র ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১০ কিলোমিটার প্রশস্ত এই অঞ্চলে ২৩ লাখ লোক বাস করে এবং প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ৬ হাজার মানুষ খুব কঠিন ও দুর্বিসহ পরিস্থিতিতে বাস করে। ১৭ বছর আগে এই অঞ্চলটিতে হামাস সংগঠন বিপুল ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে সম্মিলিতভাবে তাদের ওপর অবরোধ চাপানো হয়েছে। বর্তমানে সেখানে পানি, খাদ্য ও ওষুধের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে এবং বিমান হামলার তীব্রতার কারণে গাজার জনজীবনে দুর্বিসহ পরিস্থিতি নেমে এসেছে। জনসংখ্যার উচ্চ বৃদ্ধির কারণে গাজায় তরুণদের সংখ্যা বেশি এবং এর বাসিন্দাদের একটি বড় সংখ্যক শিশু ও কিশোর। এ কারণে সেখানে মানবিক বিপর্যয়ের মাত্রা অনেক বেশি।

নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, গাজা আক্রমণের শুরুতে ইসরাইল সমুদ্র, স্থল ও আকাশ পথে ভয়াবহ যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত। যুদ্ধাপরাধের মধ্যে রয়েছে, বেসামরিক নাগরিকদের উপর নির্বিচারে বোমা হামলা, শিশু ও নারীদের হত্যা, বেসামরিক গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংস করা এবং মসজিদ ও হাসপাতালে হামলা চালাচ্ছে ইসরাইল।

জেনেভা কনভেনশনসহ আন্তর্জাতিক যেকোনো আইন অনুযায়ী বেসামরিক জনগণ এবং বেসামরিক স্থানগুলোতে নির্বিচারে হামলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এই কাজগুলো সুস্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জেনেভা কনভেনশনের ৩৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, অধিকৃত এলাকায় এমন কোনো ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া উচিত নয় যা তিনি ব্যক্তিগতভাবে করেননি। এ ছাড়া, বেসামরিক নাগরিকদের শাস্তি দেয়া, হুমকি ও ভয় দেখানো, বেসামরিক লোকদের ধরে নিয়ে যাওয়া কিংবা সম্পদ লুট করা নিষিদ্ধ। তাই এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ইহুদিবাদী শাসকগোষ্ঠী গাজা যুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে অপরাধযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে।

ইসরাইল গাজায় যে তাণ্ডব চালাচ্ছে তা কাপুরুষতা। গাজায় ইসরাইলি বর্বরতার সাথে 'আল-আকসা ঝড়' অভিযানের কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ আল-আকসা ঝড় ছিল অত্যন্ত জটিল ও হাইব্রিড সামরিক অভিযান যা বেশ প্রচলিত এবং সবচেয়ে উন্নত সেনাবাহিনী ওই পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে। তাই, আমেরিকা ও ইসরাইলের গোয়েন্দানজর এড়িয়ে হামাস কিভাবে এ ধরনের একটি সফল ও নজিরবিহীন হামলা চালাতে সক্ষম হলো সেটাই এখন সবার প্রশ্ন। নিঃসন্দেহে, হামাসের 'আল-আকসা ঝড়' অভিযানের অন্যতম প্রধান সাফল্য হল প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে শত্রুকে হতচকিত করে দেয়া যা সামরিক ব্যর্থতার পাশাপাশি ইসরাইলে জন্য সবচেয়ে বড় গোয়েন্দা ব্যর্থতা হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। যদিও এর আগে, ২০০৬ সালের ৩৩ দিনের যুদ্ধে, প্রথমবারের মতো, ইসরাইলি সেনাবাহিনীতে হতাহতের সংখ্যা আরবদের চেয়ে বেশি হয়েছিল এবং 'আল-আকসা ঝড়' অভিযানে ওই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। পার্থক্য হচ্ছে, এবার মাত্র কয়েক ঘন্টা বা একদিনেরও কম সময়ের মধ্যে আগ্রাসী ইসরাইলি সেনাদের ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, হামাস  'আল-আকসা ঝড়' অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে কেবল সামরিক লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করেছে এবং বেসামরিক মানুষ হত্যা কখনই তাদের লক্ষ্য ছিল না।  এ ছাড়া, হামাস ও ইসলামি জিহাদ যোদ্ধাদের হাতে বন্দীদের বেশিরভাগই হচ্ছে ইসরাইলি সৈন্য। তারা ইসরাইলের বেসামরিক নাগরিকদের সাথে সদ্ব্যবহার করে দেখিয়ে দিয়েছে যে বেসামরিক লোকদের হত্যার কোনো ইচ্ছাই তাদের নেই। এরই মধ্যে কিছু  ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে যেখানে দেখা গেছে হামাস যোদ্ধারা সাধারণ ইসরাইলিদের সাথে মানবিক আচরণ করেছে।

বাস্তবতা হচ্ছে,  ইহুদিবাদীরা অনবরত আল আকসা মসজিদের অবমাননা করায়, নিরীহ ফিলিস্তিনিদের হত্যা করায়, জুলুম, নির্যাতন বাড়িয়ে দেয়ায় এবং গাজার জনগণের বিরুদ্ধে অবরোধ তীব্রতর করায় গাজার প্রতিরোধ যোদ্ধারা ইসরাইলের অভ্যন্তরে হামলা চালাতে বাধ্য হয়েছে। হামাস বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও ইসরাইল তাদের হুমকিকে আমলে নেয়নি। যদি ইসরাইল এসব অপরাধ থেকে বিরত থাকতো তাহলে  হয়তো 'আল-আকসা ঝড়' অভিযানের দরকার হতো না।

'আল-আকসা ঝড়' অভিযানের ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইসরাইলের ব্যর্থতা ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আরো  বেশি দুর্বল হয়ে পড়বে এবং  এতে করে নেতানিয়াহুর জোট সরকারের পতন ঘটতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া, হামাসের কাছে এখন দেড় শতাধিক বন্দী রয়েছে। এই ব্যক্তিদের বিনিময়ে হামাস বিপুল সংখ্যক ফিলিস্তিনি বন্দিকে ইসরাইলি কারাগার থেকে মুক্ত করে আনতে  সক্ষম হবে বলে আশা করা হচ্ছে যা কিনা ইসরাইলের বর্তমান সরকারের অবস্থানকে আরো নড়বড়ে করে দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে হামাসের গোয়েন্দা ও সামরিক বিজয়ের সঙ্গে যোগ হবে আরেকটি রাজনৈতিক বিজয়।

সুত্র:পার্সটুডে

এনএ/