|| তাওহীদ আদনান ইয়াকুব ||
(সূরা যারিয়াত, সূরা তূর, সূরা নাজম, সূরা ক্বামার, সূরা আর-রহমান, সূরা ওয়াকিয়া ও সূরা হাদীদ)
আলহামদুলিল্লাহ, আজকের কুরআনের অংশে আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার অসীম কুদরত, মহিমা এবং নসিহতের বাণী পড়লাম। ২৭ নম্বর পারার আয়াতগুলো আমাদের জীবনের অমূল্য দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। এখানে আল্লাহর ইবাদত, নবী-রাসূলদের সংগ্রাম, উম্মতের দায়িত্ব এবং পরকালের ভয়াবহতার বর্ণনা রয়েছে, যা আমাদের হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। এই পারায় আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের ভয়াবহতা, নবি রাসূলদের দাওয়াতি মিশন, মুমিন ও কাফেরদের পরিণতি, এবং ইসলামের সামাজিক বিধান সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
এই পারায়, মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর একত্বের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস এবং রাসূল (সা.)-এর পথ অনুসরণের উপদেশ দিয়েছেন। পূর্ববর্তী জাতিগুলোর পতনের কারণ, আল্লাহর অশেষ নেয়ামত এবং কিয়ামতের দিনে মানুষের চূড়ান্ত পরিণতি সম্পর্কে শিক্ষণীয় বার্তা রয়েছে। আরও বিশেষভাবে বলা হয়েছে, জান্নাতের সুসংবাদ এবং কাফিরদের জন্য কঠিন শাস্তির কথা, যা আমাদের জীবনে সতর্কতার পাশাপাশি সৎকর্মে উদ্বুদ্ধ করবে।
২৭ নম্বর পারায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাঁর একত্ববাদ, কিয়ামতের ভয়াবহতা, নবীদের দাওয়াত, এবং মুমিন ও কাফিরদের পার্থক্য সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এখানে বিশেষভাবে মক্কাবাসীদের সতর্ক করা হয়েছে এবং পূর্ববর্তী উম্মতদের ধ্বংসের কারণ বর্ণনা করা হয়েছে। এই পারার আয়াতগুলো আমাদের চেতনা জাগ্রত করে, কিয়ামতের ভয়াবহতা ও জান্নাত-জাহান্নামের বাস্তবতা তুলে ধরে। এটি আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের আহ্বান জানায় এবং আমাদেরকে আমল করার তাগিদ দেয়।
১. সূরা যারিয়াত (৩১ - ৬০) নবীদের দাওয়াত ও আযাবের শিক্ষা
- ইবরাহিম (আ.)-এর কাছে ফেরেশতাদের আগমন ও লূত (আ.)-এর সম্প্রদায়ের ধ্বংস।
- নূহ (আ.), আদ, সামুদ ও ফিরআউনের জাতির শাস্তির বিবরণ।
- আল্লাহর দয়া ও রহমতের দরজা খোলা, কিন্তু তিনি সীমালঙ্ঘনকারীদের শাস্তি দিতে সক্ষম।
- আসমান ও জমিন সৃষ্টি সম্পর্কে আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন তুলে ধরা হয়েছে।
- রাসূল (সা.)-এর দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে—তিনি কেবল সতর্ককারী।
- মানুষের আসল লক্ষ্য একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা।
২. সূরা তূর (১ - ৪৯) – কিয়ামতের দৃশ্য ও জান্নাত-জাহান্নামের বিবরণ
- আল্লাহ শপথ করেছেন যে কিয়ামত অবশ্যই সংঘটিত হবে।
- মুমিনদের জন্য রয়েছে জান্নাতের অফুরন্ত নেয়ামত, আর কাফেরদের জন্য ভয়াবহ শাস্তি।
- নবীজী (সা.)-কে ধৈর্য ধরার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং ইসলামের সত্যতার প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে।
- কাবা শরিফ, তূর পাহাড় এবং আসমান-জমিনের শপথ করে কিয়ামতের সত্যতা বর্ণনা করা হয়েছে।
- জাহান্নামের শাস্তি এবং জান্নাতের নেয়ামতের সুস্পষ্ট বিবরণ দেওয়া হয়েছে।
- রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে সান্ত্বনা দিয়ে বলা হয়েছে যে, কাফিররা তাঁকে মিথ্যাবাদী বললেও, আল্লাহ তাঁর পক্ষেই আছেন।
৩. সূরা নাজম (১ - ৬২)– নবীজী (সা.)-এর সত্যতা ও তাওহীদের বর্ণনা
- কুরআন আল্লাহর ওহি এবং নবীজী (সা.) নিজ থেকে কিছু বলেন না।
- পূর্ববর্তী জাতিগুলোর ধ্বংসের কারণ ও তাকওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
- রাসূল (সা.)-এর মিরাজের ঘটনা এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে সরাসরি ওহি গ্রহণের বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
- লাত, উজ্জা ও মানাতসহ মূর্তিপূজার ভিত্তিহীনতা প্রমাণ করা হয়েছে।
- কেয়ামতের দিন প্রত্যেক ব্যক্তির কর্মফল কেবল তার নিজের হবে, এবং আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ কাউকে সুপারিশ করতে পারবে না—এই বিষয় স্পষ্ট করা হয়েছে।
৪. সূরা কামার (১ - ৫৫) – কিয়ামতের ভয়াবহতা ও অতীত জাতির শিক্ষা
- কুরআন সহজ করে দেওয়া হয়েছে, যাতে মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।
- চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার অলৌকিক ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে, যা রাসূল (সা.)-এর একটি মহান মু’জিজা।
- পূর্ববর্তী জাতিগুলোর ধ্বংসের কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যেমন—নুহ (আ.), লুত (আ.) আদ, সামুদ, ও ফিরআউনের জাতির ধ্বংসের বিবরণ পেশ করা হয়েছে।
- "নিশ্চয়ই আমি কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি, তবে কি কেউ শিক্ষা নেবে না?"—এই আয়াত বারবার উল্লেখ করে মানুষকে সতর্ক করা হয়েছে।
৫. সূরা আর-রহমান (১ - ৭৮) – আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামত ও কৃতজ্ঞতার শিক্ষা
- আল্লাহর অসংখ্য নেয়ামতের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এবং বারবার প্রশ্ন করা হয়েছে: "তোমরা তোমার রবের কোন কোন নিয়ামত অস্বীকার করবে?"
- মানুষের সৃষ্টি, জান্নাতের সুখ ও জাহান্নামের শাস্তির বিবরণ দেওয়া হয়েছে।
- কৃতজ্ঞতাবোধ ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের শিক্ষা প্রদান করা হয়েছে।
- সূর্য, চন্দ্র, আকাশ, জমিন, মানুষ, জিন, জান্নাতের নেয়ামত ও দুনিয়ার ভারসাম্যপূর্ণ সৃষ্টি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
- পরকালের বিচার এবং মুমিন ও কাফিরদের জন্য নির্ধারিত প্রতিদান ও শাস্তির কথা বলা হয়েছে।
৬. সূরা ওয়াকিয়াহ (১ - ৯৬) – মৃত্যুর পর মানুষের তিন শ্রেণি ও তাদের পরিণতি
- কিয়ামতের বিভীষিকা এবং সেদিন মানবজাতির তিন শ্রেণিতে বিভক্ত হওয়ার কথা বলা হয়েছে:
১. সাবিকুন (সর্বোচ্চ মর্যাদাপ্রাপ্ত) যারা আল্লাহর ঘনিষ্ঠ বান্দা।
২. আসহাবুল ইয়ামিন (ডান দিকের দল) যারা জান্নাত লাভ করবে।
৩. আসহাবুশ শিমাল (বাম দিকের দল) যারা জাহান্নামে যাবে।
- আল্লাহর শক্তি ও পুনরুত্থানের প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে।
- জান্নাতের নেয়ামত ও জাহান্নামের শাস্তির বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।
৭. সূরা হাদীদ (১ - ২৯)– তাকওয়া, দান-সদকা ও মুনাফিকদের পরিচয়
- আসমান ও জমিনের সমস্ত কিছু আল্লাহর মালিকানাধীন।
- মুনাফিকদের পরিণতি এবং তাদের দুঃখজনক অবস্থার বিবরণ।
- আল্লাহর রাস্তায় দান-সদকার গুরুত্ব এবং জান্নাত লাভের জন্য আত্মত্যাগের আহ্বান।
- আল্লাহর মহত্ব, কুদরত এবং এই বিশ্বজগতের অস্থায়ী প্রকৃতি তুলে ধরা হয়েছে।
- দানের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
- আল্লাহর কিতাব ও নবীদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
মূল শিক্ষা ও বার্তা:
- কিয়ামতের দিন মানুষ তার কর্ম অনুযায়ী পুরস্কৃত বা শাস্তিপ্রাপ্ত হবে।
- ইসলাম গ্রহণ না করা জাতিগুলোর ধ্বংসের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
- আল্লাহর নিয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞ হওয়া এবং তাঁর পথে আত্মত্যাগ করা উচিত।
তাকওয়া ও দান-সদকার মাধ্যমে জান্নাতের মর্যাদা লাভ করা সম্ভব।
উপসংহার
এই পারায় বারবার কুরআন থেকে শিক্ষা নেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে, কিয়ামতের ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে, এবং মুমিনদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ ও কাফিরদের জন্য জাহান্নামের ভয়াবহতা বর্ণিত হয়েছে। বিশেষ করে, সূরা আর-রহমান ও সূরা ওয়াকিয়াহ আমাদের অন্তরকে নরম করে এবং পরকালের প্রস্তুতির জন্য অনুপ্রাণিত করে। আসুন, আমরা এসব আয়াত থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের জীবন আল্লাহর আনুগত্যে পরিচালিত করি। আসুন, আমরা এই আয়াতগুলো থেকে যথাযথ শিক্ষা গ্রহণ করি এবং আমাদের জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই পারার শিক্ষাকে বাস্তবে অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন, আমিন!
লেখক : ফাযেলে দারুল উলুম দেওবন্দ ও নদওয়াতুল উলামা লাখনৌ,
মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া আহলিয়া নশাসন, শরীয়তপুর
হাআমা/