|| তাওহীদ আদনান ইয়াকুব ||
(সূরা মুমিনুন ও সূরা নূর)
কুরআন শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুশাসনের গ্রন্থ নয়, এটি একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান। এতে রয়েছে আত্মশুদ্ধির দিকনির্দেশনা, সমাজ গঠনের নীতিমালা এবং পরকালের সাফল্যের উপায়। পনেরোতম তারাবির অংশে তথা ১৮ নং পারায় সফল মুমিনদের গুণাবলি, নবীদের দাওয়াত, কিয়ামতের চিত্র এবং ইসলামী সমাজব্যবস্থার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিধান উঠে এসেছে।
বিশেষত, এখানে চরিত্র গঠনের মূলনীতি, ন্যায়বিচার, পারিবারিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার নিয়মাবলি এবং নারী-পুরুষের পর্দার বিধান বর্ণিত হয়েছে। এ অংশে আল্লাহ আমাদের সতর্ক করেছেন মিথ্যা অপবাদ, অন্যায় ও অশ্লীলতার পরিণতি সম্পর্কে এবং আহ্বান জানিয়েছেন সত্য, পবিত্রতা ও নৈতিকতা অবলম্বনের প্রতি।
১. সূরা মুমিনুন (২৩:১-১১৮) – সফল মুমিনদের গুণাবলি ও আখিরাতের চিত্র
সফল মুমিনদের বৈশিষ্ট্য (১-১১)
- কুরআনের শুরুতেই ঘোষণা করা হয়েছে—সত্যিকারের মুমিনরা সফল।
- তাদের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো—
১. বিনয়ী ও খুশুখুজু সহকারে নামাজ আদায় করা।
২. অর্থহীন ও নিরর্থক কাজ থেকে বিরত থাকা।
৩. নিয়মিত যাকাত প্রদান করা।
৪. নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করা।
৫. আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা।
৬. সালাতের প্রতি যত্নশীল থাকা।
আল্লাহর নিদর্শন ও নবীদের দাওয়াত (১২-৫০)
- মানুষের সৃষ্টির প্রক্রিয়া এবং আল্লাহর দেওয়া বিভিন্ন নিয়ামতের বিবরণ দেওয়া হয়েছে।
- নূহ (আ.), মূসা (আ.) ও হারূন (আ.)-এর দাওয়াতের সংক্ষিপ্ত আলোচনা রয়েছে।
পরকালের বিচার ও অবিশ্বাসীদের পরিণতি (৫১-১১৮)
- কিয়ামতের দিন সবার হিসাব নেওয়া হবে, নেককাররা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং মন্দকারীরা শাস্তি পাবে।
- অবিশ্বাসীরা সেখানে আফসোস করবে, কিন্তু তখন আর কোনো উপকার হবে না।
২. সূরা নূর (২৪:১-৬৪) – সামাজিক শৃঙ্খলা, পবিত্রতা ও শালীনতার বিধান
ব্যভিচার ও অপবাদ দেওয়ার শাস্তি (১-১০)
- ব্যভিচারের শাস্তি ১০০ বেত্রাঘাত নির্ধারণ করা হয়েছে।
- কারো প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেওয়া ইসলামি সমাজে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
হযরত আয়েশা (রা.)-এর ওপর অপবাদের ঘটনা ও শিক্ষা (১১-২৬)
- মুনাফিকরা হযরত আয়েশা (রা.)-কে নিয়ে মিথ্যা গুজব রটিয়েছিল, যা ‘ইফকের ঘটনা’ নামে পরিচিত।
- আল্লাহ সরাসরি কুরআনে আয়েশা (রা.)-এর পবিত্রতা ঘোষণা করেন।
নারীদের পর্দার বিধান (৩০-৩১)
- পুরুষদের দৃষ্টি অবনমিত রাখা ও নারীদের পর্দার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
- মহিলাদের জন্য ‘হিজাব’ ও ‘জিলবাব’ পরিধানের বিধান এসেছে।
পারিবারিক ও সামাজিক শিষ্টাচার (৫৮-৬১)
- শিশুদের ঘরে প্রবেশের আগে অনুমতি নেওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
- পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সৌজন্য বজায় রাখার নির্দেশ রয়েছে।
আল্লাহর জমিনে তাঁর আইন প্রতিষ্ঠার নির্দেশ (৬২-৬৪)
- আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব মুমিনদের ওপর অর্পিত হয়েছে।
- ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
মূল শিক্ষা ও বার্তা:
- সফল মুমিনদের বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে হবে।
- নবীদের জীবনী থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।
- পরকালের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে, কারণ শাস্তি ও প্রতিদান অনিবার্য।
- সামাজিক শৃঙ্খলা, শালীনতা ও পর্দার বিধান মেনে চলতে হবে।
- ইসলামের বিধান প্রতিটি সমাজে কার্যকর করতে হবে।
উপসংহার:
এই পারায় মুমিনদের চরিত্র গঠনের মৌলিক দিক, আখিরাতের পরিণতি, সামাজিক শৃঙ্খলা ও ইসলামী বিধানের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। এই আয়াতসমূহ আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ইসলামকে বাস্তবায়নের শিক্ষা দেয়, যাতে আমরা দুনিয়া ও আখিরাতে সফল হতে পারি। আল্লাহ যেন আমাদের এ শিক্ষা অনুসারে জীবন গঠনের তাওফিক দেন—আমিন!
লেখক : ফাযেলে দারুল উলুম দেওবন্দ ও নদওয়াতুল উলামা লাখনৌ,
মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া আহলিয়া নশাসন, শরীয়তপুর
হাআমা/