|| মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব ||
হিজরী ৩২ (৬৫৪ খ্রিষ্টাব্দ)-এ অফাতপ্রাপ্ত সাহাবি আবদুর রহমান বিন আওফ (রা) মদিনায় হিজরত করে এসে দরিদ্র অবস্থায় ছিলেন। কিন্তু ব্যবসার মাধ্যমে তিনি ইসলামি ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ পুঁজির মালিক হয়ে ওঠেন। ইমাম যাহাবী (রহ) তাঁর আস-সিয়ার গ্রন্থে তাঁর বিশাল সম্পদের বিবরণ দিয়ে বলেন:
"تصدق ابن عوف على عهد رسول الله.. بشطر ماله أربعة آلاف، ثم تصدق بأربعين ألف دينار، وحَمل على خمسمئة فرس في سبيل الله، ثم حمل على خمسمئة راحلة في سبيل الله، وكان عامة ماله من التجارة".
"ইবন আওফ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে নিজের সম্পদের অর্ধেক চার হাজার দিরহাম দান করেন। এরপর চল্লিশ হাজার দিনার দান করেন। পাঁচশো ঘোড়া আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করেন। এরপর পাঁচশো উট আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করেন। তাঁর অধিকাংশ সম্পদ ব্যবসা থেকেই আসে।"
এরপর ইমাম যাহাবী (রহ.) মন্তব্য করেন:
"قلت: هذا هو الغنيُّ الشاكر"!!.
"আমি বলি, তিনিই প্রকৃত অর্থে শোকরগোযার ধনী!"
ইমাম যাহাবী (রহ) তাঁর ‘تاريخ الإسلام’ গ্রন্থে যুবায়ের ইবনে আওয়াম (রা:) (মৃত্যু: ৩৬ হিজরি/৬৫৭ খ্রিষ্টাব্দ) -এর ব্যবসা ও মৃত্যুর পর তাঁর রেখে যাওয়া সম্পদের বর্ণনা দেন। তিনি উল্লেখ করেন:
"ثبت في الصحيح أن الزُّبَيْر خلَّف أملاكًا بنحو أربعين ألف ألف درهم ? اليوم 80 مليون دولار أميركي تقريبا) وأكثر"!!
"সহীহ সূত্রে প্রমাণিত যে, যুবায়ের (রা:)) প্রায় চল্লিশ হাজার দিরহামের (আজকের হিসাবে আনুমানিক ৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) মালিক ছিলেন।"
এছাড়া, তিনি ‘আস-সিয়ার গ্রন্থে আরেক সাহাবি তলহা ইবনে উবায়দুল্লাহ রা: (৩৬ হিজরি/৬৫৭ খ্রিষ্টাব্দ)-এর ব্যবসা ও তাঁর রেখে যাওয়া সম্পদ সম্পর্কে লেখেন:
"قـُتِل.. وفي يد خازنه ألفُ ألفِ درهم..، وقُـِّومت أصولُه وعقارُه ثلاثين ألفَ ألفِ درهم!
"তিনি শাহাদত বরণ করেন, তখন তাঁর কোষাধ্যক্ষের হাতে এক মিলিয়ন দিরহাম ছিল এবং তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ত্রিশ মিলিয়ন দিরহাম।"
এ বিষয়ে ইবনুল জাওযী (৫৯৭ হিজরি/১২০০ খ্রিষ্টাব্দ) আশ্চর্যজনকভাবে বলেন:
وقد خلّف طلحة ثلاثمئة حِمْلٍ من الذهب"!!
"তলহা ইবনে উবায়দুল্লাহ তিনশো বোঝাই স্বর্ণ রেখে গিয়েছিলেন!"
সাহাবাদের পর ব্যবসার ধারা অব্যাহত
ব্যবসা কেবল বড় সাহাবিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং ছোট সাহাবি ও তাঁদের মকতুমরাও (দাসরা) এতে যুক্ত ছিলেন। ইমাম নববী রহ: তাঁর ‘تهذيب الأسماء واللغات’ গ্রন্থে লিখেছেন:
সাহাবি আম্মার ইবনে ইয়াসির-এর মকতুম সা’দ আল করজ (৩৯ হিজরি/৬৬০ খ্রিষ্টাব্দ) ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। প্রথমে তিনি বিভিন্ন ব্যবসায় লোকসান করেন। পরে তিনি قرظ (যে গাছের পাতা দিয়ে চামড়া ট্যানিং করা হয়) ব্যবসায় লাভ করেন এবং তাতে স্থায়ী হন। এজন্য তাঁকে القرظ-নামে পরিচিত করা হয়।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে মসজিদ কুবা-এর মুয়াজ্জিন বানিয়েছিলেন। পরে যখন আবু বকর সিদ্দিক (রাদিয়াল্লাহু আনহু) খলিফা হলেন এবং বেলাল রা: মুয়াজ্জিন থাকা থেকে বিরত হলেন, তখন সা’দ আল-করজকে মসজিদ নববির মুয়াজ্জিন হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
তাবেঈগণ ও তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের ব্যবসা
সাহাবিদের মতো তাবেঈগণও ব্যবসাকে গ্রহণ করেছিলেন। ইবনুল জাওযী রহ: ‘صيد الخاطر’ গ্রন্থে লিখেছেন যে,
"مات وخلّف مالًا وكان يحتكر الزيت"
প্রসিদ্ধ তাবেঈ সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব রহ: (৯৩ হিজরি/৭১২ খ্রিষ্টাব্দ) জলপাই তেলের ব্যবসা করতেন এবং মৃত্যুর সময় প্রচুর সম্পদ রেখে যান।
এছাড়া, প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইমাম সুফিয়ান সওরী রহ: (১৬১ হিজরি/৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দ)-ও তেলের ব্যবসা করতেন এবং তাঁর এক চাচার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে কিছু সম্পদ পেয়েছিলেন, যিনি বুখারাতে (বর্তমান উজবেকিস্তান) বাস করতেন। খতীব বাগদাদী রহ: তাঁর ‘تاريخ بغداد’ গ্রন্থে এটি উল্লেখ করেছেন।
ইমাম আবু নুআইম আসফাহানী (মৃত্যু: ৪৩০/১০৪০) হিলয়াতুল আওলিয়া গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ইমাম সুফিয়ান সওরি রহ: এর ছাত্ররা যখন তাঁর ব্যবসা সম্পর্কে আপত্তি জানায়, তখন তিনি বলেছিলেন:
"اسكتْ! لولا هذه الدنانيرُ لَتَمَنْدَلَ بنا هؤلاء الملوكُ"
"চুপ থাকো! যদি এই দিরহাম না থাকতো, তবে এই বাদশাহরা আমাদের রুমাল বানিয়ে ফেলতো!"
ইমাম যাহাবী রহ: আস-সিয়ার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, সাধক ও মুজাহিদ আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ: (১৮১ হিজরি/৭৯৭ খ্রিষ্টাব্দ) ব্যবসা করতেন। তিনি নিজের সম্পদ দিয়ে
• জ্ঞানার্জনে ভ্রমণ করতেন,
• জিহাদে অংশ নিতেন,
• ভাইদের সহযোগিতা করতেন,
• তাঁদের সঙ্গে হজে যেতেন এবং তাঁদের খরচ বহন করতেন।
এভাবে ব্যবসা ইসলামি ইতিহাসে শুধুমাত্র জীবিকা অর্জনের মাধ্যম ছিল না, বরং তা দান-সদকা, জিহাদ ও ইসলামের প্রচারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপায় হয়ে ওঠে।
বড় বড় বাণিজ্যিক আলেমদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন লাইস ইবন সাআদ (মৃ. ১৭৫ হিজরি/৭৯১ খ্রিষ্টাব্দ)।
ইমাম যাহাবী রহ: তার "সিয়ার আলাম আন-নুবালা" গ্রন্থে তাকে উল্লেখ করেছেন এভাবে:
"الإمام الحافظ شيخ الإسلام وعالم الديار المصرية… ومن يفتخر بوجوده الإقليم، بحيث إن متولي مصر وقاضيها وناظرها [يعملون] من تحت أوامره، ويرجعون إلى رأيه ومشورته"
"তিনি ছিলেন ইমাম, হাফিজ, শাইখুল ইসলাম ও মিসরের অন্যতম বড় আলেম। এমনকি মিসরের গভর্নর, বিচারপতি ও প্রশাসকগণ তার আদেশ অনুযায়ী পরিচালিত হতেন এবং তার মতামত ও পরামর্শ গ্রহণ করতেন।"
এরপর ইমাম যাহাবী রহ: তার বার্ষিক আয়ের পরিমাণ উল্লেখ করে বলেন:
"كان الليث يستغل عشرين ألف دينار ? اليوم 4 ملايين دولار تقريبا) في كل سنة"!!
"লাইস প্রতি বছর বিশ হাজার দিনার (আজকের হিসাবে প্রায় ৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) উপার্জন করতেন!"
আর্থিক স্বনির্ভরতার আহ্বান
সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে রাষ্ট্রের বিস্তৃতি ঘটে, যুদ্ধ থেকে প্রাপ্ত গনীমতের অংশগ্রহণ বন্ধ হয়ে যায় এবং শাসকদের প্রতি আলেমদের আস্থাও অনেকাংশে কমে যায়। ফলে বহু ইসলামি আলেম – বিশেষত ফকিহ ও মুহাদ্দিসগণ – জীবিকা নির্বাহের জন্য ব্যবসা.... (চলবে)
হাআমা/