দেশে ধর্মীয় ও কারিগরি শিক্ষায় অংশগ্রহণ বাড়লেও সাধারণ শিক্ষায় কমেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র (বিবিএস) এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বিবিএস’র সর্বশেষ প্রকাশিত বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে সাধারণ শিক্ষায় অংশগ্রহণের হার ছিল ৯৩ দশমিক ২৭ শতাংশ। ২০২৩ সালে ২ দশমিক ২৫ শতাংশ কমে ৯১ দশমিক ০২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে ২০২১ সালে ধর্মীয় শিক্ষায় অংশগ্রহণের হার ছিল ৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ। ২০২৩ সালে ২ দশমিক ৩১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৭ দশমিক ২৯ শতাংশ হয়েছে। এ ছাড়া তিন বছরের ব্যবধানে কারিগরি শিক্ষায়ও অংশগ্রহণ কিছুটা বেড়েছে।
সাধারণ শিক্ষায় কমে ধর্মীয় শিক্ষায় কেন আগ্রহ বেড়েছে এসব নিয়ে নানা মহলে চলছে নানা সমীকরণ। নানাজন দিচ্ছেন নানা ব্যাখ্যা। আসলে ঠিক কী কারণে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে? এসব নিয়ে কথা বলেছেন এসসসিতে যশোর বোর্ড ও এইচএসসিতে ঢাকা বোর্ডে স্ট্যান্ড করা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় অনার্স-মাস্টার্স পাশ শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবি আলেম গবেষক মাওলানা লিয়াকত আলী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আওয়ার ইসলামের চিফ রিপোর্টার- হাসান আল মাহমুদ
সম্প্রতি বিবিএস একটা জরিপ প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ২০২১ সাল থেকে ২৩ সালে এসে ধর্মীয় শিক্ষায় আগ্রহ বেড়েছে, এ বিষয়টা আপনি কীভাবে দেখছেন?
মাওলানা লিয়াকত আলী : ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে বলে যে জরিপ প্রকাশ করা হয়েছে ও পরবর্তীতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়েছে তা একটা ইতিবাচক দিক। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি যে আগ্রহ বেড়েছে তা তো মাত্র ৭ পার্সেন্ট। এদেশের মুসলমান হচ্ছে নব্বই পার্সেন্ট। সে হিসাবে মাত্র ৭ পার্সেন্ট এটাতা খুব বেশি আশাব্যঞ্জকই না। বরং নব্বই পার্সেন্ট মুসলমান হিসাবে এর সংখ্যা তো আরো অনেক বেশি হওয়া দরকার।
পড়ুন : বিশ্বজয়ী হাফেজের দেশ বাংলাদেশে কেন আসছে না বিদেশি হিফজ শিক্ষার্থী
বিবিএসের করা জরিপ নিয়ে কেউ কেউ মনে করছেন যে, অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কারণে নাকি ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে, তারা দাবি করছে- ধর্মীয় শিক্ষা যেহেতু সাধারণ মানুষের দান-অনুদানে চলে, এখানে পড়ালেখা করতে টাকাপয়সা লাগে না, এ কারণে মানুষ এদিকে ঝুঁকছে, কথাটা আসলে সঠিক কি?
মাওলানা লিয়াকত আলী: এগুলো আসলে মার্কসিজাম-বামপন্থা যারা চর্চা করে তাদের ব্যাখ্যা। কারণ তারাতো ধর্মকে মনে করে জনগণের আফিম। মানুষ অসহায় হলে নাকি ধার্মিক হয়। এসব তাদের ধারণা। মানুষ অর্থনেতিক দুর্দশার কারণে ধার্মিক হয় কিংবা ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয় এসেব ধারণা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। সরেজমিন বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্ক না থাকার ফলে কিছু বুদ্ধিজীবিরা এমন মন্তব্য করে। তারা যেন অন্য জগতে বসবাস করে, যেখানে দেশের জনগণের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা ধর্ম শিক্ষা ও ধর্মীয় অঙ্গন সম্পর্কে অন্ধকার লালন করে। যার কারণে তারা প্রকৃত কারণ খুঁজে পান না। অন্ধকার দেশে বসে যা মনে আসে, তাই বলে ফেলে।
তাহলে কীসের কারণে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে বলে মনে করেন?
মাওলানা লিয়াকত আলী: বস্তুত কয়কটা কারণে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে।
এক: সরকারের স্বীকৃতি। সরকার কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স সমমান স্বীকৃতি দেওয়ায় এর ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে জনগণের মাঝে। জনগণ এখন মনে করে কওমি মাদরাসায় পড়া মানে এখন আর অসহায় হওয়া নয়। সরকারের কাছে এর স্বীকৃতি আছে। এই স্বীকৃতির একটা ব্যাপক প্রভাব দেশ-বিদেশে পড়েছে। এই কারণে জনগণ এখন ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি আগের চেয়ে বেশি আগ্রহী হয়েছে।
পড়ুন : পুলিশ সদস্যদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন কওমি পড়ুয়া মাওলানা মুজাহিদুল ইসলাম
দুই: সাধারণ শিক্ষার অবনতি। বর্তমানে সাধারণ শিক্ষা বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক স্বার্থেই কেবল লেখাপড়া করান, জনগণ ও সমাজের প্রতি দায়বোধ আছে এরকম অবস্থা এখন খুব কম পাওয়া যায়। অপরদিকে ধর্মীয় শিক্ষায় বাণিজ্যিক আবহ নেই। শিক্ষার্থীদের শেখানোর প্রতি যত্মবান থাকেন শিক্ষকরা। এটা জনগণের পর্যবেক্ষণ। এই কারণে জনগণ মাদরাসা শিক্ষায় ঝুঁকছেন।
পড়ুন : ‘শাড়ী-লুঙ্গি নয়, গরীবের প্রয়োজন মেটে এমন জিনিস দিয়েই যাকাত দেওয়া উত্তম’
তিন: সাধারণ শিক্ষার মান নিম্নগামী হয়েছে। এখন সাধারণ শিক্ষায় পড়ালেখা করে একজন শিক্ষার্থীর যে পরিমান যোগ্যতা হওয়া দরকার তা হচ্ছে না। অপরদিকে একটা নূরানী মাদরাসায় একজন শিক্ষার্থী মাত্র দুই বছর পড়লে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বাংলা, অংক ও ইংরেজিতে যে পরিমান যোগ্যতা তার হয়, তা একজন প্রাইমারী পাশ করা শিক্ষার্থীর হচ্ছে না। এটা হলো জনগণের পর্যবেক্ষণ। এই কারণে জনগণ প্রাইমারী থেকে বিমুখ হয়ে নূরানী মাদরাসার প্রতি আগ্রহী হয়েছে। কিছুদিন আগে একজন মন্ত্রী যে মন্তব্য করলেন যে, নূরানী মাদরাসার কারণে প্রাইমারীতে ছাত্র কমেছে, তার বাস্তব কারণ হলো এই।
চার : কওমি মাদরাসার শিক্ষায় ইদানিংকালে ব্যাপক একটা সংস্কার সাধিত হয়েছে। এই সংস্কার হচ্ছে দুই দিক দিয়ে।
এক- শিক্ষার কারিকুলাম। আগে কওমিতে শুধু আরবি-উর্দু ও ফার্সী ইত্যাদি ধর্মীয় বিষয় শেখানো হত। কিন্তু প্রায় এক দশক কাল ধরে কওমিতে বাংলা-অংক-ইংরেজি যুক্ত করা হয়েছে। বিশেষ করে নতুন যত ছোট ছোট মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, এসব মাদরাসায় ধর্মীয় ও সাধারণ শিক্ষার সমন্বিত করা হয়েছে। জনগণ দেখলো- আমার সন্তানকে মাদরাসায় পড়ালে একই সঙ্গে দুই শিক্ষা পাচ্ছে একই খরচে, তাই তারা মাদরাসায় ঝুঁকছেন।
দুই- ব্যবস্থাপনা। আগে কওমি মাদরাসা চলতো দৈন্য ও গরিবি হালতে। এতে স্বচ্ছল পরিবারের লোকেরা মাদরাসাগুলোতে নিজেদের সন্তানকে দিতে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করতো না। কিন্তু বর্তমানে এমন প্রচুর মাদরাসা হয়েছে ও হচ্ছে, যেখানে সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে উন্নত আবাসন ও রুচিসম্মত খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থাপনা করেছে। যা ওসব স্বচ্ছল পরিবারের উপযোগী হয়েছে। এই কারণে এসব মাদরাসার প্রতি তারা আগ্রহী হয়েছে।
হাআমা/