|| হাসান আল মাহমুদ ||
মূক-বধির ও শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের দ্বীনি জ্ঞান শেখাচ্ছে বাংলাদেশ দ্বীনিয়াত শিক্ষাধারা। এই শিক্ষাধারার আয়োজনে 'দ্বীনিয়াত বধির মাদরাসা' নামে চলে সমাজের অবহেলিত এই শ্রেণিদের কুরআন-হাদিস, বাংলা, ইংরেজি ও গণিতসহ সাধারণ জ্ঞান শেখানোর মহৎ উদ্যোগ।
শুক্রবার ২২ মার্চ ঢাকার সাইনবোর্ড মাতুয়াইলে অবস্থিত দ্বীনিয়াত বধির মাদরাসায় সরেজমিনে গিয়ে এমন মহৎ কার্যক্রম দেখা গেলো স্বচক্ষে।
এসময় দেখা গেলো- হাতের ইশারায় বধিররা শিখছে আরবি বর্ণমালা। পড়ছে কুরআন শরিফও হাতের ইশারায়। বাংলা-ইংরেজিসহ সাধারণ জ্ঞানও তারা শিখছে হাতের ইশারায়। মনের আবেগ, ভাষার প্রকাশ তারা বিনিময় করে হাতের ইশারায়।
মহৎ এই উদ্যোগের কারিগর বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন মুফতি সালমান আহমাদ। তিনি দ্বীনিয়াত বাংলাদেশ শাখার প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান।
কথা হয় এই মহৎ উদ্যোগের কারিগর মুফতি সালমান আহমাদ-এর সঙ্গে। তিনি জানান, সমাজের অবেহেলিত মানুষদের ভাগ্য বদলের কথা। শোনান স্বপ্নের কথা।
তিনি জানান, ‘আশেপাশের যারা কর্মজীবি বধির রয়েছেন তারা শুক্রবার দিন সকালে চলে আসে। এখানে জুমা পর্যন্ত পড়ালেখা করে। এদের সংখ্যা ৫০ কখনো তারচেয়ে বেশি হয়।
‘এছাড়া, সারাদেশ থেকে যেসব বধির এখানে পড়তে আসে তারা আবাসিকভাবে থাকে, পড়ালেখা করে। তাদের জন্য আলাদা শিক্ষক থাকেন। তাদের ক্লাস হয়, ক্লাসের পরে আবাসিক নিয়মে পড়ালেখা হয়। তাদের মানসম্পন্ন খাওয়াদাওয়াসহ সিসি ক্যামেরার আওতাধীন সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।’ –জানান তিনি।
পড়ুন : বিশ্বজয়ী হাফেজের দেশ বাংলাদেশে কেন আসছে না বিদেশি হিফজ শিক্ষার্থী
দ্বীনিয়াত শিক্ষা বলতে কী বুঝায় প্রশ্নে মুফতি সালমান আহমাদ বলেন, ‘বর্তমানে দেখা যাচ্ছে মাত্র দুইভাগ মানুষ দ্বীন শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত আছে। বাকি আটান্নব্বই ভাগ মানুষ জেনারেল শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত। জেনারেল শিক্ষার সাথে এই আটান্নব্বই ভাগ মানুষ যেন ধর্মীয় শিক্ষা পারে সেজন্যই দ্বীনিয়াত বাংলাদেশ।
‘প্রাইমারী কোর্সটা করলে এ পরিমান যোগ্যতা হয় যে, চাইলে যে কোনো মসজিদে জুমার খুতবা দিতে পারবে। আর আমাদের ফুল কোর্স করলে এ পরিমান যোগ্যতা হয় যে, আলেম হতে চাইলে কওমি মাদরাসার শরহে বেকায়া জামাতে ভর্তি হতে পারবে’।– যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, সর্বজনীন সর্বস্তরের মানুষের জন্য দ্বীন শিক্ষার সহজ ব্যবস্থার নাম হলো দ্বীনিয়াত। শুধু মাত্র ১ ঘন্টায় ৫টি বিষয় শিখতে পারবে। সেগুলো হলো- কুরআন, হাদিস, আকাইদ-মাসাইল, ইসলামী শিষ্টাচার ও আরবি ভাষা।
বধিরদের জন্য মাদরাসা শুরুর কথা প্রসঙ্গে স্বপ্নদ্রষ্টা মুফতি সালমান আহমাদ বলেন, ‘যেহেতু আমাদের এই দ্বীনিয়াত শিক্ষার মূল স্লোগান হলো- সর্বস্তরের সকল মানুষের জন্য সহজভাবে দ্বীন শিক্ষা’ সেহেতু সমাজে যেভাবে সুস্থ মানুষ রয়েছে, তদ্রুপ বধির, বোবা ও অন্যান্য প্রতিবন্ধী মানুষও রয়েছে। এদের প্রত্যেকের জন্যই তো দ্বীন শেখাটা জরুরি।
তিনি বলেন, ‘গভমেন্টের একটি জরিপে জানা গেছ, বাংলাদেশে মূক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী রয়েছে ৩০ লাখের কাছাকাছি। অন্ধ ও অন্যান্য প্রতিবন্ধীর কথা বাদই দিলাম। এদেরকে কিভাবে দ্বীন শেখানো যায় সেজন্যই মূলত ৩ বছর আগে ২০২১ সালে বাংলাদেশে ‘দ্বীনিয়াত বধির মাদরাসা’ যাত্রা করে।
‘এসমস্ত বধিররা যেমনিভাবে সমাজের কাছে অবহেলিত হয়, এমনকি অভিভাবকদের কাছেও এরা অবহেলিত হয়। তাদের দ্বীন শেখানোটা সমাজের সুস্থ মানুষদের ওপর অপরিহার্য দায়িত্ব বলেই মনে করছি’।– মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি জানান, ‘আলহামদুলিল্লাহ সেই প্রেরণা নিয়ে আমরা এমন উদ্যোগ নিলাম। গত তিন বছরে আমাদের এখান থেকে অনেক বধির ভায়েরা দ্বীন ও প্রয়োজনীয় পাঠ নিয়েছেন। বাংলা-অংক-ইংরেজি ও গণিতসহ জেনোরেল শিক্ষাও তারা নিচ্ছে। আমাদের এই কারিকুলামে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়লে একজন বধির ভায়ের কুরআন খতম হয়ে যায়। কুরআন নাজেরা ফুল শিখে পেলে। হাদিস মুখস্থ হয়। এমনকি আমাদের এখানে এমন বধির ভাইও রয়েছে যাদের কারো কারো ৫-৬ খতমও হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ‘তাদেরকে যেহেতু সেস্পাশালভাবে পড়াতে হয়, এজন্য শিক্ষেকদের প্রশিক্ষণ করিয়ে আনাতে হয়। আমাদের বাংলাদেশে পিতামাতাও কিন্তু বধিদের ভাষা বুঝে না। কষ্টের কথা হলো তারা মসজিদে গেলেও দ্বীনি কথা শুনতে পায় না। তারাতো কানেই শুনে না। অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে এই বধির ভায়েরা দুনিয়াবি নানা জ্ঞান পাচ্ছে। কিন্তু দ্বীন পাচ্ছে না’।
যদি কোনো বধির ভাই আমাদের এখানে ৫ বছর পড়ে, তাহলে তার কুরআন শেখাটাও হবে এবং জেনারেল ৫ম পর্যন্ত পড়াও হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
আমাদের টার্গেট আছে তাদের জন্য রমজানের পর হিফজ বিভাগ খোলার। আল্লাহ চাইলে এর ফলাফলও পাবেন।
বাংলাদেশ দ্বীনিয়াত শিক্ষাধারার চেয়ারম্যান মুফতি সালমান আহমাদ এসময় আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে আহ্বান জানাবো- আপনাদের দৃষ্টিগোছরে কেথাও কোনো বধির ভাই থাকলে, তাদেরকে দয়া করে আমাদের কাছে পাঠাবেন। আমরা তাদের দ্বীন ও প্রয়োজনীয় জাগতিক জ্ঞান শেখাবো ইনশাআল্লাহ। আমাদের ভর্তি রমজান ও জানুয়ারি সেশনে হয়। বধিররা আমাদের সমাজেরই অংশ। এদের প্রতি আমাদের অবহেলা যেন না হয় সে লক্ষ রাখতে হবে আমাদের সকল সুস্থ ভাইদের। রাষ্ট্র ও জনসাধারণ সবাইকে এ বিষয়ে এগিয়ে আসার বিশেষ আহ্বান জানাই।
উল্লেখ্য, দ্বীনিয়াতের যাত্রা শুরু হয় ১৯২৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায়। তখন দক্ষিণ আফ্রিকার আলেমরা দেওবন্দের সাথে যোগাযোগ করে স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রিদের দ্বীন শিখার আয়োজন করে। দক্ষিণ আফ্রিকার কারিকুলামটির নাম তাসহিল। ভারতের একদল মুসলিম দক্ষিণ আফ্রিকায় হিজরত করেন। হিজরত করার পর তারা দেখতে পান সেখানে মুসলিম শিশুদের জন্য ইসলামি শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই।
বর্তমানে বিশ্বের ৪০টি দেশে দ্বীনিয়াতের স্বীকৃত কাযক্রম রয়েছে এবং অস্বীকৃতভাবে প্রায় ৭০টি দেশে এ শিক্ষা কারিকুলাম চলছে। দ্বীনিয়াতের সিলেবাসভূক্ত বইগুলো প্রায় ৩০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বাংলাদেশে এই কার্যক্রম পরিচালনা করছেন মফতি সালমান আহমাদ।
আগ্রহী বধির শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবার প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারেন এই নম্বরে: 01819477886, 01910556685, 0 1915-875370
হাআমা/