মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ। দেশের অন্যতম শীর্ষ মুফতি ও আলেম। রাজধানীর কুড়িলে অবস্থিত ইসলামিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান শাইখ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক। সম্প্রতি তিনি যাকাতের খুটিনাটি বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আওয়ার ইসলামের চিফ রিপোর্টার হাসান আল মাহমুদ
আওয়ার ইসলাম: যাকাত কেন দিতে হয়?
মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ: যাকাত হলো ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ ফরজের অন্যতম একটি। যাকাত অর্থ শুদ্ধ হওয়া, বৃদ্ধি পাওয়া। যাকাত দিলে নিজ মালের শুদ্ধতা-পবিত্রতা হয় এবং যাকাত দিলে নিজের সম্পদ বৃদ্ধি পায়। যারা নির্দিষ্টি পরিমান মালের মালিক, তাদেরকে যাকাত দিতে আল্লাহ তায়ালার আদেশ। ইসেলামের কনসেপ্ট হল- মানুষের মাঝে যেন অর্থনৈতিক সুষমতা বজায় থাকে, ধনীরাই কেবল যেন মালের ভোগ না করে বরং গরীবরাও যেন ধনীদের থেকে একটি অংশ পেয়ে জীবনযাপন সহজ কতে পারে এজন্যই যাকাতের বিধান।
পড়ুন : ‘নব্বই পার্সেন্ট মুসলমান হিসাবে ধর্মীয় শিক্ষায় আগ্রহীর পরিমান আরো বেশি হওয়া দরকার’
আওয়ার ইসলাম: যাকাতের মাল দেওয়ার মাপকাঠি কী?
মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ: যাকাতের ব্যাপারে শরিয়তের নিয়ম হলো যাকাতাদাতা ভালো মাল দিবে। আর গ্রহীতা মিডিয়াম জিনিস গ্রহণ করার চেষ্টা করবে। যাকাত এটা গরীবের হক। গরীবকে দেয়ার সময় দাতারা বেশি করে দিবে। আর গরীবকে যদি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দায়িত্ব দেয়া হয় যে তোমরা যাকাতের মাল গ্রহণ করে নাও,তাহলে সে ক্ষেত্রে তার উচিত হবে মিডিয়াম মাল গ্রহণ করা।
আওয়ার ইসলাম: যাকাত কী দিয়ে দেওয়া উত্তম?
মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ: যাকাতের ক্ষেত্রে ‘মাল’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে কুরআন ও হাদিসে। ‘খুয মিন আমওয়ালিহিম সদ্কাহ’। তো. ‘মাল’ পণ্যকেও বলা হয়, স্বর্ণকেও বলা হয় আবার টাকাকেও মাল বলা হয়। এজন্য, যে জিনিসের যাকাত আসে, স্বর্ণের যাকাত স্বর্ণ দিয়ে, রূপার যাকাত রূপা দিয়ে, টাকার যাকাত টাকা দিয়ে, ব্যবসার মালের যাকাত ব্যবসার মাল দিয়ে দেওয়া শরিয়তে যাকাত দেওয়ার গহণযোগ্য পদ্ধতি।
কিন্তু কেউ যদি মালের পরিবর্তে ক্যাশ টাকা দিয়ে দিতে চায়, তাহলে সে উচিত মূল্য ধরে ক্যাশ টাকা দিবে। আমাদের নিকট ক্যাশ টাকা দেয়াটা উত্তম এজন্য যে, গরীবের কী প্রয়োজন আর কী প্রয়োজন নাই সেটাতো আমরা জানি না। মাল দিলাম, হয়তো তার এ মাল আছে। কিন্তু টাকা নাই, টাকা থাকলে নিজের পছন্দমত সে আরেকটা মাল কিনতে পারতো। তো, আমি টাকা দিয়ে দিলে সে তার প্রয়োজন অনুপাতে সারতে পারবে। এজন্য টাকা দেওয়া উত্তম।
আওয়ার ইসলাম: আজকাল দেখা যাচ্ছে সিরিয়াল ধরিয়ে কোথাও যাকাতের নামে শাড়ী-লুঙ্গি ইত্যাদি বিতরণ করছে, ইসলাম এ ব্যাপারে কী বলে?
মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ: আল্লাহ পাক ‘রিয়া’ সংযুক্ত ইবাদত পছন্দ করে না। লোক দেখানো ইবাদত গ্রহণীয় নয় আল্লাহর কাছে। মানুষ দেখানো ইবাদত থেকে বাঁচতে হবে। যাকাত দিবে মানুষকে দেখানোর জন্য না, নাম ফুটানোর জন্য না। নিজের প্রশংসা কামানোর জন্য না।
শাড়ী-কাপড়ের নামে ব্যবহারের অনুপযোগী, নিম্নমানের কাপড়চোপড় দিয়ে, মানুষকে লাইন ধরাইয়া অনেক কষ্ট দেওয়া, মানুষের ভিড় জমানো, মানুষ দেখবে পত্রিকায় উঠবে ইত্যাদি পন্থায় যাকাত দেওয়া পরিহারযোগ্য। এগুলার একটাও কাম্য নয়। ইসলাম যেভাবে যাকাত দিতে বলছে এগুলার একটাও সমর্থিত নয়।
মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ-এর আরেকটি সাক্ষাৎকার পড়ুন : ‘অল্পকিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকিগুলোতে তাখাচ্ছুছের উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে’
যারা যাকাত দিচ্ছেন মোবারকবাদ, কাপড় দিয়ে দিচ্ছেন তাহলে ভালো কাপড় দিয়ে দেন। গরীবের লিস্ট করে কাপড়গুলো ঘরে পৌঁছে দেওয়া আপনার দায়িত্ব, সিরিয়াল ধরানোর অধিকার আপনার নাই। আর যদি আপনার বাসা থেকে নিতে হয়, তাহলে অবশ্যই যেন সম্মানের সাথে হয়। ফকির-মিসকীনের মত লাইন ধরায়া সম্মান-ইজ্জত না করে অনেক সময় লাইন ধরায়া পেটানো হয়, আহত করা হয়, ছবি তোলা হয়, মিডিয়া প্রচার করা হয় এসবের একটাও শরিয়তসম্মত নয়।
আওয়ার ইসলাম: ব্যবসার মালের যাকাত কিভাবে দিবে?
মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ: কিভাবে দেয়া হবে এটাতো জানাই লাগবে। আগে জানতে হবে- যাকাতের মাল হলো চারটা। ব্যবসার মাল, স্বর্ণ, রূপা ও ক্যাশ টাকা। এ চার জিনিস হলো যাকাতযোগ্য সম্পদ। এর বাইরে কোনো জিনিসে যাকাত আসবে না। হিসাবও হবে না। ডায়মন্ডের মত দামি জিনিসও যাকাতযোগ্য সম্পদ নয়। আগে গবাদি পশুতে যাকাত আসতো, কিন্তু বর্তমানে যাকাত আসার মত গবাদি পশু কারো নাই, তাই যাকাতের সুরত থেকে হারিয়ে গেছে।
ব্যবসার মাল হলে বৎসর অতিবাহিত হলে মালের হিসাব করে বর্তমান বাজারমূল্য ধরে যাকাত দিবে। কত টাকার মাল আছে, পাওনা কত আছে, দেনা কত আছে। এসব হিসাব করে দেনা বাদ দিয়ে, পাওনার হিসাবসহ সকল ব্যবসার মাল হিসাব করে বাজারমূল্য ধরে যা আসবে তার শতকরা আড়াই পার্সেন্ট যাকাত দিবে।
আওয়ার ইসলাম: যাকাত দেওয়ার জন্য রমজানকে বেছে নিচ্ছে মানুষ। এ ব্যাপারে শরিয়তের থীম কী?
মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ: মানুষ এখন রমজানকে যাকাতের মাস বানিয়ে ফেলছে। এটা করার কারণ তো স্পষ্ট- সওযাব বেশি পাওয়া। তবে, অবশ্যই হিসাব রাখতে একটা নির্দিষ্ট তারিখ ধরতে হবে কবে যাকাত ফরজ হয়েছিল, সে হিসাব করে যাকাত দিয়ে দিতে হবে।
আওয়ার ইসলাম: কাদের যাকাত দেওয়া উত্তম?
মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ: কুরআনে যাকাত দেওয়ার আটটি খাত উল্লেখ করা হয়েছে। উত্তমতার বিচারে প্রথমে নিজের আত্মীয় রক্তের বন্ধন গরীবদের দিলে বেশি সওয়াব হবে। এতে করে আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ় হলো, গরীবকে দেওয়ার সওযাব হলো। দ্বিতীয়ত এমন জায়গায় যাকাত দেওয়া উত্তম হবে যেখানে এমন গরীব আছে যারা এই টাকা খেয়ে ভালো মানুষ হয়েছে। সমাজের উপকারে আসে এমন শিক্ষিত হয়েছে আলেম হয়েছে। দেশ সমাজ ও ইসলামের কল্যাণে আসে এমন গরীবদের যাকাত দেওয়া উত্তম। তৃতীয়ত হলো- প্রতিবেশি গরীবদের যাকাত দেয়া।
আওয়ার ইসলাম: একজনকে কী পরিমান যাকাত দেওয়া যাবে?
মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ: আমাদের কেউ কেউ যুক্তি দেখায় যে, দু-একজনকে এমনভাবে যাকাত দেওয়া, যাতে করে সে স্টাবলিষ্ট হয় যায়। এ যুক্তি করা ঠিক আছে, তবে নিজের আশেপাশে এমন গরীব আছে যারা তাদের তুলনায় বেশি মুখাপেক্ষী এদিকটা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। এমন যেন না হয় যে যাকে যাকাত দেয়া হলো তার এ মালের উপরই যাকাত আবশ্যক হয়ে যায়।
হাআমা/