গোটা উম্মাহকে হেদায়েতের আলোয় স্নাত করতে এবারও তুরাগ তীরে বসেছে আল্লাহপ্রেমিকদের মিলনমেলা। দীনদরদি মুসলমানেরা এখানে সমবেত হয়েছেন আলোর দিশা পেতে। দাওয়াত ও তাবলিগের মেহনতের যে ধারা প্রবহমান সেটা এই ইজতেমার মাধ্যমে নতুন গতি পায়। নবী-রাসুলদের থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই কাজের প্রধান রাহবার উলামায়ে কেরাম। উম্মাহর জন্য তাদের অন্তরে রয়েছে বিশেষ দরদ। এজন্য আলেমদের তত্ত্বাবধানে দীনে এই কাজ পরিচালিত হলেই মনজিলে মাকসুদে পৌঁছা সহজ হবে। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন কাউসার লাবীব
দাওয়াত ও তাবলিগে বড়ত্বের কোনো স্থান নেই
হাফেজ মাওলানা মুফতি রুহুল আমীন
-খতিব, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ
প্রচলিত দাওয়াত ও তাবলিগের এই কাজ আল্লাহর পক্ষ থেকে ইলহামিভাবে এসেছে। হজরতজি মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভি রহ.-এর দিলে আল্লাহ তায়ালা এই মেহনতের তাকাজা তৈরি করে দিয়েছিলেন। যার মাধ্যমে তিনি আল্লাহবিমুখ বান্দাদের আল্লাহর সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে এই কাজ এখন বিশ্বের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে।
মাওলানা ইলিয়াস রহ. যখন এই মেহনত শুরু করেন তখন তাঁর অন্যতম ইচ্ছে ছিল, ‘প্রত্যেক জামাতে যেন একজন করে আলেম থাকে; যার ফলে এই কাজ ফলপ্রসূ হবে।’ আলহামদুলিল্লাহ, আমরা দেখছি সারা বিশ্বে বিশেষ করে আমাদের বাংলাদেশে সঠিক উসুলের ওপর থাকা আলেমরা ব্যাপকভাবে এই কাজের সঙ্গে জুড়ে রয়েছেন। এর ফলে ইলিয়াস রহ.-এর মানসাও পূরণ হচ্ছে আর সাধারণ মানুষও আলেমদের সোহবতে দাওয়াত ও তাবলিগের সঠিক মেহনতে যুক্ত থাকতে পারছে।
আসলে দাওয়াত ও তাবলিগ নির্দিষ্ট কোনো দল বা জামাতের নাম নয়। যে ব্যক্তি এই মেহনতের তাকাজা দিলে নিয়ে উম্মতের জন্য কাজ করবে এই কাজ তারই। এখানে নেতৃত্ব, বড়ত্ব, পদের কোনো স্থান নেই। এই মেহনতের উসুল সেটাই বলে। তাই পদ বা নেতৃত্ব নিয়ে বাড়াবাড়ি করে কেউ যদি এই মেহনতকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়, তাহলে তাকে এসব থেকে ফিরে আসতে হবে। এটা কোনোভাবেই উচিত নয়। আমরা দেখেছি, কারও কারও পক্ষ থেকে এমন কিছু বিষয় প্রকাশ পেয়েছে, যা উলামায়ে দেওবন্দ তথা হকপন্থী উলামায়ে কেরামের মেজাজের খেলাফ। আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমি প্রত্যাশা করবো, যারা এসব মানসিকতা লালন করেন তারা এ থেকে ফিরে আসবেন এবং দাওয়াত ও তাবলিগের সঠিক মেহনতে যুক্ত হবেন।
সবশেষে আমি স্মরণ করছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা; যিনি বিশ্ব ইজতেমা ময়দান ও কাকরাইল মসজিদের জায়গা দিয়েছিলেন। আল্লাহ তায়ালা এর উত্তম প্রতিদান তাঁকে দিক। আমিন।
তাবলিগের মেহনতকে উলামায়ে কেরামের আরও জোরদার করতে হবে
মুফতী আরশাদ রহমানী
সভাপতি, তানযিমুল মাদারিসিদ দ্বীনিয়া বাংলাদেশ
বিশ্বব্যাপী ইসলাম প্রচারে অনন্য ভূমিকা রাখছে প্রচলিত দাওয়াত ও তাবলিগ। উলামায়ে কেরামের মাধ্যমেই দাওয়াত ও তাবলিগের সূচনা হয়। মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভি রহ. নিজের পুরো জীবনকে ওয়াকফ করেছিলেন এই মহান দাওয়াতকে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। শাইখুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান দেওবন্দি রহ.-এর এই শাগরিদের অন্তরে আল্লাহ তায়ালা ত্যাগের মেহনত ঢেলে দিয়েছিলেন। তাঁকে দান করেছিলেন ইখলাস ও মুজাহাদার দৌলত। তিনি ইখলাস ও মুজাহাদার সঙ্গে মুসলমানদের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো সংশোধন করতে দাওয়াতের কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। এরপর দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁর সাহেবজাদা মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভি রহ.। এরপর মাওলানা ইনামুল হাসান রহ.। তাবলিগের ইতিহাস বলছে, উলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে ও উলামায়ে কেরামের দিকনির্দেশনার আলোকে এই দাওয়াত ও তাবলিগের মেহনতের প্রভাব আজ সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছে।
ভুলে গেলে চলবে না, আল্লাহ তায়ালা দীনের তাবলিগের দায়িত্ব কিন্তু উলামায়ে কেরামের ওপরই দিয়েছেন। তাই এই মেহনতের সঙ্গে আরও বেশি বেশি উলামায়ে কেরামকে সম্পৃক্ত হতে হবে। এই মেহনতকে আরও জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি তাবলিগের সাধারণ সাথী ভাইদের মনে রাখতে হবে, দাওয়াতের কার্যক্রম শুধু এক পদ্ধতির মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। মানুষ এই তাবলিগের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে উপকৃত হচ্ছে, এর সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু এর পাশাপাশি দরস-তাদরিস, খানকাহি মজমা, তাসাওউফ, তাসনিফাত, ওয়াজ-নসিহতও দাওয়াতের অন্যতম মাধ্যম। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে যেভাবেই যারা দীনের সহিহ দাওয়াতের কাজ করছে, তারা সবাই সবার জন্য কল্যাণকামী হতে হবে। নিজেদের মধ্যে জোর, মিল, মহব্বত নিয়ে কাজ করতে হবে।
৫৭তম বিশ্ব ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের জন্য এই জমায়েত হোক হেদায়েতের মাধ্যম। আল্লাহর রাস্তায় নিজেদের জান, মাল কোরবানির মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির পথ সুন্দর হোক। সবাই সবার জন্য কল্যাণের দোয়া করি। শেষ রাতের মোনাজাতে দু’ফোটা অশ্রু ফেলে দেশ ও মুসলিম উম্মাহর শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করি।
আলেমদের ছায়ায় থেকেই দীনের কাজ করতে হবে
মাওলানা ইয়াহইয়া মাহমুদ
-মুহতামিম, জামিয়া ইসলামিয়া আযমিয়া দারুল উলূম রামপুরা ঢাকা
বিশ্ব ইজতেমা আমাদের দেশের জন্য গর্বের ধন। আমরা এই ইজতেমার কারণে বিশ্বে পরিচিত। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে বাছাই করা আল্লাহর প্রিয় বান্দারা এখানে সমবেত হন। তাদের জানমাল উৎসর্গ করেন। দীনের প্রচার-প্রসারের ব্যাপারে ফিকির করেন। এখানে শরিক হতে পারাটা নিঃসন্দেহে যেকোনো মানুষের জন্য হেদায়েতের একটা বড় উপলক্ষ হতে পারে।
লাখো মানুষের এই জমায়েতে অনেক বড় আউলিয়া গাউস কুতুবরাও আছেন। যাদের সিনার ভেতরে আল্লাহ পাকের মহব্বত, তার ভয়ভীতির নুর ঝলমল করে। এজন্য যাদের সুযোগ আছে সবারই এখানে উপস্থিত হওয়াটা দরকার। কারণ আল্লাহওয়ালাদের সান্নিধ্য অনেক বড় নেয়ামত। আল্লাহকে পেতে চাইলে তার প্রিয় বান্দাদের সান্নিধ্য জরুরি। বিশেষ করে বর্তমান প্রেক্ষাপটে যখন সব দিকে ফেতনা চলছে, তাবলিগের মতো একটি স্বচ্ছ ও ইখলাসপূর্ণ কাজকেও বিতর্কিত করার চক্রান্ত অব্যাহত আছে। মহৎ এই কাজকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করছে কোনো কোনো মহল। এজন্য বর্তমানে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়া আরও বেশি প্রয়োজন।
উলামায়ে কেরাম জাতির অভিভাবক, উম্মতের রাহবার। আল্লাহর রাসুল সা. উলামায়ে কেরামকে এই মর্যাদায় ভূষিত করে দিয়ে গেছেন। নবীজি সা. বলেছেন, উলামায়ে কেরামের নবী-রাসুলদের উত্তরাধিকারী। নবী করিম সা. খাতামুন নাবিয়্যিন বা শেষ নবী। তার পরে আর কোনো নবী আসবেন না। বর্তমান যুগে আলেমরাই নবী-রাসুলদের স্থলাভিষিক্ত। এই যুগে নবীওয়ালা কাজ আলেমদের মাধ্যমেই হচ্ছে। সুতরাং মুসলিম জাতি তাদের অভিভাবকদের ছেড়ে যদি এদিক-সেদিক চলা শুরু করে তাদের পদস্খলন হবে, দুর্ঘটনা ঘটবে। যে দ্বীনি কাজে আলেমদের অভিভাবকত্বের ছায়া নেই, সেই কাজ কখনো কামিয়াব হয় না, এটা পরীক্ষিত সত্য। এজন্য যেকোনো মূল্যে আলেমদের সঙ্গে থাকতে হবে, তাদের ছায়ায় থেকেই দীনের কাজ করতে হবে।
ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রতি আমার আহ্বান থাকবে, যারা মহৎ এই কাজে ফেতনা সৃষ্টি করতে চায়, তাদের ব্যাপারে সবাই সতর্ক থাকবেন। হেকমত ও কৌশলের সঙ্গে চলবেন। এমন কিছু করা যাবে না যাতে সাধারণ মানুষের কাছে ভুল বার্তা যায়। সাধারণ মানুষের মধ্যে যেন আলেমদের সম্পর্কে কোনো কুধারণা সৃষ্টি না হয়।
তাবলিগ জামাত আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত কাফেলা। এর সূচনা করেছেন হজরত মাওলানা ইলিয়াস রহ., যিনি একজন বিখ্যাত দেওবন্দি আলেম ছিলেন। শুরু থেকেই এই কাজের পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছেন উলামায়ে দেওবন্দ। যত দিন এই কাজ উলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে, তত দিনই এটি নিরাপদ। তত দিনই এর দ্বারা উম্মতের হেদায়েত নসিব হবে। আল্লাহপাক মকবুল এই কাজকে সব ধরনের ফেতনা থেকে নিরাপদ রাখুন। সবাইকে খালেস দ্বীনের জন্য কাজ করার তাওফিক দিন। আগত ইজতেমাকে গোটা উম্মতের হেদায়েতের অসিলা করুন।
দাওয়াত ও তাবলিগের ইতিবাচক চিন্তা-চেতনা ছড়িয়ে পড়ুক
হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ যুবায়ের
-আহলে শূরা, তাবলিগ জামাত
দাওয়াতি ও তাবলিগের মেহনতকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ময়দানের দাওয়াতি কার্যক্রমের পাশাপাশি তাবলিগ বিষয়ে রচিত কিতাবাদিরও অবদান কম নয়। দাওয়াত ও তাবলিগের বড় একটি অনুচ্ছেদ হলো তালিম; যেখানে কিতাবি তালিমের মাধ্যেমে সাধারণ মানুষ নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, জিকির, সাদাকাহ, কুরআন তেলাওয়াতের ফজিলত ও সাহাবিদের জীবনী জানতে পারে। শিখতে পারে। হজরতজি মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভি রহ. তাসনিফাতের কাজকে নফি করেননি। বরং এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন। আমরা যদি দেখি, তাবলিগের শুরুলগ্নে, তাবলিগি মেহনতে অংশগ্রহণকারীদের তালিম-তরবিয়তের জন্য হজরতজি রহ. একটি কিতাব রচনার তীব্র প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এরপর তিনি ভাতিজা শায়খুল হাদিস হজরত মাওলানা জাকারিয়া সাহেবকে দিলের অবস্থা জানিয়ে একটি কিতাব রচনার নির্দেশ দেন। তখন তিনি ফাজায়েলে তাবলিগ, ফাজায়েলে নামাজ, ফাজায়েলে জিকির, ফাজায়েলে কুরআন ইত্যাদি বিষয়ে খণ্ড খণ্ড কিতাব লেখেন। পরবর্তী সময়ে এই খণ্ড কিতাবগুলোর সমন্বিত রূপই হলো ‘ফাজায়েলে আমল’।
কিতাবটি আল্লাহ তায়ালা এতো পরিমাণে কবুল করেছেন যে, তাবলিগের মেহনতের সাথে জড়িত সবাই নিজ নিজ বাসায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এবং মসজিদে নিয়মিত ফাজায়েলে আমল কিতাবের তালিম করেন। যারা তাবলিগে তিন দিন, ৪০ দিন (একচিল্লা), ১২০ দিন (৩ চিল্লা) বা এক বছরের জন্য ব্যক্তিগত খরচে জামাতে বের হন, তারাও প্রতিদিন এই কিতাব থেকে তালিম গ্রহণ করেন। এই তালিমের কারণে ঘরের মুসলমান মহিলা ও শিশুরা নিয়মিত নামাজ আদায় করছেন। এতে সমাজে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
এছাড়া তাবলিগ বিষয়ে তাসনিফাতের কাজ করেছেন হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ., মাওলানা মুহাম্মদ মনযূর নোমানী রহ., মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভি রহ., মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ, সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ., মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী রহ. ও মাওলানা উমর পালনপুরী রহ. প্রমুখ। পাশাপাশি বাংলা ভাষায় তাবলিগ বিষয়ে ব্যাপক কাজ করেছেন মুফতী মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ সাহেব।
আমার অত্যন্ত খুশি লাগছে যে, বর্তমান তরুণ প্রজন্মও তাবলিগ বিষয়ে তাসনিফাতের কাজ করছে। দাওয়াত ও তাবলিগের মেহনত ও কার্যক্রমকে সর্বসাধারণের মাঝে পৌঁছাতে তারা এগিয়ে আসছে। জানতে পারলাম, বর্তমান সময়ে লেখালেখির অঙ্গনে সুনাম অর্জন করা বেশ কয়েকজন তরুণ আলেমের উদ্যোগে ‘ইজতেমা প্রতিদিন’ নামে একটি বিশেষ সাময়িকী প্রকাশ হচ্ছে। আমার দিল থেকে তাদের জন্য দোয়া রইলো। আশা করছি তাদের এই উদ্যোগ দাওয়াত ও তাবলিগের ইতিবাচক চিন্তা-চেতনা দেশব্যাপী আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করবে।
কেএল/