এদেশে দ্বীনের আলো বিলাতে এবং মানুষের মাঝে ইসলামের চর্চাকে সমৃদ্ধ করতে যুগ যুগ ধরে কাজ করছে কওমি মাদরাসাগুলো। মুসলিম জীবনের নানা বিষয়ের সমাধানের জন্য এসব মাদরাসায় রয়েছে স্বতন্ত্র গবেষণা বিভাগ। যেগুলো পরিচিত ‘ফতোয়া বিভাগ’ নামে। যুগ ও সময়ের চাহিদা পূরণে এ বিভাগে সমাধান হওয়া মাসয়ালা-মাসায়েল অফলাইনের পাশাপাশি এখন অনলাইনে মানুষ পেতে চায়। কিন্তু কী কারণে ঐতিহ্যবাহী এসব প্রতিষ্ঠান এদিক দিয়ে বহির্বিশ্বের তুলনায় এখনো পিছিয়ে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে ন আওয়ার ইসলামের চিফ রিপোর্টার হাসান আল মাহমুদ। তার ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব-
(প্রথম পর্বের লিঙ্ক- তথ্য প্রযুক্তিতে এখনো পিছিয়ে বাংলাদেশের ফতোয়া বিভাগগুলো!)
ফতোয়া বিভাগগুলোর ওয়েবসাইটের প্রয়োজনীয়তা কেন? এ বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে চাঁদপুরের কচুয়ায় অবস্থিত জামিয়া ইসলামিয়া আহমদিয়া মাদরাসার ফতোয়া বিভাগের উস্তায ও মুহাদ্দিস মুফতি আজিজুল্লাহ আশরাফ বলেন, ‘খেয়াল করলে দেখবেন আরবী-উর্দূ ফতোয়ার বড় বড় সাইট আছে৷ নির্ভরযোগ্য যেমন আছে ভেজালভর্তি সাইটও আছে৷ মানে শিয়া, জাফরী, সুন্নি, বেরেলভী, লা মাযহাবীসহ মোটামোটি সবাইকেই সরব পাবেন এখানে৷ আমাদের এ জায়গাটাতে বেশ শূণ্যতা দৃশ্যমান৷ যতটুকু আছে, অধিকাংশই অনির্ভরযোগ্য৷ দরকার ফিক্হ ফতোয়ার দক্ষ, আগ্রহী এবং অনলাইন দা'ওয়া ও ফতোয়া প্রদানে প্রশিক্ষিত, জাতির ভেতরকার খবর রাখা ছাত্র-শিক্ষকের।’
প্রতিষ্ঠানের ফতোয়া বিভাগের নিজস্ব ওয়েবসাইটের প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে অবস্থিত জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া ইফতা দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাঈমুল হাসান তানযীম ওয়েবসাইটকে যুগ চাহিদার দাবী আখ্যায়িত করে বলেন, ‘বর্তমান সময়ে দারুল ইফতা বা ফতোয়া বিভাগের গুরুত্ব কতোটুকু- তা বলাই বাহুল্য। মানুষ এখন যার তার কাছে দ্বীনি সমাধান খুঁজতে যায় না। খোঁজে নির্ভরযোগ্য কোনো আলেম অথবা মানসম্মত ফতোয়া বিভাগ। দিন দিন এই বিভাগটির প্রয়োজনীয়তা বাড়ছেই। সেইসঙ্গে মানুষ এখন ভার্চুয়ালমুখী। তথ্য প্রযুক্তির অবাধ সুযোগে জীবন এখন অনেকটাই সহজতর। এমনকি ধর্মীয় বিষয়-আশয়ও এখন অনলাইনে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মানুষ আর আগের মতো সরাসরি আলেমদের কাছ থেকে সমাধান নিতে যায় না। খোঁজে সে বিষয়ে ইন্টারনেটে কী আছে।’
এই শিক্ষার্থী আরো জানান, বাংলাদেশের ফতোয়া বিভাগগুলোকে ইন্টারনেট এবং আধুনিক তথ্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো সময়ের দাবী। প্রতিটি ফতোয়া বিভাগগুলোর নিজস্ব ওয়েবসাইট এবং অনলাইন এক্টিভিটির মাধ্যমে দ্বীনদার মানুষদের জন্য প্রয়োজনীয় মাসআলা-মাসায়েল জানা অনেকটাই সহজ হয়ে উঠবে। মানুষ তখন ভুল জায়গায় গিয়ে ভুল সমাধান পেয়ে বিড়ম্বনায় না পড়ে সঠিক জায়গা থেকে দ্বীনি সমস্যাগুলোর সমাধান পাবে। তাই ফতোয়া বিভাগগুলোর যাবতীয় কার্যক্রম অফলাইনের পাশাপাশি অনলাইনেও বিস্তৃত হলে অনেক বেশি পরিমাণ মানুষের কাছে প্রচারিত হওয়ার দরুন সকলের জন্য দ্বীনি সমস্যার সমাধান লাভ করা সহজলভ্য হবে। তাই অনলাইন এক্টিভিটির ব্যপারটা নিয়ে চিন্তা করা যেতে পারে। এটি যুগ চাহিদা ও সময়ের দাবীও। আশা করি, বিষয়টির গুরুত্ব দেবেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।’
ময়মনসিংহ সদরে অবস্থিত জামিয়া আরাবিয়া মাখযানুল উলূমের ফতোয়া বিভাগের শিক্ষার্থী আবরার নাঈম বলেন, ‘বর্তমান যুগ তথ্য প্রযুক্তির। বিজ্ঞানের সব ধরনের অত্যাধুনিক আবিষ্কার এখন মানুষের হাতের মুঠোয়।
এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষ দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে উন্নতি ও অগ্রগতি পথে। অফিস-আদালত, কলকারখানা ও উন্নতমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ব্যাপকহারে বাড়ছে প্রযুক্তির ব্যবহার। তবে এদিক দিয়ে একেবারে পিছিয়ে রয়েছে কওমি মাদ্রাসাগুলো। বিশেষ করে মাদ্রাসার ফতোয়া বিভাগ যেখানে বিভিন্ন মাসআলা নিয়ে গবেষণা করা, সেখানে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আধুনিক প্রযুক্তির। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে তো এসব প্রযুক্তির উপস্থিতি একেবারে শূন্যের কোঠায়। আবার কোনো প্রতিষ্ঠানে থাকলেও সেটা খুবই নগণ্য।
এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘যারা ফতোয়া বিভাগে পড়াশোনা করে তাদের জন্য এসব প্রযুক্তি ব্যবহার অত্যান্ত জরুরি। কারণ অনেক মাসআলার দলিল হাতের নাগালে বিদ্যমান থাকা কিতাবসমূহে পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে আরব বিশ্বের বিভিন্ন কিতাবের মুখাপেক্ষী হতে হয়। যেখানে বর্তমান সময়ের বিভিন্ন আধুনিক মাসআলার সমাধান উল্লেখ আছে। আর এক্ষেত্রে কম্পিউটার বা ল্যাপটপের ব্যবহার একান্ত প্রয়োজন। তাছাড়া দৈনন্দিন যেসকল মাসয়ালা ছাত্ররা তামরীন করছে সেগুলো সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন ভালো এবং মানসম্মত একটি ওয়েবসাইট। যাতে মাসআলাগুলো সংরক্ষণও হবে আবার পাশাপাশি সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে। তাই এক্ষেত্রে পিছিয়ে না থেকে সময়ের দাবি হিসেবে আধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহারে এগিয়ে আসা প্রয়োজন মনে করছি।’
এদিকে নারায়ণগঞ্জ সাইনবোর্ড ফতুল্লার জামিয়া আশরাফিয়া শান্তিধারা মাদরাসার ইফতা দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান মারুফ বলেন, ‘বর্তমান সময়ে ইন্টারনেট একটা আবশ্যক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এটা ব্যতীত মানুষের জীবন যাপন ও বহির্বিশ্বের খবরাখবর নেওয়া প্রায়ই অসম্ভব হয়ে গেছে। মানুষের কোন কিছুর প্রয়োজন হলেই সরাসরি ইন্টারনেটে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ভিজিট করে। এমন কি শরীয়তের মাসয়ালার ক্ষেত্রেও এই পন্থারই অবলম্বন করে। কিন্তু ইন্টারনেটে অধিকাংশ ওয়েবসাইট বাতিল ফেরকা ও ইহুদি খ্রিস্টান মিশনারীদের দখলে, এবং তারাই পরিচালনা করে। যার কারণে কোনটি হক কোনটি বাতিল পূর্ব ধারণা ব্যতীত চেনা অসম্ভব। সমকালীন মাসয়ালা-মাসায়েল ও ধর্মীয় বিষয়ে যাবতীয় তথ্যের জন্য আহলে হক ওলামায়ে কেরামের একটা প্লাটফর্ম থাকা একান্ত জরুরী। এবং সেটা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হবে। যেকোনো বিষয়ে সেটা হতে ফায়দা নিতে পারবে। তাই একটি ওয়েবসাইট থাকা আবশ্যিক পর্যায়ে পরিণত হয়েছে।
ওয়েবসাইটের কিছু উপকারিতা আর কিছু ক্ষতিও আছে বলে জানান এই শিক্ষার্থী-
‘ইন্টারনেট ব্যবহার করে না এমন মানুষ খুব কমই আছে। মানুষ যাবতীয় সেখান সার্চ করে। কারণ হচ্ছে এতে সবকিছু হাতের নাগালেই পাওয়া যায়। যেকোনো বিষয়ে প্রয়োজন হলেই গুগল ইউটিউবের সার্চ ইঞ্জিনে গিয়ে লিখে সার্চ করে, আর মুহূর্তে গুগল ইউটিউব একটি উত্তর তৈরি করে সামনে পেশ করে। অপরদিকে সার্চকারী সেটাকে চূড়ান্ত বলে বিশ্বাস করে এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ইচ্ছে করে মানুষের জনজীবন আরও সহজ হয়ে গেছে।’
ক্ষতির দিক সম্পর্কে শিক্ষার্থী বলেন, ‘এই ইন্টারনেটের কারণে মানুষ হক বাতিল না চিনে সব একসাথে করে ফেলে, এমনকি বিভ্রান্ত হয়ে যায়। যার ফলে একজন সাধারন মানুষ আহলে কোরআন হিজবুত তাওহীদ ও আহলে হাদিস ইত্যাদি হয়ে গেছে বলে খবর পাওয়া যায়। এই ইন্টারনেটে মানুষের প্রয়োজন পূরণ হয়ে গেলে মানুষ ওলামায়ে কেরামের নিকট যাবে না এবং পরামর্শ গ্রহণ করবে না। এতে করে মানুষ দিন দিন পথভ্রষ্ট হতে থাকবে এবং ভ্রষ্টতার আকার বৃদ্ধি পেতে থাকবে। মানুষ যে কোন বিষয়ে ওলামায়ে কেরামের উপর পাণ্ডিত্য দেখাবে এবং চড়ে বসবে। এটা বর্তমানে চলছেও।’
এর সমাধান কী?
এ প্রসঙ্গে এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘ইলেম একমাত্র ওস্তাদের সংশ্রব থেকেই অর্জন হয়। প্রবাদ আছে- এলেম অন্তর থেকে অন্তরে যায়। তাই কোন আহলে হক আলেমের থেকে যে কোন বিষয়ে সরাসরি সমাধান নেওয়ার বিকল্প নেই। কিন্তু যুগের আধুনিকতার কারণে আমরা এমন একটা ধারপ্রান্তে উপস্থিত হয়েছি, যেখানে ওয়েবসাইট থাকা এবং মানুষকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে দ্বীন সম্পর্কে জানানো একান্ত অবশ্যক হয়ে গেছে। সর্ব দিক বিবেচনায় আমি বলব আহলে হক ওলামায়ে কেরামের জন্য, ও প্রত্যেকটি ইফতা বিভাগের জন্য এমন একটি ওয়েবসাইট থাকলে যাতে মানুষ ইসলামিক সকল বিষয়ে সমাধান খুব সহজে পেয়ে যাবে এবং এর জন্য কোন ধরনের কষ্ট পোহাতে হবে না, যার ফলে মানুষ সঠিক দ্বীনের সন্ধান পাবে। এবং তারা কোরআন-সুন্নাহ, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈ, ও তাবে তাবেঈ, আইম্মায়ে মুজতাহিদীনদের মাধ্যমে আমাদের পর্যন্ত যে দ্বীন এসেছে সেটা জানতে পারবেন।
হ্যাঁ, তবে উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টন, বিয়ে-শাদি ও তালাকের মাসালার ক্ষেত্রে সরাসরি কোন বিজ্ঞ মুফতি সাহেবের শরণাপন্ন হওয়ার শর্ত করে দিতে হবে।’
চলবে...
কেএল/