সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ১৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ইউকে লন্ডন মহানগরের সীরাত সম্মেলন অনুষ্ঠিত ‘শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ ছিল দেশে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ’ ২৪ ঘণ্টার নিবিড় পর্যবেক্ষণে ইসলামী আলোচক আব্দুল হাই মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ প্রকাশিত হচ্ছে আল্লামা মাহমুদুল হাসানের ‘হাসানুল ফতোয়া’ তাড়াইলে মাদক-জুয়া ও অনৈতিক কার্যকলাপের প্রতিবাদে আলেমদের সমাবেশ নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে, দ্রুতই রোডম্যাপ : ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পূর্ণাঙ্গ ভাষণ যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় মজলিসে দাওয়াতুল হকের ইজতেমা শনিবার বাংলাদেশ সফরে এলেন দেওবন্দের উস্তাদ মুফতি ফখরুল ইসলাম এলাহাবাদী আগামীকাল শরীফগঞ্জে আসছেন সাইয়েদ আরশাদ মাদানী

মে দিবসের চেতনা ও ইসলামী শ্রমনীতির সংগ্রাম

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

মহান মে দিবস শ্রমজীবি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে এক অনন্য গৌরবময় দিন। আজ থেকে ১৩৭বছর আগে ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শ্রমিক সংগঠনের যে বিজয় সূচিত হয়েছিল তারই ধারাবাহিকতায় শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে বিশে^ যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। কর্ম ঘন্টা নির্ধারণ, শ্রমিকের মর্যাদা ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে শ্রমিকরা যে আত্মত্যাগ করেছিলেন তা অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। শিকাগো শহরে “মকরম্যাক রীপার ওয়ার্কস” নামক শিল্প প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটি শ্রমিকদের রক্তদানের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল মে দিবসের ইতিহাস। এই ঘটনার ৩ বছর পর ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সমাবেশ। এ সমাবেশে প্রতিবছর মে মাসের প্রথম দিনকে বিশ্বব্যাপী “আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস” হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এর পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মে দিবস পালিত হয়ে আসছে।

পরবর্তীকালে ১৯১৯ সালে আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএলও গঠিত হয়। কাজের সময়সীমা সম্পর্কে কনভেনশন গৃহীত হয়। এই কনভেনশন পর্যায়ক্রমে পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেরই অনুসমর্থন লাভ করে। কনভেনশনের বিধান মোতাবেক স্ব-স্ব দেশে কাজের সময়সীমা সম্পর্কে আইন প্রণীত হয়। শ্রমিকদের এ আন্দোলনের ফলে শ্রমিক সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়ন স্বীকৃতি পায়। ক্রমান্বয়ে শ্রমিকদের সামাজিক গুরুত্ব, দাবী আদায়ের আইনগত অবকাঠামো গড়ে উঠে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রম আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়। মজুরী নির্ধারনের জন্য মজুরী বোর্ড ও মজুরী কমিশন গঠিত হয়। চাকুরীর শর্তাবলীর বিধান নির্দিষ্ট হয়। প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার স্বীকৃতি পায়। এসব শ্রমিক আন্দোলনেরই প্রতিফলন তাতে কোন সন্দেহ নেই।

মে দিবসের চেতনা : বাস্তবে কি এত সব ব্যবস্থার পরও মেহনতী, দুঃখী বঞ্চিত শ্রমিক সমাজের প্রকৃত মুক্তি অর্জিত হয়েছে? এ প্রশ্ন আজ বিশ^ জুড়ে। শ্রমিকদের ভাত-কাপড়, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানের মত মৌলিক অধিকার আজ শুধু শ্লোগান আর নোংরা রাজনীতির অংশ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। শ্রমিকের মুক্তির শ্লোগানকে পুঁজি হিসাবে ব্যাবহার করে ক্ষমতার সিঁড়ি বানিয়ে এক শ্রেণীর শোষক নেতৃত্ব নিজেদের ভাগ্য বদল করেছে। কিন্তু অভাগা শ্রমিকদের ভাগ্যের বদল হয়নি। শ্রমিক শ্রেণীর প্রকৃত মুক্তি অর্জিত হয়নি। অন্নহীন, বস্ত্রহীন, আশ্রয়হীন, শ্রমজীবি মানুষের আহাজারি আজও দিকে দিকে ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত। আমরা বলতে বাধ্য যে, কার্যত মে দিবসের প্রকৃত চেতনা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। শ্রমিকের প্রকৃত মুক্তির চেতনা আলোর মুখ দেখেনি। মে দিবসের তাৎপর্য, মে দিবসের চেতনা তাহলে কি? মে দিবসের চেতনা হলো শ্রমিকের কল্যাণ, তাদের জীবন মানের উন্নয়ন, ন্যায্য মজুরী নির্ধারণ, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, শ্রমের মর্যাদা, শ্রমিকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি, উৎপাদনশীলতা, শ্রমিক-মালিক সু-সম্পর্ক। এ সবই যেন আজ সোনার হরিণ। সুদুর পরাহত তাই বিশ্বায়ন ও মুক্ত বাজার অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে শ্রমিক সমাজকে তার প্রকৃত অধিকার ফিরিয়ে দিতে আজ প্রয়োজন নতুন এক সংগ্রামের। নতুন বিশ^জয়ী অনুপম এক শ্রমনীতি বাস্তবায়নের। সেই আদর্শ হলো কালজয়ী আদর্শ, বিশ্বনবী (সা.) এর আদর্শ। যে আদর্শ শ্রমনীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে মহানবী (সা.) দুনিয়ার মেহনতী মানুষকে প্রকৃত মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে তাদের মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন। যার নজির বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই।

ইসলামী শ্রমনীতি : ইসলাম মানবজাতির জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে একমাত্র পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। মানুষের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি, রাজনীতি, বিচার ব্যবস্থা, শ্রমনীতি, ব্যবসানীতি, যুদ্ধনীতি, পরারাষ্ট্রনীতি তথা আন্তর্জাতিক নীতিসহ সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে সকল দিক ও বিভাগের মৌলিক বিধিবিধান সমূহ মহান আল্লাহতায়ালা ওহীর মাধ্যমে কুরআন মজিদে নাযিল করেছেন। যা প্রিয়নবী (সা.) এর জীবনের অনুপম আদর্শের মাধ্যমে মানব জাতির কাছে পৌঁছেছে। জীবনের সকল ক্ষেত্রে এই নীতি ও আদর্শের অসুসরনের মধ্যেই মানবতার কল্যাণ নিহীত রয়েছে। এর ব্যতিক্রম কোন আইন, বিধান, নীতি যেমন আল্লাহর কাছে গ্রহনযোগ্য নয়, তেমনি তাতে মানব জীবনের দুনিয়া ও আখিরাতের প্রকৃত কল্যাণও সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ কুরআনে মজিদে এরশাদ করেন-“নি:সন্দেহে জীবন বিধান হিসাবে আল্লাহ তায়ালার কাছে ইসলামই একমাত্র জীবন ব্যবস্থা” (আলে ইমরান-১৯)।

“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে (জীবন ব্যবস্থা) পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নিয়ামত সম্পূর্ন করলাম। আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা) হিসাবে পছন্দ করলাম” (সূরা মায়েদাহ-৩)।

তাই ইসলামের সকল দিক ও বিভাগের মধ্যে শ্রমনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শ্রমজীবি-পেশাজীবি মানুষের অধিকার মর্যাদা, মজুরীনীতি, চাকুরীর নিশ্চয়তা, মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক উভয়ের প্রতি কর্তব্যবোধ, উৎপাদনশীলতা, শ্রমবিরোধ নিস্পত্তি, চাকুরীবিধি ইত্যাদি সংক্রান্ত ইসলামী আইন ও বিধিকে ইসলামী শ্রমনীতি বলে। অর্থাৎ উল্লেখিত বিষয় ও সমস্যাসমূহের সমাধান করার জন্য কুরআন ও হাদীসের আলোকে যে মূলনীতি রচনা করা হয়, তাকে ইসলামী শ্রমনীতি বলে। ইসলামী শ্রমনীতির ইতিহাস মানবতার ইতিহাসের মত সুদীর্ঘ। হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সময়ে তা পরিপূর্ণতা লাভ করে এবং খলিফাদের যুগে তা পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়িত হয়। ইসলামের এই শ্রমনীতির সুফল সমাজের সকল স্তরে পরিব্যাপ্ত। এর দ্বারা শ্রমিক মালিক নির্বিশেষে সকল মানুষই লাভবান হবে। বরং এই শ্রমনীতি অনুসরণ করলে সামাজিক শান্তি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হওয়ার মাধ্যমে গোটা মানবতা উপকৃত হবে।

ইসলামী শ্রমনীতি বাস্তবায়িত হলে মালিক শ্রমিকের মধ্যে কোন দ্বন্ধ থাকবেনা। কেউ কাউকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে না, সবাই ভাই হিসেবে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে দুনিয়ার জীবনে শান্তি ও আখিরাতে মুক্তির প্রত্যাশা করবে। সকল বিষয় আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতার চেতনা জাগ্রত হবে।

আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক শ্রমজীবি মানুষ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, ইসলামী শ্রমনীতি সম্পর্কে সুষ্ঠ কোন ধারণা তাদের নেই। এমন কি রাষ্ট্রীয় বা সামাজিকভাবেও শ্রমজীবি মানুষকে “ইসলামী শ্রমনীতি” বা তার সুফল সম্পর্কে জানাবার কোন উদ্যোগ প্রচেষ্টা দৃশ্যমান নয়। বরং মানবরচিত মতবাদ ও আইন বিধানের চর্চা শ্রমিক সমাজকে দিকভ্রান্ত করে ফেলেছে। তাই পথহারা শ্রমিক সমাজের প্রকৃত মুক্তি ও মর্যাদার জন্য ইসলামী শ্রমনীতির জ্ঞানচর্চা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন ইসলামী শ্রমনীতির সংগ্রামকেও জোরদার করা। মে দিবসের মূল চেতনা তখনই বাস্তবায়ন হবে যখন ইসলামী শ্রমনীতির সুফল সম্পর্কে জনগণকে জাগ্রত করে ইসলামী শ্রমনীতির সংগ্রামকে জোরদার করা যাবে। নিম্নে ইসলামী শ্রমনীতির মৌলিক কয়েকটি বিধান উল্লেখ করা হলো:
মালিক শ্রমিক ভ্রাতৃত্ব : ইসলামের দৃষ্টিতে মালিক আর শ্রমিকের সম্পর্ক মনিব আর দাসের মত নয়। বরং তাদের সম্পর্ক ভাই ভাইয়ের। তারা একজন আরেক জনের অধীনে শ্রম দিতে আইনানুগভাবে বাধ্য ছিলনা। যেমন দাস তার মনিবের প্রতি আনুগত্যের শ্রম দিতে বাধ্য থাকে। বরং একজন শ্রমিক তার নিজের আর্থিক প্রয়োজনে-আর অপর ভাইয়ের প্রতি সহযোগিতার মনোভাব এই দুইয়ের সংমিশ্রণ হয়েছে বলেই তার আরেক ভাইয়ের অধীনে কাজ করতে এসেছে। একইভাবে ধনী লোকটিও নিজের পন্য উৎপাদনের প্রয়োজন এবং গরীব ভাইটির প্রতি সহযোগিতার মনোভাব এই দুইয়ের সংমিশ্রন হয়েছে বলেই তার আরেক ভাইকে নিজের অধীনে কাজে খাটিয়েছে।

মহান আল্লাহ বলেন: ‘নিশ্চয়ই মুমিনরা ভাই-ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে ( কোন বিরোধ হলে) সংশোধন করে নাও”। “আর আল্লাহকে ভয় করো। আশা করা যায় যে, তোমাদের প্রতি রহম করা হবে” (সূরা হুজরাত-১০)।

শ্রমিকদের প্রতি সদাচারণের ব্যাপারে মহান আল্লাহর সাধারণ ঘোষনা আল কুরআনের নিন্মোক্ত আয়াতে পাওয়া যায়: “আর মুমিনদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করে তুমি তাদের প্রতি ‘হে মমতার ডানা অবনতিম করো” (সূরা শু’য়ারা-২১৫)।

অতএব, একথা মাথায় রেখেই একজন শ্রমিককে কাজে খাটাতে হবে যে, সে আমাদের ভাই এবং তার ব্যাপারেও আমি মহান আল্লাহর কাছে জিজ্ঞাসিত হবো। সকলেই আদমের সন্তান তাই শ্রমিক-মালিক ভাই-ভাই। এ কারণে একজন শ্রমিককে হীন মনে করা যাবে না, তাকে অধিকার বঞ্চিত করা যাবে না। ইসলামী বিধানে শ্রমিক-মালিক কোন ভেদাভেদ থাকবেনা। সবাই অনুগত ও আল্লাহর বান্দাহ হিসাবে জীবন যাপন করবে।

ন্যায্য মজুরী : শ্রমের বিনিময়ে উপুক্ত পারিশ্রমিক পাওয়া একজন শ্রমিকের অধিকার। আর এ অধিকার নিশ্চিত করার জন্য ইসলাম কোন শ্রমিককে কাজে নিযুক্ত করার আগেই তার মজুরী বা পারিশ্রমিক নির্ধারণ করার তাকিদ দেয়। আবু সাঈদ আল খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রসুলুল্লাহ (সা.) কোন শ্রমিককে তার পারিশ্রমিক নির্ধারণ না করে নিযুক্ত করতে নিষেধ করেছেন (বায়হাকী)। অর্থাৎ যতক্ষন না তার সাথে তার মজুরী ঠিক করে নেয়া হবে ততক্ষন শ্রমিককে কাজে খাটানো যাবে না।
ইমাম বাইহাকী বর্ণণা করেছেন- আবু হুরাইরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী (স.) থেকে বর্ণনা করেন যে “আর যে ব্যক্তি কাউকে শ্রমিক নিযুক্ত করতে চায় সে যেন তাকে তার পারিশ্রমিক জানিয়ে দেয়”।

নবী করিম (সা.) বলছেন, “মালিক যা খাবে পরবে, তার অধীনস্থরাও তাই খাবে এবং পরবে”।

সময়মত মজুরী প্রদান : এক হাদীসে কুদসীতে এসেছ: আবু হুরাইরাহ (রা.) থেকে বর্নিত, তিনি বলেন যে, রসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘‘কিয়ামতের দিন আমি তিন ব্যক্তির প্রতিপক্ষ হবো। আর আমি যাদের প্রতিপক্ষ হবো তাদেরকে পরাজিত করে ছাড়বো। তারা হলো-এমন ব্যক্তি যে আমার নামে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে, এমন ব্যক্তি যে আযাদ মানুষকে ধরে এনে তাকে বিক্রয় করে এবং এমন ব্যক্তি যে কাউকে মজুর নিয়োগ করে পুরোপুরি কাজ আদায় করে নেয়, কিন্তু তাকে তার পারিশ্রমিক পরিপূর্ণ আদায় করে না’’।

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (র.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন যে, রসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, “শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর আগে তার পারিশ্রমিক পরিশোধ করে দাও”। যদি চূক্তির মধ্যে মালিক সপ্তাহিক/দৈনিক মজুরী প্রদান করে তাহলে বৈধ। কিন্তু তা নিয়ে টাল বাহানা সম্পূর্ন অন্যায়।

নারী ও পুরুষ শ্রমিকের সমতা : শ্রমিকদের মধ্যে যারা নারী তাদের গুরুত্ব কোন মতেই কম নয়। তারা একই পেশায় নিয়োজিত হলে একই রকম সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত হবে। নারী হওয়ার অযুহাতে তাদেরকে কম সুবিধা দেবার কোন সুযোগ নেই। বরং তাকে তার মাতৃত্বজনিত ছুটিসহ কিছু অতিরিক্ত সুবিধা দিতে হবে, যা পুরুষের ক্ষেত্রে দিতে হয়না। মহান আল্লাহ নারী পুরষের কাজের প্রতিদানের ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য করেন না। আল্লাহ বলেন “আর পুরুষ কিংবা নারী যদি মু’মিন অবস্থায় কোনো সৎকাজ করে তবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর তাদের প্রাপ্য তিল পরিমানও নষ্ট হবে না”।

অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, “পুরুষ যা অর্জন করে সেটা তার অংশ এবং নারী যা অর্জন করে সেটা তার অংশ” (সূরা নিসা-৩২)।

সাধ্যাতীত বোঝা না চাপানো এবং কর্মঘন্টা নির্ধারণ
আল্লাহ পাকের নির্দেশ: “কারো সামর্থ্যরে অতিরিক্ত কাজ চাপানো যাবে না” (সূরা বাকারা-২৩৩)। হুযাইফাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (দ.) বলেছেন, তোমাদের পূর্বেকার এক লোকের জান কবজ করার জন্য ফেরেশতা আসলো। তারা (লোকেরা) বলল, তুমি কোন (উল্লেখযোগ্য) নেক আমল করেছো? সে বলল, আমি আমার শ্রমিক ও কর্মচারীদেরকে আদেশ করতাম যেন তারা অভাবীকে অবকাশ দেয় ও ক্ষমা করে। তিনি (বর্ণণাকারী) বলেন, তিনি নবী (স.) বলেছেন, তখন তারাও ( ফেরেস্তা) তাকে ক্ষমা করে দিল।

মালিক একজন শ্রমিকের দ্বারা কি ধরনের কাজ নেবে? এবং কত ঘন্টা কাজ করতে হবে? তা উভয় পক্ষের আলোচনার ভিত্তিতে নির্ধারন করতে হবে। শ্রমিকের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এমন কাজও তার উপর চাপানো অন্যায়। রৌদ্র তাপের মধ্যে আট ঘন্টা মাটি কাটার কাজ, আর এয়ারকন্ডিশনে বসেও আট ঘন্টা কাজ, এটা ইনসাফ হতে পারে না। তাই কাজের প্রকৃতি ও কাজের পরিবেশের উপর ভিত্তি করে কাজের সময় নির্ধারিত হওয়া উচিত।

আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, শক্তি সামর্থের অতিরিক্ত কাজ শ্রমিকের ওপর চাপাবে না। যদি তার সামর্থের অতিরিক্ত কোন কাজ তাকে দাও তাহলে সে কাজে তাকে সাহায্য কর (বুখারী, মুসলিম)।

“কাজের প্রকৃতি ও পরিমাণ না জানিয়ে কাউকে কাজে নিয়োগ করা যাবে না”। (আল হাদিস)।

পোষ্যদের ভরণ পোষণ : প্রত্যেক শ্রমিক তার উপার্জন দ্বারা স্ত্রী-সন্তান ও পিতামাতার ভরণ পোষনের চেষ্টা করে। তাই বেতন এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে যাতে নিজের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের পরে তার পোষ্যদের প্রতিও দায়িত্ব পালন করতে পারে। বিশ্বের অন্যতম ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ.) বলেন, “সাধারণ নিয়োগকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষে পরিবারের লোকসংখ্যা অনুপাতে বেতন নির্ধারণ সহজ নয়। তবে এ দায়িত্ব রাষ্ট্রের গ্রহন করা উচিত। আর বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সমূহকে এ জন্য বাধ্য করা যেতে পারে”।

হযরত আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন, নবী করীম (স.) এরশাদ করেছেন, “যার উপর যার লালন পালন করার দায়িত্ব রয়েছে, তা উপেক্ষা করাই একজন ব্যক্তির গোনাহগার হওয়ার জন্য যথেষ্ঠ” (মিশকাত)।

বর্তমান বিশ্বে মজুরীর ক্ষেত্রে পোষ্যদের বিষয়টি বিবেচনায়ই আনা হয় না। অথচ মানবিক দিক থেকে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ন। তাই ইসলামী শ্রমনীতি বিষয়টিকে অনেক গুরুত্ব দিয়েছে।

অতিরিক্ত কাজের জন্য ওভার টাইম : কোন শ্রমিকের দ্বারা অতিরিক্ত কাজ করানো হলে তাকে অতিরিক্ত মজুরী দেয়া ইসলামী শ্রমনীতির বিধান। যেন সে খুশী হয়ে কাজ সম্পন্ন করে। মহান আল্লাহ বলেন- ‘যে লোক এক বিন্দু পরিমাণ উত্তম কাজ করবে সে তা দেখতে পাবে’ (সূরা যিলযাল-৭)।

নবী করিম (সা.) বলেছেন- ‘‘তাদের উপর সাধ্যের অধিক কাজ চাপাবে না। যদি অতিরিক্ত কাজ চাপানো হয়, তাহলে সাহায্য কর’’ (বুখারী।

লভ্যাংশে শ্রমিকের অধিকার : প্রতিষ্ঠানে লাভ তখনই আসে যখন পুঁজি বিনিয়োগ করে তাতে শ্রম যোগ করা হয়। মালিকের পুঁজি হল অর্থ, আর শ্রমিকের পুঁজি হলো শ্রম। দুটোর মিলিত শক্তি “লাভের” জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। তাই লাভের অংশটা শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে বন্টন হবে। এটাই ইসলামের চূড়ান্ত মত।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘সম্পদ এমনভাবে বন্টন কর, যেন তা শুধু ধনী লোকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে’’ (সূরা হাশর-৭)।

“বিত্তবানদের সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে” (সূরা যারিয়াত-৭)।

নবী করীম (দ.) বলেন, “মজুরকে তার কাজ হতে অংশ দান কর। কারণ আল্লাহর মজুরকে বঞ্চিত করা যেতে পারে না। শ্রমিককে তার উপার্জন থেকে দাও। কারণ শ্রমিককে বঞ্চিত করা যায় না” (মুসনাদে আহমদ)।

পুঁজিবাদী সমাজে মালিকরা শ্রমিকদের বঞ্চিত করে বিলাসবহুল জীবন যাপনের জন্য লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে অপচয় করে থাকে। সমাজতান্ত্রিক দেশে লাভের সবটুকু অংশ রাষ্ট্রের অধীনে চলে যায়। শ্রমিক সমাজকে পশুর মত খাটিয়ে মারে, আর শাসকগোষ্ঠি ও তার পেটোয়া বাহিনী নিজেদের জন্য স্বর্গ তৈরী করে। তাই ইসলাম লভ্যাংশে শ্রমিকের অংশ নিশ্চিত করে ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা ও ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি করতে চায়।

ব্যবস্থাপনায় প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকের অংশ গ্রহন : ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কল-কারখানার ভাল মন্দের সাথে যেমনি মালিকের ভাগ্য জড়িত, তেমনি শ্রমিকেরও ভাগ্য জড়িত। কারণ শ্রমিকের পুঁজি, শ্রম, সেখানে বিনিয়োগ করা এবং শ্রমিকরা বাস্তব ময়দানে কাজ করে। প্রতিষ্ঠানের সমস্যা সম্পর্কে তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকাটাই স্বাভাবিক। ব্যবস্থাপনায় অংশ গ্রহন করতে পারলে শ্রমিকদের সুচিন্তিত মতামত প্রদান করে প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতির পথে ভূমিকা রাখতে পারে। শ্রমিক মালিক ভাই-ভাই এবং সুখ দু:খের সমান অংশীদার ও সংরক্ষক-এটাই এ চেতনার মূলনীতি।

মহান আল্লাহ বলেন- “তুমি লোকদের সাথে প্রত্যেক বিষয়ে পরামর্শ কর” (সূরা আল ইমরান-১৫৯)।

হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী করিম (সা.) বলেছেন, যখন তোমাদের শাসকরা চরিত্রবান হবে, সম্পদশালী লোকেরা দানশীল হবে এবং পারস্পারিক বিষয়ে পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করবে তখন পৃথিবীর নীচের অংশের চাইতে উপরের অংশ তোমাদের জন্য উত্তম হবে (তিরমিযী)। শ্রমিকদের প্রতিনিধির ব্যবস্থাপনায় থাকার অধিকার ইসলাম দিয়েছে।

চাকুরীর নিরাপত্তা : প্রতিটি নাগরিকের চাকুরীর নিরাপত্তার দায়িত্ব ইসলামী রাষ্ট্রের সরকারের। বিনা কারণে মালিক যদি কোন শ্রমিককে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করে তাহলে সে মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করতে সরকার বাধ্য থাকবে। শ্রমিকদের কোন অপরাধ হলে তার বিচার করার দায়িত্ব সরকারের। তা কোন ব্যক্তি বা মালিকের খেয়াল খুশির উপর ছেড়ে দেয়া যাবে না।

মহান আল্লাহ বলেন: “ঈমানদার লোকদের মধ্যে যারা তোমাদের অধীনস্থ তাদের সাথে নম্র ব্যবহার কর” (সূরা শু’আরা-২১৫)। “তোমাদের অধীনস্থরা যদি সত্তরবারও অপরাধ করে তা হলে ক্ষমা করে দাও (আল হাদীস)। এসব নিদের্শনার মাধ্যমে ইসলাম প্রত্যেকের চাকুরীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে।

ট্রেড ইউনিয়ন ও যৌথ দরকষাকষি অধিকার : সংগঠন হচ্ছে এক প্রকার বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম। যোগ্য ও উপযুক্ত সংগঠন ছাড়া উৎপাদন এবং শ্রমিক সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। সংগঠন বিষয়ে চিন্তা করলে দেখা যাবে ইসলাম আগাগোড়া একটি সংগঠন ছাড়া কিছুই নয়। নামাযের মধ্যে ইমামত, রাষ্ট্রের মধ্যে খেলাফত ও হজে¦র মধ্যে ইমারাত (নেতৃত্ব) এসব কিছুতেই ইসলামী সংগঠনের পরিচয় মেলে। হযরত উমর (রা.) বলেছেন- “জামায়াত ব্যতীত ইসলাম হয়না”।

ইসলামী শ্রমনীতি ব্যবস্থায় প্রত্যেক শ্রমিক সংগঠন করার অধিকার পাবে। শ্রমিকদের জন্য শ্রমিকদের দ্বারা আইনানুগভাবে গঠিত ট্রেড ইউনিয়নের একটা মৌলিক দায়িত্ব হলো মালিক পক্ষের সাথে দরকষাকষি ও আলোচনা করে সমস্যার সমাধানে পৌঁছা। দরকষাকষি মানবজীবনের সকল ব্যপারেই একটি স্বভাবজাত প্রক্রিয়া। দরকষাকষির মাধ্যমে প্রতিটি জিনিসের মূল্য নিরুপিত হয়ে থাকে। যেমন হযরত মুসা (আ.) হলেন শ্রমিক এবং হযরত শোয়ায়েব (আ.) হলেন মালিক। তাদের দুজনের মধ্যে দরকষাকষি হয়েছিল। সূরা কাছাছ এর ২৭.২৮ নং আয়াতে সেই চাকুরী,বিনিময় ও চূক্তির ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।

আধুনিক যুগে শ্রমজীবি মানুষের অধিকার আদায়ের একটি শক্ত হাতিয়ার হল দরকষাকষি। যা পবিত্র কুরআনে দৃষ্টান্ত হিসাবে মহান আল্লাহ পেশ করেছেন।
অবসরকালীন ভাতা : শ্রমিকের প্রতি মালিকের দায়িত্ব শুধু চাকুরী চলাকালীনই নয়, বরং চাকুরী থেকে অবসর গ্রহনের পরও শ্রমিকের দায়িত্ব মালিককে সাধ্য অনুসারে অবশ্যই নিতে হবে। মালিক অসহায় বৃদ্ধ, অসুস্থ, বিকলাঙ্গ হওয়া শ্রমিকের প্রতি দায়িত্ব পালনে যদি অবহেলা করে, তা হলে রাষ্ট্রীয় আইনে মালিকের শাস্তির ব্যবস্থা থাকবে। ইসলামী সমাজে সকল শ্রমিক ও নাগরিক অবসরকালীন ভাতা পাবেন এবং সকল অসহায় মানুষ বয়স্ক ভাতা পাবেন।

মহান আল্লাহ বলেন- “আল্লাহ তায়ালা যা কিছু (সম্পদ) জনগণের কাছ থেকে নিয়ে তার রসুলের নিকট ফিরিয়ে দিয়েছেন তা হচ্ছে আল্লাহর জন্য, রসুলের জন্য, আত্মীয় স্বজন, ইয়াতিম, মিসকিন ও অভাবীদের জন্য। যেন তা (সম্পদ) কেবল বিত্তবানদের মধ্যেই আবর্তিত না হয়”। (সূরা হাশর-৭)। তাই ইসলামী সমাজে সকল শ্রমিক ও নাগরিক অবসরকালীন ভাতা পাবে।

চাকুরীর পদোন্নতি : চাকুরীতে পদোন্নতি অবশ্যই প্রয়োজন। শ্রমিকদের কাজে পদোন্নতি যোগ্যতার ভিত্তিতে হওয়াই ইনসাফের দাবী। যোগ্যতার সাথে এ ক্ষেত্রে সিনিয়রিটি ও অভিজ্ঞতা বিবেচনা করা প্রয়োজন। স্বজনপ্রীতি, আঞ্চলিকতা ও পক্ষপাতিত্ব পরিহার করা প্রয়োজন। সার্বিক উপযুক্ততার বিচারে চাকুরীতে পদোন্নতি পাওয়া একটি অধিকার। এ অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা অপরাধ। মহান আল্লাহ বলেন- “ধন সম্পদকে আল্লাহ তোমাদের অস্থিত্ব রক্ষার জন্য নির্ধারিত করেছেন। তোমরা তা নিবোর্ধ লোকদের হাতে ছেঁড়ে দিওনা। অবশ্য তাদের খাওয়া ও পরার ব্যবস্থা কর এবং তাদেরকে উপদেশ দাও” (সূরা নিসা-৫)।

শিক্ষা প্রশিক্ষণ : শিক্ষা প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার। মালিক ব্যর্থ হলে সরকারকে সকলের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সাধারণ শিক্ষা ছাড়াও বিশেষ প্রশিক্ষনের মাধ্যমে শ্রমিকদেরকে কর্মক্ষম করা ও পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রমিকদের সন্তানদের লেখা-পড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ইসলামী সমাজে শিক্ষা বাধ্যতামূলক।

তাই ইসলামের প্রথম বাণী- “পড়, তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন” (সূরা আলাক-১)। “বলে দিন যাদের জ্ঞান আছে এবং যাদের জ্ঞান নেই, তারা কি সমান হতে পারে”? (সূরা যুমার-৯)। “প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জ্ঞানার্জন করা ফরজ” (বুখারী)।

ছুটির ব্যবস্থা : শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের জন্য বিশ্রাম, আপনজনের সাথে একত্রে থাকা, পারিবারিক ও সামাজিক উদ্দীপনা ইত্যাদির জন্য সাপ্তাহিক ও বাৎসরিক ছুটি প্রয়োজন।

মহান আল্লাহ বলেন- “আল্লাহ তোমাদের প্রতি সহজতা ও নম্রতা আরোপ করতে চান। কঠোরতা ও কঠিনতা আরোপ করতে ইচ্ছুক নন’’। নবী করিম (সা.) বলেছেন- তোমরা তোমাদের কর্মচারীদের থেকে যতটা হালকা কাজ নেবে, তোমাদের আমলনামায় ততটা পুরস্কার ও পূণ্য লেখা হবে (তারগীব ও তাহরীব)। সুতরাং ইসলামী শ্রমনীতিতে মাতৃত্বকালীন ছুটিসহ সকল ধরনের ছুটির ব্যবস্থা থাকবে।

ন্যায় বিচার লাভের অধিকার
ইসলামে সকল নাগরিকের ন্যায় বিচার লাভ করা মৌলিক অধিকার। আল কুরআনে ন্যায় বিচারের কঠোর নির্দেশ রয়েছে। “তোমরা যখন লোকদের মধ্যে বিচার ফয়সালা করবে তখন অবশ্যই ন্যায় বিচার করবে” (সূরা নিসা-৫৮)।

“কোন বিশেষ শ্রেনীর লোকদের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদের কোন রকম অবিচার করতে উদ্ধুদ্ধ না করে” (সূরা মায়েদা-৮)।

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা সকলে ন্যায়নীতি নিয়ে শক্তভাবে দাড়াও। আল্লাহর জন্য স্বাক্ষী হও তোমাদের সুবিচার যদি তোমাদের নিজেদের পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধেও হয়। আর পক্ষ দ্বয় ধনী কিংবা গরীব যাই হোক না কেন, তাদের সকলের অপেক্ষা আল্লাহ উত্তম। তোমরা প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে গিয়ে ন্যয় বিচার হতে বিরত থেকোনা” (সূরা নিসা-১৩৫)।

হযরত উবাদা ইবনে সামেত (রা.) বলেন- রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- “তোমরা নিকটবর্তী এবং দূরবর্তী সকলের উপরে আল্লাহর দন্ডবিধি কার্যকরী কর। আল্লাহর ব্যাপারে যেন কোন অত্যাচারী তোমাদেরকে বাধা দিয়ে রাখতে না পারে (ইবনে মাজা)।

আজকের বিশে^ বিচার ব্যবস্থা ক্ষমতাসীন সরকার পুঁজিবাদী ও প্রভাবশালী লোকদের হাতে বন্দী। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে প্রভাব খাটিয়ে বিচারের রায় উল্টে দেয়া হচ্ছে। অর্থের বিনিময়ে রায় কেনা বেচা হচ্ছে। তাই গরীব ও শ্রমিক সমাজের জন্য ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় ইসলামী শ্রমনীতির বাস্তবায়ন অনিবার্য।

উপসংহার : উপরের আলোচনা থেকে প্রতিয়মান হয় যে, ইসলামের শ্রমনীতি প্রকৃতপক্ষে পেশা ও কর্মসংশ্লিষ্ট পক্ষ সমূহ; মালিক ও শ্রমিকের জন্য সত্যি মহা কল্যাণকর। ইসলামী নীতিতে শ্রমের বিশাল মর্যাদা রয়েছে। কাজহীন মানুষকে সমাজের জন্য মানহানিকর হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বৈধ-অবৈধ কাজের সীমারেখা টেনে দেওয়া হয়েছে। কারণ বৈধ ও পবিত্র বস্তু মানুষের জন্য কল্যাণকর। অবৈধ বস্তু মানুষের জন্য সাধারণত অকল্যাণ ও ক্ষতিকর। একইভাবে ইসলাম শ্রমিকের মর্যাদা, দায়িত্ব-কর্তব্য এবং তার অধিকারের উপর পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা দিয়ে শ্রমজীবি মানুষের সার্বিক কল্যাণের নিশ্চয়তা দিয়েছে। আবার মালিকের দায়িত্ব কর্তব্য এবং তার অধিকারের ব্যাপারেও ইসলাম সুরক্ষা দিয়েছে।

তাই ইসলামের শ্রমনীতি এক অনুপম, সার্বজনীন ও চিরশ^াশ^ত নীতিমালা। আধুনিক বিশে^র অস্থির ও বৈষম্যপূর্ণ শ্রম ব্যবস্থায় শ্রমিক মালিকের মধ্যে শুধু হিংসা-বিদ্বেষ ও বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই বঞ্চিতদেরকে তাদের অধিকার রক্ষায় অনেক ঝুঁকি মোকাবেলা করতে হচ্ছে। মানবতা সেখানে পদধ্বলিত হচ্ছে। যা পৃথিবীর সার্বিক পরিবেশকে অস্বস্থিকর করে তুলছে। মানুষ শান্তির বদলে অশান্তির দাবানলে জ¦লছে। এমতাবস্থায় ইসলামী শ্রমনীতি অনুসরণের ফলে মালিক ও শ্রমিক পক্ষ উভয়ই তাদের নিজেদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষা করতে পারে। তাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় মানবিক সুসম্পর্ক, সম্প্রীতি যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে শ্রমিক-মালিক, কল-কারখানা, শিল্প ও কর্মস্থলে। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি হয়। মান, পরিসংখ্যান, পরিকল্পনা সবকিছুতেই উন্নতির পরশ লাগে। শ্রমিক-মালিক, উর্ধতন, অধ:স্তন, ইত্যাদি, ভেদাভেদ, হিংসা-বিদ্বেষ, জিঘাংসা, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য মনোভাবসহ সকল ক্ষতিকর উপসর্গের অবসান হয়। মহান মে দিবসের মূলত এটাই ছিল শ্রমিকদের আত্মদানের মূল চেতনা। কিন্তু সে চেতনা বাস্তবায়ন হয়নি, বরং আজ এটা বাস্তবে প্রমাণিত যে, মানবরচিত মতবাদ নয়-ইসলামেই কেবল এমন ভারসাম্যপূর্ণ নীতিমালা এবং চিরকল্যাণকর মহাব্যবস্থা রয়েছে। এজন্য প্রয়োজন ইসলামী শ্রমনীতি প্রতিষ্ঠার নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রাম।

এ জন্য প্রচলিত ধারার বাইরে প্রয়োজন এক নতুন ধারার শ্রমিক আন্দোলন। বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন এ দেশে ইসলামী আদর্শের পতাকাবাহী এবং সরকারের নিবন্ধিত একক শ্রমিক সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন। দেশ ও জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে শ্রমজীবি মানুষের মুক্তির লক্ষে তাই ইসলামী শ্রমনীতির সংগ্রামকে জোরদার করে মে দিবসের চেতনা বাস্তবায়ন সম্ভব। আল্লাহ আমাদেরকে তৌফিক দান করুন! আমীন!

কেএল/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ