সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ১৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ইউকে লন্ডন মহানগরের সীরাত সম্মেলন অনুষ্ঠিত ‘শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ ছিল দেশে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ’ ২৪ ঘণ্টার নিবিড় পর্যবেক্ষণে ইসলামী আলোচক আব্দুল হাই মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ প্রকাশিত হচ্ছে আল্লামা মাহমুদুল হাসানের ‘হাসানুল ফতোয়া’ তাড়াইলে মাদক-জুয়া ও অনৈতিক কার্যকলাপের প্রতিবাদে আলেমদের সমাবেশ নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে, দ্রুতই রোডম্যাপ : ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পূর্ণাঙ্গ ভাষণ যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় মজলিসে দাওয়াতুল হকের ইজতেমা শনিবার বাংলাদেশ সফরে এলেন দেওবন্দের উস্তাদ মুফতি ফখরুল ইসলাম এলাহাবাদী আগামীকাল শরীফগঞ্জে আসছেন সাইয়েদ আরশাদ মাদানী

ইসলামোফোবিয়া: একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মোঃ খালেদ সাইফুল্লাহ ।।

কোনো জিনিস ও কর্মে ভয় পাওয়াকে ‘ফোবিয়া' বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ কোন ব্যক্তি, যার পানিভীতি রয়েছে- তার জন্য হাইড্রোফোবিয়া পরিভাষা ব্যবহৃত হয়। তেমনি একটি পরিভাষা হলো ইসলামোফোবিয়া। ‘ফোবিয়া' (phobia) ভয়, ডর এবং ঘৃণা পোষণকে বলে। এটা অযৌক্তিক এবং বিবেকের অসুস্থ চিন্তার নাম।

যেটা ভীতি, অনাকাঙ্ক্ষা এবং ঘৃণায় ভরপুর। যখন ‘ফোবিয়া' শব্দকে ইসলামের সাথে জুড়ে দেয়া হয়; তখন তার অন্তঃস্থিত অর্থ দাঁড়ায়- ‘ইসলামভীতি বা ইসলামবিদ্বেষ বা মুসলিম-বিরোধী মনোভাব, ইংরেজি: Islamophobia বা anti-Muslim sentiment হলো নিন্দার্থে বা ব্যাঙ্গার্থে ব্যবহৃত একটি রাজনৈতিক শব্দ যার অর্থ- ইসলামকে ভয় করা।

এর দ্বারা মূলত ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করাকেই বোঝানো হয়। ইসলামের বাস্তবিক দৃশ্যকে পাল্টে দিয়ে মুসলমানদের বদনাম করা। তাদের হেয় প্রতিপন্ন করে মূর্খ বা দুর্ধর্ষরূপে উপস্থাপন করে ভীতির সঞ্চার করা এবং মানসিক ও মনোজাগতিক দিক থেকে তাদের পেরেশান করা। কঠোরতার নিশানা বানানো। মসজিদ ও ইসলামি ঐতিহ্যগুলোর ওপর হামলা করা। মুসলিমদের পোশাকের ওপর ট্যাগ লাগানো ইত্যাদি।

ইসলামিক সহযোগী সংগঠন (OIC) ইসলামোফোবিয়াকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে যে, ইসলামের বিপরীতে অযৌক্তিক, আঘাতস্বর্বস্ব এবং কঠিন অপ্রীতিকর প্রকাশের নাম- ‘ইসলামোফোবিয়া'। তেমনিভাবে ইসলামোফোবিয়া বাহানায় মুসলমানদের আত্মিক, সামাজিক এবং সভ্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে হয়রানি করা।

ইসলাম মান্যকারীদের দেশ ও জাতির ঐচ্ছিক-সামাজিক-রাজনৈতিক এবং দৈনন্দিন জীবনে প্রত্যেককে কর্তৃত্বহীন করাও অন্তর্ভুক্ত। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মুসলিম সংখ্যালঘুদের সাথে কার্যত এমন আচরণই করা হচ্ছে, এমনকি সংখ্যা গরিষ্ঠ দেশেও এমন নজির কম নয়।

বিশ্বে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। একই সমস্যা যখন প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে পর্যন্ত, হোক মাত্রায় কম বা বেশি, তখন সমস্যাটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে সমন্বিত ভাবে মোকাবিলা করা দরকার। আমরা ভূলে যাইনি ২০১৯ সালের ১৫ মার্চ বন্দুকধারী কর্তৃক নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুই মসজিদে নৃশংস হামলার ঘটনায় ৫১ জন নিহত ও ৪০ জন আহত হওয়ার ঘটনা।

যার মূলে ছিল ইসলাম বিদ্বেষি মনোভাব। হামলাকারী ইসলামফোবিক এবং শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী বিশ্বাস দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল, এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় আক্রমণটি লাইভ-স্ট্রিম করেছিল।

এ ঘটনার পূর্বাপর বিশ্বজুড়ে ইসলামোফোবিয়ার অনেক উদাহরণ রয়েছে। জানুয়ারি ২০১৭ সালে কানাডায় কুইবেক সিটি মসজিদে গুলিবর্ষণে ছয়জন নিহত এবং ১৯ জন আহত হয়। এখানেও হামলাকারী তার উগ্র ডানপন্থী এবং মুসলিম বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য পরিচিত ছিল। শুধু হামলা নয়, কখনও কখনও আইনগত ভাবে বিদ্বেষ বা বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে মুসলিমরা। ২০১০ সালে ফ্রান্স সর্বজনীন স্থানে বোরকা এবং নেকাব সহ পুরো মুখের পর্দা নিষিদ্ধ করার জন্য ইউরোপের প্রথম দেশ হয়ে ওঠে।

আইনটি বিতর্কিত ছিল, এটি অন্যায়ভাবে মুসলিম মহিলাদের লক্ষ্যবস্তুু করেছে এবং তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘন করেছে। একই ভাবে ২০১৭ সালে, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশ জারি করেছিলেন যা সাময়িকভাবে কয়েকটি মুসলিম প্রধান দেশ থেকে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করেছিল। এই নিষেধাজ্ঞাটি বৈষম্যমূলক এবং ইসলামফোবিক হিসাবে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিল এবং এটি বেশ কয়েকবার সংশোধিত হওয়ার আগে আইনি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল।

এগুলি বিশ্বব্যাপী ইসলামোফোবিয়ার কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। এটি স্বীকার করা গুরুত্বপূর্ণ যে ইসলামোফোবিয়া ঘৃণামূলক বক্তব্য এবং বৈষম্য থেকে শুরু করে সহিংস আক্রমণ এবং সরকারী নীতি যা মুসলমানদের লক্ষ্য করে বিভিন্ন রূপ নেয়। তাই ইসলামোফোবিয়া একটি অপরাধ, আগামী বিশ্বের জন্য বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ, এজন্য ২০২২ সালে জাতিসঙ্ঘ (ইউএন) ১৫ মার্চকে ইসলামফোবিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আন্তর্জাতিক দিবস হিসাবে মনোনীত করেছে।

জাতিসংঘ সব সদস্য রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক-আঞ্চলিক সংস্থা ও সংগঠনকে ইসলামভীতির ঘটনা মোকাবেলায় সব স্তরে সচেতনা বৃদ্ধিতে সহায়তার আহ্বান জানানো জানিয়েছে। ২০১১ সালে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ধর্মের মানহানির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। রেজোলিউশনটি মানবাধিকারের উপর ধর্মীয় মানহানির নেতিবাচক প্রভাবকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং সদস্য দেশগুলিকে ধর্মীয় সহনশীলতা ও বোঝাপড়ার প্রচার করার আহ্বান জানিয়েছে।

ইউনাইটেড নেশনস অ্যালায়েন্স অফ সিভিলাইজেশনস (UNAOC) হল জাতিসংঘের একটি উদ্যোগ যার লক্ষ্য আন্তঃসাংস্কৃতিক এবং আন্তঃধর্মীয় সংলাপ এবং বোঝাপড়াকে উন্নীত করা। ইসলামোফোবিয়া প্রতিরোধে এ উদ্যোগ ভূমিকা রাখতে পারে। জাতিসংঘ ইসলামোফোবিয়া মোকাবেলা করতে এবং ধর্মীয় সহনশীলতা ও বোঝাপড়ার প্রচারের জন্য এমন বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি যার বাস্তবায়নে ১৫ মার্চের ইসলামফোবিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আন্তর্জাতিক দিবসটি উদযাপন ও সচেতনতার বার্তা সর্বত্র পৌঁছে দেওয়া জরুরি।

বর্তমানে ইসলামফোবিয়া একটি ‘বাস্তবতা’ হয়ে উঠেছে এবং বিশ্বের নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে। মুসলিমদের প্রতি ব্যক্তি ও সম্প্রদায় পর্যায়ে এ ধরনের বৈষম্য, শত্রুতা ও সহিংসতা সংবিধানপ্রদত্ত মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন এবং তাদের ধর্ম ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা লঙ্ঘনের শামিল। বর্তমানে তা বেড়েই চলছে যা উদ্বেগজনক।

বেশ কিছু গবেষণা ও সমীক্ষায় বিশ্বের বিভিন্ন অংশে ইসলামোফোবিয়ার পরিমাণ পরিমাপ করার চেষ্টা করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালে পরিচালিত একটি পিউ রিসার্চ সেন্টার সমীক্ষায় দেখা গেছে যে পশ্চিম ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানদের প্রতি প্রতিকূল দৃষ্টিভঙ্গি সবচেয়ে সাধারণ ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, উত্তরদাতাদের ৫৬% মুসলমানদের প্রতি প্রতিকূল মতামত প্রকাশ করেছে, যেখানে পশ্চিম ইউরোপে এই সংখ্যা ছিল ৩০%।

২০১৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এজেন্সি ফর ফান্ডামেন্টাল রাইটস (FRA) এর আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ৪২% মুসলিম উত্তরদাতা ইউরোপে গত পাঁচ বছরে বৈষম্য বা হয়রানির শিকার হয়েছেন। প্রতিবেদনে আরও হাইলাইট করা হয়েছে যে সবচেয়ে সাধারণ ক্ষেত্র যেখানে বৈষম্য ঘটেছে তা ছিল সর্বজনীন স্থানে, যেমন রাস্তা, দোকান এবং গণপরিবহন।

অনেকেরই ইসলাম এবং মুসলিম সংস্কৃতি সম্পর্কে সীমিত জ্ঞান বা বোঝাপড়া রয়েছে, যা স্টেরিওটাইপ এবং ভুল ধারণার জন্ম দিতে পারে। রাজনীতিবিদ এবং মিডিয়া আউটলেটগুলি জ্বালাময়ী ভাষা ব্যবহার করে বা মুসলমানদেরকে হুমকি হিসাবে চিত্রিত করে ইসলামফোবিয়ায় অবদান রাখতে পারে।

আইএসআইএস-এর মতো চরমপন্থী গোষ্ঠীর দ্বারা পরিচালিত হাই-প্রোফাইল হামলার কারণে কিছু লোক ইসলামকে সন্ত্রাসবাদের সাথে যুক্ত করে। এটি একটি সাধারণীকরণের দিকে নিয়ে যেতে পারে যে সমস্ত মুসলিমরা সম্ভাব্য সন্ত্রাসী, যদিও মুসলমানদের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ সন্ত্রাসবাদ এবং সহিংসতার নিন্দা করে। ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব এবং সাংস্কৃতিক পার্থক্য কিছু অঞ্চলে ইসলামোফোবিয়ায় অবদান রাখতে পারে।

এটা স্বীকার করা গুরুত্বপূর্ণ যে ইসলামোফোবিয়া মুসলিম গোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য, যা অগ্রহণযোগ্য, ক্ষতিকারক, অন্যায্য এবং সামগ্রিকভাবে ব্যক্তি এবং সমাজের জন্য মারাত্মক পরিণতি হতে পারে। তাই, ইসলামোফোবিয়াকে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে মোকাবেলার প্রচেষ্টায় সচেতনতা, ভুক্তভোগীদের আইনি সহযোগিতা, তাৎক্ষণিকভাবে পদক্ষেপ নেওয়া, স্থায়ী সমাধানের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন, নেতিবাচক স্টিরিওটাইপ এবং কুসংস্কারকে চ্যালেঞ্জ করা সহ সম্মিলিত প্রচেষ্টা আজকের ১৫ মার্চ ইসলামোফোবিয়া প্রতিরোধ দিবসের আহবান।

লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ