|| কাউসার লাবীব ||
বিভিন্ন বোর্ড ও বেশকিছু মাদরাসার সমাপনী পরীক্ষা শেষ হওয়ার কারণে কওমি মাদরাসার ছাত্ররা প্রায় দুই মাসের একটা ছুটি পাচ্ছে। দীর্ঘ এই ছুটির কারণে অনেক সচেতন অভিবাবকই তাদের সন্তানদের নিয়ে চিন্তিত। ছুটিতে সামান্য কয়েকজন বিভিন্ন কোর্সে অংশ নিলেও অনেকেই অবসর সময় পার করে। লেখাপড়া থেকে দূরে থাকার কারণে কিতাবের সঙ্গে তাদের একটা দূরত্ব তৈরি হয়।
দীর্ঘ এই ছুটি নিয়ে কী ভাবছে বোর্ডের দায়িত্বগণ? এ নিয়ে কথা বলেছিলাম জাতীয় দ্বীনি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড বাংলাদেশ’র মহাসচিব মুফতি মুহাম্মদ আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, কিছু পরীক্ষা শেষ হলেও হাইয়াতুল উলিয়ার পরীক্ষা কিন্তু এখনো চলমান। শেষ হতে হতে রমজান অনেকটাই কাছে চলে আসবে। তাছাড়া রমজান এবাদতের মাস। এবাদত ও তিলাওয়াতের জন্য রমজানে বিরতি দরকার হয়। হাফেজরা তারাবি পড়ায়। গাইরে হাফেজরা তিলাওয়াত ও ইবাদত করে। রমজানের পরে নতুন ক্লাসে ভর্তি। ভর্তির জন্য প্রস্তুতিরও বিষয় থাকে। ছুটির এই গ্যাপে কিন্তু সবাই কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত থাকে থাকে। ফারেগরা নুরানী ট্রেনিংসহ বিভিন্ন ট্রেনিং দেয়। যারা ফারেগ না তারা বিভিন্ন কোর্সে অংশ নেয়। এসব কোর্স পরবর্তী বছরের জন্য সম্পূরক হয়। যার ফলে ভালভাবে নতুন বছর শুরু করতে পারে।
একই কথা বলছেন আযাদ দ্বীনী এদারায়ে তা'লীম বাংলাদেশের নাজিমে উমুমি মাওলানা আব্দুল বছীর। তার মতে ছুটিটা একটু লম্বা হলেও শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় মাদরাসাতেই এখন বিভিন্ন প্রশিক্ষণ চলে। সেসবে তারা অংশ নিয়ে নিজেদের মেধাকে সমৃদ্ধ করে। আর আমাদের বোর্ড পরীক্ষা শেষ হলেও কিন্তু বার্ষিক পরীক্ষা বাকি আছে। সেটি শেষ হতে প্রায় রমজান চলে আসবে। রমজানে তো হাফেজদের তারাবি থাকে। তখন তো ক্লাস চালানো সম্ভব নয়। আমাদের সংবিধানেও রমজানে ৪৫দিন বন্ধের কথা উল্লেখ আছে।
তার দাবি, আমাদের বোর্ড পরীক্ষা আগে শবে বরাতের পরেই হতো। এরফলে রেজাল্ট দিতে অনেক দেরি হয়ে যেত। কেননা আমরা রেজাল্ট দিই ২৬ রমজানের ভেতর। এতো অল্প সময়ে পরীক্ষা শেষ করা, খাতা বন্টন করে সেগুলোকে আবার জমা করা, এরপর রেজাল্ট তৈরি করা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। আবার যদি রমজানের ভেতরে রেজাল্ট দেয়া না যায় তাহলে নতুন বছরে ভর্তির ক্ষেত্রে ছাত্রদের পেরেশানিতে পড়তে হয়।
‘আমরা পরীক্ষা এগিয়ে আনার পাশাপাশি রমজানের পরের ছুটি কিন্তু কমিয়ে এনেছি। আগে মাদরাসা খোলা দিতাম ১৫ শাওয়াল। এখন মাদরাসা খোলা হয় ৭ শাওয়াল।’ যোগ করেন মাওলানা আব্দুল বছীর
এদিকে ভিন্নকথা বলছেন শিক্ষাবিদ আলেম মাওলানা যাইনুল আবিদীন। দীর্ঘ এই ছুটিকে আরো কমিয়ে আনা যেত কী না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, লম্বা এই ছুটিকে কোনোভাবে কমিয়ে আনা যেত কী না সে বিষয়ে বোর্ডগুলো ভেবে কী না সেটা তো তারাই বলতে পারবে। তবে একজন শিক্ষক হিসেবে আমরা যেটা অনুভব করি, ‘আগের তোলনায় ছুটি বাড়ার কারণে শিক্ষাবর্ষের মেয়াদ কমছে। দরসের সময় কমছে। যেহেতু সময় কমছে, সেহেতু শিক্ষাদানের মান কমবে এটাই তো হওয়ার কথা।’
‘আর একজন অভিবাবক হিসেবে যদি বলি, আমাদের দেশের কয়টা পরিবারে বন্ধের মধ্যে ছাত্রদের পড়াশোনার পরিবেশ থাকে? এই পার্সেন্ট কিন্তু উল্লেখ করার মতো কোনো সংখ্যা না। গত ১ তারিখে বেফাক শেষ হলো। নতুন শিক্ষাবর্ষের জন্য মাদরাসা খুলবে শাওয়ালের সাত তারিখের পর। এরপর চলবে ভর্তি। ভর্তির পর নতুন শিক্ষাবর্ষ। সবক উদ্ধোধন। এরপর কিতাব নিয়ে বসবে শিক্ষার্থীরা। কিতাবের সঙ্গে তাদের দীর্ঘ এই বিরতি নিশ্চিয়ই ভালো কিছু বয়ে আনবে না। এমন পরিবেশ তো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা তো এমন লম্বা ছুটি পাইনি। আমাদের শিক্ষাবর্ষ তো এমন ছিল না।’ যোগ করেন মাওলানা যাইনুল আবিদীন
তার মতে, ‘দীর্ঘ এই ছুটি শিক্ষার্থীরা কীভাবে কাজে লাগাতে পারে?’ জানতে চাইলে তিনি বলেন, শরীরে যদি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা না থাকে, ঔষধ কিন্তু তেমন কোনো উপকার করতে পারে না। বানিজ্যিক জায়গা থেকে বেরিয়েও যদি বলি, শিক্ষাবর্ষ কমিয়ে এসব কোর্সের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কতটুকু সৃজনশীল করা যাবে! সে প্রশ্নও কিন্তু থেকে যায়।
তিনি উল্লেখ করেন, রমজানের কোর্সগুলোর জন্য কিন্তু নির্দিষ্ট একটা ফি থাকে। কোর্সে যদি দুই হাজার টাকা লাগে ছাত্ররা পরিবারে চাপ সৃষ্টি করে ৫ হাজারের। ‘রমজান, ঈদ’ সামাজিকভাবেই প্রতিটি পরিবারকে আর্থিকভাবে একটা চাপে রাখে। ঈদের পর ছাত্রদের নতুন শিক্ষাবর্ষে ভর্তি, কিতাবপত্র কেনা ইত্যাদির জন্য কিন্তু অভিবাবকরা একটা বাড়তি চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সবমিলিয়ে অভিজ্ঞতাটা সুখের নয়।
সর্বশেষ তিনি বলেন, বোর্ডগুলো আরো চিন্তাভাবনা করে যদি এসব ছুটিকে কমিয়ে এনে শিক্ষাবর্ষকে দীর্ঘ করে তাহলে শিক্ষামান আরো বাড়বে এবং শিক্ষার্থীদের সময়ও নষ্ট হবে না।
কেএল/