মুহাম্মদ ছফিউল্লাহ হাশেমী।।
সম্প্রতি আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন, ঢাকার চেয়ারম্যান প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলার শায়খ আহমাদুল্লাহর ফেসবুক ভেরিফাইড পেজে দেয়া একটি পোস্ট এবং একই বিষয়ের ভিডিওবার্তা নেটিজেনদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে। জুয়ার আসর থেকে সর্বস্বান্ত হয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়া এক তরুণ বড় বেদনার সাথে লেখা একটি মেইল শায়খ আহমাদুল্লাহকে পাঠিয়ে জাতিকে সতর্ক করতে চেয়েছেন।
মেইলে ওই যুবক আত্মহননের প্রচেষ্টার কথাও জানিয়েছেন। যুবকের পাঠানো ই-মেইলটি সতর্কবার্তা হিসেবে ফেসবুকে শেয়ার করেছেন শায়খ আহমাদুল্লাহ। মূলত এটি বর্তমান সমাজের একটি ক্ষুদ্র চিত্র মাত্র। তরুণদের মধ্যে জুয়ার আসক্তির ভয়াবহতা আরো ব্যাপক।
একসময় ক্রিকেট-ফুটবলসহ বিভিন্ন গ্রামীণ খেলাধুলা এবং ক্যাসিনোর মাধ্যমে জুয়া খেলার প্রচলন থাকলেও স্মার্টফোনের সহজলভ্যতার যুগে মোবাইলের মাধ্যমে জুয়া খেলার হিড়িক পড়েছে তরুণদের মাঝে, যা দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। অ্যান্ড্রয়েড ফোনে বিভিন্ন জুয়ার অ্যাপসগুলো অধিক লাভবান হওয়ার লোভ দেখিয়ে অ্যাপস ডাউনলোড করে খেলার আহ্বান জানানো হয়।
বিভিন্ন নামে থাকা অ্যাপসগুলোর বিজ্ঞাপনে বাংলাদেশি ব্যাংক এবং বিকাশের মাধ্যমে পেমেন্টের সুযোগ দেখিয়ে টোপ দেওয়ার ফলে তরুণরা মোবাইল জুয়ায় আকৃষ্ট হচ্ছে দিন দিন। ইতোমধ্যে কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, চাঁদপুরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোবাইল অ্যাপস জুয়াড়ির অনেককেই গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনেছে।
ইসলামের দৃষ্টিতে জুয়া খেলা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং জুয়ার মাধ্যমে উপার্জিত সম্পদ হারাম। ঢাকা মহানগর পুলিশ ও চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশ এবং পাবলিক গ্যাম্বলিং আইন অনুসারেও টাকার বিনিময়ে জুয়া খেলা অবৈধ।
জুয়াকে আরবিতে ‘মায়সির’ ও ‘কিমার’ বলা হয়। মায়সির ও কিমার এমন খেলাকে বলা হয়, যা লাভ ও ক্ষতির মধ্যে আবর্তিত থাকে। অর্থাৎ যার মধ্যে লাভ বা ক্ষতি কোনোটাই স্পষ্ট নয়। জুয়ার ইতিহাস বেশ প্রাচীন। মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনের সময় তৎকালীন মক্কায় নানা ধরনের জুয়ার প্রচলন ছিল। বর্তমানে প্রাচীন পদ্ধতি ছাড়াও জুয়ার ক্ষেত্রে আরও বহু নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে; এগুলোর সবই হারাম।
একাধিক কুরআনের আয়াত ও হাদিসে এ সম্পর্কে স্পষ্ট বিবরণ রয়েছে। পবিত্র কুরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তি পূজার বেদি ও ভাগ্য নির্ণয়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ।
সুতরাং তোমরা তা বর্জন করো, তাহলেই তোমরা সফলকাম হতে পারবে। শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণে ও নামাজ আদায়ে বাধা দিতে চায়। তবে কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না।’ (সূরা আল-মায়িদাহ, আয়াত নং- ৯০-৯১)।
হাদিসে রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা মদ, জুয়া ও বাদ্যযন্ত্র হারাম করেছেন।' (বায়হাকি)।
অন্য হাদিসে রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, জুয়ায় অংশগ্রহণকারী, খোঁটাদাতা ও মদ্যপায়ী জান্নাতে যাবে না।’ (দারেমি)।
হাদিসে মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধু জুয়াকেই হারাম করেননি, বরং জুয়ার ইচ্ছা প্রকাশকেও গোনাহ সাব্যস্ত করেছেন। যে ব্যক্তি অপরকে জুয়া খেলার জন্য ডাকবে তাকেও গোনাহের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে কিছু সদকা করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাহলে জুয়া খেললে কী পরিণতি হতে পারে সে সম্পর্কে চিন্তা করা উচিত।
এ সম্পর্কে রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের কেউ লাত-উজ্জার শপথ ইত্যাদি বললে, তবে সে যেন সঙ্গে সঙ্গে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে। আর কেউ যদি অন্যকে প্রস্তাব দেয়, এসো আমরা জুয়া খেলি; সে যেন (জরিমানাস্বরূপ) দান-সদকা করে। (সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম, জামে তিরমিজি ও সুনানে ইবনে মাজাহ)।
তরুণদের জুয়ার আসক্তি বন্ধ করতে অভিভাবকদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব পালন করতে হবে। সন্তান কার সঙ্গে মিশছে, মোবাইলে সারাক্ষণ কী করছে তা পর্যবেক্ষণে রাখার মাধ্যমে সন্তান যেন স্মার্টফোনের অপব্যবহার করতে না পারে, তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
পাশাপাশি জুয়া খেলায় আসক্ত তরুণদেরওও বুঝতে হবে এটি ইসলামি শরিয়তে ও দেশীয় আইনে নিষিদ্ধ কাজ। জুয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখতে হবে। প্রয়োজনে যাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখলে কিংবা মেলামেশা করলে জুয়ায় আসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সেই সব অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে।
সামাজিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে জুয়ার কুফল ও ভয়াবহতা সম্পর্কে এলাকায় সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। মোবাইলের মাধ্যমে কিংবা যেকোনো জুয়ার আসর ভেঙে দিয়ে মূল হোতাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
জুয়া যেহেতু দেশীয় আইনে নিষিদ্ধ, সেহেতু অ্যান্ড্রয়েড প্লে-স্টোরে থাকা সর্বপ্রকার জুয়ার অ্যাপস এবং বাংলাদেশে দৃশ্যমান সর্বপ্রকার জুয়ার ওয়েবসাইটের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করতে সংশ্লিষ্ট আইটি সংস্থা কর্তৃক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
দেশব্যাপী বিভিন্ন অনলাইন ও অফলাইন মাধ্যমে জুয়ার যে ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়েছে তা রোধ করতে সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সচেতনতা তৈরি করতে পারলে সর্বপ্রকার জুয়ার ভয়াবহতা থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব হবে।
লেখক: আলেম, প্রাবন্ধিক ও কলেজ শিক্ষক
-এটি