প্রায় দুই যুগ ধরে হজ সেবায় অনন্য অবদান রাখছেন রাজশাহী হজ ও উমরা গ্রুপের চেয়ারম্যান মুফতি মুস্তাফিজুর রহমান। বায়তুল্লাহর মেহমানদের মানসম্মত সেবা দিয়ে বহুবার তিনি প্রশংসায় ভেসেছেন। আমরা অভিজ্ঞ এই মুআল্লিম ও এজেন্সি মালিকের মুখোমুখি হয়েছিলাম। হজ সেবাকে আরো উন্নত করণ, হাজীদের ভোগান্তি কমিয়ে আনার উপায় ও সাম্প্রতিক সময়ে হজের খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণসহ নানা বিষয়ে কথা হয়ে তার সঙ্গে। তাছাড়া কথোপকথনে উঠে এসেছে পর্যটনে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের ট্যুরিজমের কথা। সাক্ষাতকারটি আওয়ার ইসলাম পাঠকের জন্য তুলে ধরা হচ্ছে। সাক্ষাৎকার গ্রহণে ছিলেন আওয়ার ইসলাম বার্তাসম্পাদক কাউসার লাবীব
করোনা পরবর্তী হজের খরচ বাড়ার কারণ কী? বাংলাদেশ সরকার চাইলে কি নিজ উদ্যোগে হজের খরচ কমাতে পারবে?
আগেই বলেছি, হজের প্রায় ৯৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয় সৌদিতে। তারা যদি খরচ না কমায় তাহলে বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টায় তেমন কোনো খরচ কমানো সম্ভব নয়। করোনার পর অস্বাভাবিক বেড়েছে হজের খরচ। এর কারণে হাজী সাহেবগণ যেমন অবাক হয়েছেন, আমরাও বিস্মিত হয়েছি। এর কিন্তু বড় কারণ সৌদি আরবে খরচ বাড়া। শুনে অবাক হবেন, ডি-ক্যাটাগরির মিনা আরাফার তাবুর চার্জ করোনার আগে ছিল ৭৫০ রিয়াল। সেটা এখন বেড়ে হয়েছে ৫৬৫৭ রিয়াল। প্রায় ৫ হাজার রিয়াল শুধু তাবু চার্জ বেড়েছে। এছাড়া ফুড খরচ, হোটেল খরচও বেড়েছে। এখানে তো বাংলাদেশ সরকারের করার কিছু নেই।
অনেকেই বলছে থার্ড ক্যারিয়ারের ব্যবস্থা থাকলে হজের খরচ অনেক কমতো!
থার্ড ক্যারিয়ার কিন্তু বাংলাদেশ থেকে নিষেধ করা হয়নি। সৌদি আরবের পক্ষ থেকে নিষেধ করা হয়েছে। এর বড় কারণ হলো হাজীদেরকে ভোগান্তি থেকে বাঁচানো। কেননা বাংলাদেশ থেকে ফর্মালিটি শেষ করে সৌদি নেমে খুব সহজে এখন হোটেলে চলে যাওয়া যায়। কিন্তু থার্ড ক্যারিয়ার হলে সেটা সম্ভব হয়ে উঠবে না। তাছাড়া থার্ড ক্যারিয়ারগুলো ট্রানজিট সার্ভিস দিবে; যার কারণে হাজীদেরকে অনেক কষ্ট পোহাতে হবে। তাছাড়া থার্ড ক্যারিয়ার সরাসরি ফ্লাইট দিলেও খরচ কিন্তু আহামরি কমবে না। সর্বোচ্চ দুই আড়াইশো ডলার কমবে।
করোনার পরে তো হজের খরচ বেড়েছে। সেবার মান কি বেড়েছে?
হ্যাঁ। কিছুটা বেড়েছে। আগে মিনায় তাবুতে গাদাগাদি করে থাকতে হতো। গত বছর সেটা আমরা দেখিনি। তাছাড়া হাজীদের জন্য প্রচুর নতুন টয়লেট বানানো হয়েছে। তাবুগুলোর মান বাড়ানো হয়েছে। তাবুর বাইরে যথেষ্ট পরিমাণ মিনারেল ওয়াটার ও পাণীয় ফ্রিজে রাখা ছিল; যেটি আমরা আগে দেখিনি।
বাংলাদেশ থেকে নদীপথে হজের খবর আসছে। এটি বাস্তবায়ন হলে হজের কতটা খরচ কমে আসবে?
জাহাজে হজ চালু হলে শুধু বিমান খরচ কমবে। তাছাড়া বাকি খরচ কিন্তু আগের মতোই থাকবে। আমি আগেও বলেছি মূল খরচ বেড়েছে সৌদি আরবের ভেতরের সার্ভিসগুলোতে। তাই নদীপথে হজ চালু হলে প্রত্যাশা অনুযায়ী হজের খরচ কমবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া দিন দিন কিন্তু নদীপথে হজ সার্ভিস সৌদি থেকে বন্ধ করা হচ্ছে। বিশেষ করে নতুন করে কোনো দেশকে তারা অনুমতি দিচ্ছে না। সেখানে বাংলাদেশ থেকে নদীপথে হজ সার্ভিস বন্ধ হওয়ার পর সৌদি সরকার আবার নতুন করে অনুমতি দিবে না কী না? সেটাও কিন্তু ভাবার বিষয়।
হজের সেবার সঙ্গে কীভাবে আপনার যুক্ত হওয়া?
লেখাপড়া শেষ করার পর আমি পূর্ব হাজীপাড়ায় একটি মসজিদে খেদমত নিই। সেখানে থাকাকালীন ১৯৯৭ সালে হজে যাওয়ার ইচ্ছে করি। তখন আমার পুরো খরচ আব্বু বহন করছিলেন। আমার হজে যাওয়ার কথা শুনে মুহিব্বিন মুসল্লিদের প্রায় ৬জন আমার সঙ্গে হজে যাবেন বলে জানান। তাদের নিয়ে হজে যাই। উস্তাদদের কাছ থেকে শুনেছিলাম, প্রথম কাবা দর্শনের সময় যে দোয়া করা হয় তা কবুল হয়। আমি কাবা শরীফ দেখে দোয়া করেছিলাম, আল্লাহ যেন আমাকে বারবার এখানে আসার তাওফিক দেন। আমার দোয়া মনে হয় কবুল হয়েছিল। আলহামদুলিল্লাহ এ পর্যন্ত আমি ২৫ বার হজ করেছি। অসংখ্য বার গিয়েছি মক্কা-মদিনায়। সেবা দিয়ে যাচ্ছি বায়তুল্লাহর মেহমানদের।
হাজীদের সেবার মান বাড়াতে রাজশাহী হজ ও উমরা গ্রুপ কীভাবে কাজ করে থাকে?
সেই ২০০৩ সাল থেকে রাজশাহী হজ ও উমরা গ্রুপ হাজীদের সেবায় কাজ করে যাচ্ছে। আমরা সেবা দেয়ার সময় হাজীদের খেদমতের নিয়তে কাজ করে থাকি। ভাবি, হাজীদের খেদমতের সুযোগ যে পেয়েছি এটাই সৌভাগ্য। এরপর যদি দুনিয়াবি আর্থিক কোনো লাভ হয় সেটা ভিন্ন বিষয়। তবে আর্থিক লাভের জন্য কখনো হাজীদের সেবায় কমতি আনি না। এর জন্য দেখা যায় দেশের স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ, আলেম-ওলামায়ে কেরাম আমাদের ওপর আস্থা রাখেন। রাজধানীর শেখ জনূরুদ্দীন রহ. দারুল কুরআন মাদরাসার মুতাওয়াল্লি জনাব মুহাম্মাদ ইমাদুদ্দীন নোমানসহ দ্বীনের অনেক মুহিব্বিনরাও আমাদের সেবা নিয়ে থাকেন স্বাচ্ছন্দ্যে।
আওয়ার ইসলাম সম্পাদক হুমায়ুন আইয়ুবের সঙ্গেও মতবিনিময় করছেন মুফতী মুস্তাফিজুর রহমান
হাজীদের চাহিদা কতটা পূরণ করতে পারছে বর্তমান হজ এজেন্সিগুলো? অনেকের বিরুদ্ধে তো অনিয়মের অভিযোগ শোনা যায়। এর কারণ কী?
হাজী সাহেবদের হয়রানির পেছনে বড় দায়ী মধ্যস্বত্বভোগীরা। অনেক সময় দেখা যায় তারা হাজী সাহেবদেরকে নানা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে টাকা নেয়। কিন্তু সেটা এজেন্সিকে জানায় না। সে কারণে এজেন্সি ও হাজী সাহেবের মাঝে তৈরি হয় টানাপোড়েন। অনেক সময় কিছু এজেন্সির অতিলোভের কারণেও এমনটি হয়। তারা হাজীদের সেবাকে প্রাধান্য না দিয়ে আর্থিক লাভকে প্রাধাণ্য দেয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে এজেন্সিগুলো যথাসাধ্য সেবা দেয়ার পরও অনেকের মন খুশি করা যায় না।
আরেকটি বিষয় হলো, হজের প্রায় ৯৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয় সৌদিতে। বিশেষ করে মিনা-আরাফার সার্ভিস সম্পূর্ণটা থাকে সৌদি আরবের হাতে। তারা যদি সেবায় কোনো কমতি করে সেখানে এজেন্সির কিছু করার থাকে না। নিজ থেকে কিছু করতে গেলে গুনতে হয় অস্বাভাবিক খরচ; যা কোনো এজেন্সির পক্ষে বহন করা সম্ভব না। আসলে সবকিছু মিলিয়েই জটিলতা তৈরি হয়।
চলমান এ জটিলতাকে দূর করতে হজ এজেন্সি এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) যথাসাধ্য কাজ করে যাচ্ছে। হাবের সভাপতি জনাব এম শাহাদাত হোসাইন তসলিমের নানা উদ্যোগে কমে আসছে মধ্যস্বত্বভোগীদের তৎপরতা। আশা করছি সময়ের ব্যবধানে এগুলো আরো কমে আসবে।
আসন্ন হজ নিয়ে হাবের সর্বশেষ প্রস্তুতি কতটুকু?
আলহামদুলিল্লাহ, হাবের ফুল প্রিপারেশন রয়েছে। ধর্মমন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট সচিবদেরকে অসংখ্য কৃতজ্ঞতা জানাই হাবের সমন্বয়ে দারুণভাবে হজের কাজগুলোকে এগিয়ে নেয়ার জন্য। আমাদের সভাপতি জনাব এম শাহাদাত হোসাইন তসলিমের প্রচেষ্টায় ও মাননীয় ধর্মপ্রতিমন্ত্রীর উদারতায় অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে হাবের সঙ্গে ধর্মমন্ত্রণালয়ের সম্পর্ক এখন গভীর। এভাবে চলতে থাকলে হজ ব্যবস্থাপনা আরো সমৃদ্ধ হবে ইনশাআল্লাহ।
বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে আরো সমৃদ্ধ করা যায় কীভাবে? বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমদেরকে কীভাবে বাংলাদেশে টানা যায়?
আমি হজ এজেন্সি এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) এর পাশাপাশি ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব)এরও সদস্য। আমরা বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখেছি ট্যুরিজম নিয়ে বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র। কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, চট্টগ্রাম, সিলেট, উত্তরবঙ্গসহ দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে আরো উন্নত করলে এ খাত যথেষ্ঠ ভাল করতে পারবে বলে আশা করছি। এছাড়া দেশের মুসলিম স্থাপনাগুলোকে যদি আরো সমৃদ্ধ করা যায় তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমদের ট্যুরের জন্য অন্যতম পছন্দের জায়গা হতে পারে বাংলাদেশ।
কেএল/