উসমান বিন আব্দুল আলিম ।।
ইস্তিখারা শব্দের আভিধানিক অর্থ: ইস্তিখারা শব্দটি আরবী।অর্থ;কোন বিষয়ের কল্যাণ চাওয়া। ইসলামী পরিভাষায়: দুরাকাত নামায ও বিশেষ দুয়ার মাধ্যমে আল্লাহর তায়ালার নিকট দোদুল্যমান কোন বিষয়ে মন ধাবিত হওয়ার জন্য আশা করা। অর্থাৎ দুটি বিষয়ের মধ্যে কোনটি অধিক কল্যাণকর হবে এ ব্যাপারে আল্লাহর নিকট দু-রাকায়াত সালাত ও ইস্তিখারার দুয়ার মাধ্যমে সাহায্য চাওয়ার নামই ইস্তেখারা। (ইবনে হাজার, ফাতহুল বারী শরহু সহীহিল বুখারী)
অর্থাৎ, একজন মোমেন যেকোনো ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এই নিয়তে আল্লাহর কাছে যেন চায় যে,হে আল্লাহ আমি এই ভালো কাজ করতে চাচ্ছি। যদি আমার এই কাজটি ভালো বা আমার জন্য কল্যাণের হয় তাহলে আমার এই কাজে বরকত দান করো, আমার জন্য আহসান করো।আর যদি এই কাজ আমার জন্য ভালো না হয়,তাহলে আমাকে এই কাজ থেকে বিরত রাখো।
ইস্তিখারা করার হুকুম: এটি সুন্নাত। যা সহীহ বুখারী শরীফের হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।যদিও অনেকে এটাকে মুস্তাহাব বলেছেন।
কেন করবেন: যখন একটা মানুষ কোন ভালো কাজ করার জন্য বা সফরে বের হবে,অথবা কোন বিষয় সিদ্ধান্তহীনে থাকে । তখন তার উচিৎ হলো, আল্লাহর কাছে এর মধ্যে কল্যাণ আছে কিনা জেনে নেওয়া।তার পন্থা হলো ;ইস্তেখার নামাজ,আল্লাহর উপর ভরসা, যোগ্য ব্যক্তিদের পরামর্শ নেওয়া। যেমন ;বিয়ে,চাকরি, সফর ইত্যাদি ক্ষেত্রে। এতে আল্লাহ তায়া’লা যেই ফয়সালা করেন তার মধ্যেই আমাদের কল্যাণ রয়েছে।যদিও আমাদের যুক্তিতে তা মনমতো না হয়।
কাতাদা রহ: বলেন “মানুষ যখন আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরষ্পরে পরামর্শ করে তখন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সব চেয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছার তওফীক দেন।”
ইমাম নওবী রহ. বলেন “আল্লাহ তায়ালার নিকট ইস্তেখারা করার পাশাপাশি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ভাল লোকদের পরামর্শ গ্রহণ করা দরকার। কারণ, মানুষের জ্ঞান-গরীমা অপূর্ণ। সৃষ্টিগতভাবে সে দূর্বল। তাই যখন তার সামনে একাধিক বিষয় উপস্থিত হয় তখন কি করবে না করবে, বা কি সিদ্ধান্ত নিবে তাতে দ্বিধায় পড়ে যায়।
গুরুত্ব: হযরত জাবের (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন; রাসূল (সা:) প্রত্যেক কাজে আমাদের ইস্তেখারা করা সম্পর্কে এমন ভাবে শিক্ষা দিতেন যেভাবে কুরআনের সূরা শিক্ষা দিতেন। তিনি বলতেন, তোমাদের কেউ যখন কোন কাজ করার করবে তখন সে দু’ রাকাত নফল নামাজ আদায় করবে, এরপর সে এই দুয়াটি পাঠ করবে।(তিরমিজি-৪৮০)
উপরের হাদীস দ্বারা এটা স্পষ্ট যে,প্রতিটি মুসলমানের জন্য যেকোনো ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহর দিকে মুখাপেক্ষী হওয়া।আল্লাহর উপর ভরসা করা। বড়ো ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ করা।
আল্লাহ তায়ালা বলেন: “আর তুমি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে মানুষের সাথে পরমর্শ কর। অত:পর আল্লাহর উপর ভরসা করে (সিদ্ধান্তে অটল থাক)। আল্লাহ ভরসাকারীদেরকে পছন্দ করেন।“ [সূরা আলে ইমরান: ১৫৯] এতে বান্দা নিশ্চিত থাকে,পেরেশানিতে পড়তে হয় না।
নিয়ম। ইস্তেখারা নামাজের পদ্ধতি হলো,প্রথমে পাক-পবিত্র হয়ে,ইস্তেগফার করে,দোয়া-দরুদ পাঠ করে, নিজের যে-সমস্যা আছে তা নিয়তে রেখে সূরা ফাতেহার সাথে যেকোনো সূরা মিলিয়ে দুই রাকাআত নামাজ ধীর-স্থিরভাবে আদায় করা এবং হাদীসে বর্ণিত নিম্নোক্ত দোয়া পড়ে নেওয়া। তারপর সেই বিষয়ে নিজের মন যেইদিকে ঝুঁকে সেই দিকেই নিজের কল্যাণ মনে করে সেটার উপর অটল থাকা। এটাই আসল পদ্ধতি যা হাদীসে রয়েছে।যদিও অনেক উলামায়ে কেরাম অভিজ্ঞতার আলোকে বিভিন্ন পন্থা বলে থাকেন।
ইস্তেখারার দোয়া: দুই নামাজ আদায় করে এই দু'আটি পড়া। উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসতাখিরুকা বিইলমিকা ওয়া আসতাকদিরুকা বিকুদরাতিকা ওয়া আসআলুকা মিন ফাদলিকাল আজিমি ফাইন্নাকা তাকদিরু ওয়া লা আকদিরু ওয়া তালামু ওয়া লা আলামু ওয়া আংতা আল্লামুলগুয়ুবি; আল্লাহুম্মা ইন কুনতা তালামু আন্না হাজাল আমরা খাইরুন লি ফি দ্বীনি ওয়া মায়িশাতি ওয়া আক্বিবাতি আমরি ফি আঝিলি আমরি ওয়া আঝিলিহি ফাইয়াসসিরহু লি ছুম্মা বারিক লি ফিহি ওয়া ইন কুনতা তালামু আন্না হাজাল আমরা শাররু লি ফি দ্বীনি ওয়া মায়িশাতি ওয়া আক্বিবাতি আমরি ফি আঝিলি আমরি ওয়া আঝিলিহি ফাসরিফহু আন্নি ওয়াসরিফনি আনহু ওয়াক্বদুরলিয়াল খাইরা হাইছু কানা ছুম্মা আরদ্বিনি বিহি।
দোয়ার অনুবাদ: হে আল্লাহ, আমি আপনার ইলমের ওসিলা দিয়ে আপনার কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করছি। আপনার কুদরতের ওসিলা দিয়ে আপনার কাছে কল্যাণমূলক কাজের সক্ষমতা প্রার্থনা করছি। আপনি গায়ব সম্পর্কে জ্ঞাত। হে আল্লাহ, আপনি সব জানেন আর আমি কিছুই জানি না। অর্থাৎ এ বিষয়টি আমার জন্য কল্যাণকর না অকল্যাণকর— সেই জ্ঞান আপনার আছে, কিন্তু আমার নেই। আপনার কুদরত রয়েছে আর আমার মধ্যে কোনো কুদরত-সক্ষমতা নেই। যদি আপনার ইলমে এটা থাকে যে, এই বিষয়টি (ওপরের প্রথম আন্ডারলাইন করা জায়গাটির অনুবাদ। এখানে কাঙ্ক্ষিত বিষয়টি কল্পনায় আনবে।) আমার জন্য কল্যাণকর, আমার দীনের জন্য কল্যাণকর, আমার জীবনধারা এবং দুনিয়ার জন্য কল্যাণকর এবং পরিণতির বিচারেও কল্যাণকর, তাহলে তা আমার জন্য নির্ধারিত করে দিন, আমার জন্য তা সহজ করে দিন এবং আমার জন্য তাতে বরকত সৃষ্টি করে দিন। আর যদি আপনার ইলমে এটা থাকে যে, এই বিষয়টি (ওপরের দ্বিতীয় আন্ডারলাইন করা জায়গাটির অনুবাদ। এখানে কাঙ্ক্ষিত বিষয়টি কল্পনায় আনবে।) আমার জন্য মন্দ, আমার দীনের জন্যও মন্দ, আমার জীবনধারা এবং দুনিয়ার জন্যও মন্দ, পরিণতির বিচারেও মন্দ, তাহলে আমার থেকে তা সরিয়ে দিন এবং আমাকেও তা থেকে সরিয়ে রাখুন আর আমার জন্য কল্যাণকর বিষয় নির্ধারিত করুন, তা যেখানেই হোক। আমার জন্য তা সহজ করে দিন এবং আমার জন্য তাতে বরকত সৃষ্টি করে দিন। অর্থাৎ এ বিষয়টি যদি আমার জন্য কল্যাণকর না হয়, তাহলে তা হটিয়ে দিন এবং তার স্থলে যা কল্যাণকর হবে, আমার জন্য তা নির্ধারিত করে দিন। এরপর আমাকে সে বিষয়টির প্রতি সন্তুষ্ট করে দিন এবং আমার অন্তর প্রশান্ত করে দিন।
আরবি দোয়া যদি একান্ত স্মরণ না আসে, তাহলে নিজের ভাষায় এভাবে দোয়া করে নিলেও হবে— হে আল্লাহ! আমি সিদ্ধানের দোদুল্যমানতায় ভুগছি। আপনি আমাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করুন।
মুখেও যদি বলার মতো পরিস্থিতি না থাকে, তাহলে মনে মনে এ কথা স্মরণ করবে— হে আল্লাহ! এই সমস্যা এবং পেরেশানি দেখা দিয়েছে। এখন আপনি আমাকে সঠিক পথ দেখিয়ে দিন; যে পথ আপনার সন্তুষ্ট মোতাবেক হবে এবং যাতে আমার জন্য প্রভূত কল্যাণ নিহিত থাকবে।
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেছেন, ‘এ দোয়ার যেখানে ‘হাজাল আমরা’ শব্দটি আসবে, সেখানে যে কাজটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাওয়া হচ্ছে সেটি মনে মনে তা উল্লেখ করা। পুনরায় সে বিষয়টি ভেবে নেওয়া। দোয়া শেষ করে কারও সঙ্গে কথা না বলে কেবলামুখী হয়ে ঘুমিয়ে পড়া। ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর মন যেদিকে তথা যে বিষয়ে সায় দেবে বা যেদিকে আগ্রহী হয়ে উঠবে, সেটিই ফলাফল মনে করা এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়া।’ (তুহফাতুল আলমায়ি : ২/৩৩৮)
ভুল প্রচলন: অনেকে মনে করে থাকেন ইস্তেখারা নামাজের নির্দিষ্ট সূরা,সময় ও নিয়ম রয়েছে,এটা জরুরি। কিন্তু না,নামাজের জন্য মাকরুহাতের সময় ছাড়া আপনি যেকোনো সময় বা সূরা দিয়ে এটা আদায় করতে পারেন।কেউবা মনে করেন শুধু রাতেই এই নামাজ পড়া যায়,তাদের ভুল ধারণা রয়েছে।যেকোনো সময় এই নামাজ আদায় করতে পারবেন।অনেকে আবার মনে করেন ইস্তেখারা নামাজ পড়ে ঘুমাতে হয়, তাদেরও ভুল ধারণা রয়েছে।এরজন্য ঘুম জরুরি নয়।এরকম আলোচনা হাদীসে আসেনি।তবে কেউ যদি গভীর রাতে ওঠে পাক-পবিত্র হয়ে দুই রাকাআত নামাজ আদায় করে ঘুমিয়ে যায় এবং স্বপ্নে দেখে তারপর সে স্বপ্নে সঠিক সিদ্ধান্ত পেয়ে যায় সেই বিষয়ে।তাহলে সুন্নাত মনে না করলে এভাবে করার অবকাশ আছে।অনেক বুযুর্গ এভাবে করতেন।কাউকে আবার ইস্তেখারা তিনবার করে করতে দেখা যায়,কিন্তু এটা জরুরি মনে করা যাবে না।হাদীসে এরকম নিয়ম পাওয়া যায় না।একবার করলেই যথেষ্ট।
স্বপ্নে যদি কোনো একদিকে মন ঝুঁকে যায় তাহলে সেটাকেই আপনার জন্য কল্যাণমূলক মনে করবেন।আর যদি দোদুল্যমানতা থাকে তাহলেও চিন্তার কারণ নেই, আল্লাহর উপর ভরসা করে নিজের মন যেটা চায় সেটাই করতে থাকুন।ওটার মধ্যেই খায়ের থাকবে ইন শা আল্লাহ। কেননা আপনি যখন কাজ করার আগে নিজেকে আল্লাহর সোপর্দ করেছেন, তো_আল্লাহ তায়া’লা আপনার দ্বারা সেই কাজ টা-ই করাবেন যা আপনার জন্য ভালো।
এক্ষেত্রে যদি পড়ে গিয়ে আপনার দৃষ্টিতে দেখা যায় বিষয়টি কল্যাণের না।তারপরও আপনাকে কল্যাণের মনে করতে হবে।মনে করতে হবে এটাই আমার জন্য ভালো।আসলে আমরা তৎক্ষণাৎ বুঝি না।কিন্তু একটা সময় ঠিকই বুঝি যে,আল্লাহ যেটা করেছে ভালোর জন্যই করেছে।খেয়াল রাখতে হবে,কোনো ধরণের খারাপ কাজের জন্য এরকম করা যাবে না।এতে অনেক বড়ো গুনাহ হবে।তবে আপনার যদি কাউকে পছন্দ হয় সেক্ষেত্রে আপনি ইস্তেখারা করে যদি মন ঝুঁকে যায় বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার তাহলে এরকম করার অবকাশ আছে।এটাই করা উচিৎ। এতো বড়ো ডিসিশন নেওয়ার আগে আমল করে এর সঠিক ফয়সালা আল্লাহর কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া।
আল্লামা তাকী উসমানি হা. বলেন যে,আমি আমার বাবা শফী রহ. কে যেকোনো সিদ্ধান্তের বিষয় সামনে আসলে সাথে সাথে দুই রাকাআত নামাজ আদায় করে চোখ বন্ধ করে ইস্তেখারার দোয়া পড়ে নিতেন।তারপর সিদ্ধান্ত নিতেন।
আল্লামা এবনে মোবারক রহ. বলেন যে বান্দা নিজের বিষয়াদিতে ইসতিখারা করে, সে কখনো ব্যর্থ হয় না। আর যে নিজের কাজকর্মের শুরুতে পরামর্শ করে, সে কখনো অনুতপ্ত হবে না যে, কেনো এ কাজটি করে ফেললাম কিবা কেনো এই কাজটি করলাম না। কেননা সে যা করেছে পরামর্শ করেই করেছে কিবা যা সে করেনি তা পরামর্শক্রমেই করেনি। এজন্য সে কখনো অনুতাপে ভোগবে না। (মাজমাউয যাওয়ায়িদঃ ৮/৯৬)
আল্লাহ আমাদেরকে প্রতিটি ভালো কাজ ইস্তেখারা বা পরামর্শের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়ে করার তৌফিক দান করুক, সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুক। আমীন।
লেখক: মোহাদ্দেস,জামি'আ ইসলামিয়া আরাবিয়া। বলিয়ারপুর, সাভার, ঢাকা।
-এটি