।।আবুল ফাতাহ কাসেমী।।
শিয়া মতবাদ ইসলামের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ইসলামের আকিদা বিশ্বাসকে গোড়া থেকে স্বমূলে ধ্বংস করার জন্য এ মতবাদের সূচনা হয়। শিয়া মতবাদ সম্পর্কে অনেকের মৌলিক ধারণা না থাকার ফলে অনেকেই তাদেরকে ইসলামের অন্যান্য ভ্রান্ত ফেরকার মত একটি ফেরকা মনে করেন। কিন্তু বাস্তবে তাদের আকিদা বিশ্বাস এরচেয়ে আরো মারাত্মক। যা কুফুরি পর্যন্ত নিয়ে যায়। ইতিহাসে শিয়ারা কয়েকটি দলে বিভক্ত।
শিয়াদের দল উপদল:
শিয়াদের মধ্যে প্রথমত তিনটি দল রয়েছে;
এক. তাফযিলিয়া শিয়া। এরা হজরত আলী রাদি. কে শাইখাইনের (হযরত আবু বকর ও উমর রা.) উপর ফযিলত দিয়ে থাকে।
দুই. সাবইয়্যা শিয়া। এরা হজরত সালমান ফারসি, আবু জর গিফারি, মেকদাদ ও আম্মার রাদি. প্রমুখ অল্প সংখ্যক সাহাবি ব্যতীত অন্য সকল সাহাবি রাদি.কে মুনাফেক ও কাফের মনে করে।
তিন. গুলাত বা চরমপন্থী শিয়া। এদের কতক হজরত আলী রাদি. এর খোদা হওয়ার প্রবক্তা ছিল। এদের অনেকে আবার মনে করে, খোদা তার মধ্যে প্রবেশ করেছেন অর্থাৎ তিনি ছিলেন খোদার অবতার বা খোদার প্রকাশ। এভাবে নানা মতে ও বিশ্বাসে শিয়াদের ২৪টি উপদল ছিল। যাদের একটি দল ছিল ইমামিয়া। এরা শিয়াদের একটি বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। সাবইয়্যাদের ছিল ৩৯টি উপদল। ইমামিয়া দলের মধ্যে প্রধান ও প্রসিদ্ধ হল ৩টি উপদল। যথা
এক. ইছনা আশারিয়া।
দুই. ইসমাইলিয়া।
তিন. যায়দিয়া।
বর্তমানে ইছনা আশারিয়া (বার ইমামপন্থী) শিয়াদের অস্তিত্বই প্রবল। এদেরকে ইমামিয়াও বলা হয়। বর্তমানে ইছনা আশারিয়া এবং ইমামিয়া নাম দুটো প্রায়সমার্থবোধকে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক কালে সাধারণভাবে শিয়া বলতে এই ইছনা আশারিয়া বা ইমামিয়া শিয়াদেরকে বোঝানো হয়ে থাকে। শিয়াদের মধ্যে সবচেয়ে এদের সংখ্যাই অধিক। উপমহাদেশসহ মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র তাদের অনুসারি রয়েছে। বর্তমান ইরানে তারাই ক্ষমতাসীন। ইরাকেও প্রচুর সংখ্যক এরূপ শিয়া রয়েছে। ইমামপন্থি এসব শিয়াদের সাথে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বহু মৌলিক বিষয়ে মতবিরোধ রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান হল তিনটি।
এক. ইমামত সংক্রান্ত আকিদা। এর অর্থ হল, আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের হেদায়েতের জন্য যেমন নবী রাসুলদের মনোনীত করেছেন, ঠিক তেমনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর থেকে কেয়ামতের আগ পর্যন্ত মানুষের হেদায়েতের জন্য বারজন ইমাম মনোনীত করেছেন। দ্বাদশতম ইমামের উপর পৃথিবী শেষ হয়ে কেয়ামত হবে।
তাদের দাবি মতে, যে ইমামকে না মানবে সে কাফের, ইমামগণ দুনিয়া ও আখেরাতের মালিক এবং তারা যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন ও ক্ষমা করেন, ইমামদের আনুগত্য করা ফরজ, প্রত্যেক জুমার রাতে ইমামদের মেরাজ হয়, তারা আরশ পর্যন্ত পৌঁছেন, ইমাম ব্যতীত দুনিয়া কায়েম থাকতে পারে না, ইমামগণ যা ইচ্ছা হালাল ও হারাম করার ক্ষমতা রাখেন, ইমামগণ পয়গাম্বরদের মতই নিষ্পাপ ইত্যাদি।
দুই. সাহাবা বিদ্বেষ সংক্রান্ত আকিদা। অর্থাৎ হজরত আলী রাদি, -এর ইমামত না মানার কারণে খোলাফায়েরাশেদার বাকি তিনজন তথা হজরত আবু বকর, উমার ও উসমান রাদি, ও অন্যান্য সাহাবায়েকেরাম রাদি. নিশ্চিতই কাফের ও মুরতাদ। (নাউযুবিল্লাহ)
তিন. কুরআন বিকৃতি বিষয়ক আকিদা। অর্থাৎ তারা বিশ্বাস রাখে, মুসলমানদের নিকট সংরক্ষিত কুরআন বিকৃত। তাদের কুরআন বিকৃতির এ আকিদা ইমামত আকিদারই অবশ্যম্ভাবী ফলাফল। কেননা শিয়াদের ধারণায়কুরআন সংকলনকারী হজরত আবু বকর, উসমান ও তাদের সহযোগী সাহাবাগণ ছিলেন আলী বিদ্বেষী। ফলে কুরআন থেকে হজরত, আলী ও আহলে বাইতের ফযিলতমূলক বর্ণনাসমূহ পরিকল্পিতভাবে তারা বাদ দিয়েদিয়েছেন। তাই মুসলিমদের নিকট সংরক্ষিত কুরআন বিকৃত। তাদের আরো দাবি হল, এ কুরআনের প্রায়দুই তৃতীয়াংশ গায়েব করে দেয়া হয়েছে, আসল কুরআন ইমামে গায়েবের নিকট রয়েছে. কুরআন বিকৃতি সম্বন্ধে আলীও বলে গেছেন, কুরআনে একটি সুরা ছিল যা বর্তমানে নেই ইত্যাদি।
উপমহাদেশে শিয়া মতবাদ
ইমামিয়া ও ইছনা আশারিয়া শিয়া মতবাদের জন্মের পর থেকেই উম্মাহর আহলে হক উলামায়েকেরাম ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা স্পষ্ট করতঃ এ ফেরকার ভ্রান্তি নিয়ে আলোচনা করে আসছেন। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া তার 'মিনহাজুস সুন্নাহ' কিতাবে শিয়াদের কুফুরি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করেন। বাদশা হুমায়ুনের সময়ে এ ফেরকা দলগতভাবে উপমহাদেশে তাদের মতবাদ প্রচার শুরু করে। বাদশা হুমায়ুন তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত আলেম আল্লামা ইবনে হজর মক্কি রহ.কে তাদের ব্যাপারে জানতে চেয়ে চিঠি লেখলে তিনি 'তাতহিরুল জিনান ওয়াল লিসান' ও ‘আসওয়ায়িকুল মহররকা' নামে দুটি লেখেন।
এরপর বাদশা আকবরের সময়ে এরা স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পায়। তখন শাইখ আহমদ সেরহিন্দি তথা মুজাদ্দেদে আলফে সানি রহ. তাদের বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, কুরআনি ইসলামের বিপরীতে এ ফেরকা নতুন ইসলাম তৈরি করছে। এ ফেরকার আকিদাগুলো কুরআন সুন্নাহ ও ইজমায়ে উম্মাতের স্পষ্ট বিরোধী।
এরপর বাদশা আলমগীরের সময়তার নেতৃত্বে গঠিত পাঁচশ’ আলেমের সমন্বয়েযে বিখ্যাত ফতোয়ার কিতাব তৈরি করা হয়, সে ফতোয়ার কিতাবে শিয়ামতবাদকে কুফুরি আখ্যা দেয়া হয়। ফতোয়া আলমগীরি বা ফতোয়া হিন্দিয়া নামের এ কিতাবে তাদের কুফুরি মতবাদকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়। অষ্টম হিজরিতে বিশিষ্ট মুফাসসির, মুহাদ্দিস হাফেজ ইবনে কাসির রহ. (মৃত্যু ৭৭৪ হিজরি) সুরা ফাতাহ'র ২৯ নং আয়াতের অধিনে ইমাম মালেক রহ. -এর উদ্ধৃতিতে শিয়া তথা রাফেজিদের ব্যাপারে আলোচনা করেন। তাছাড়া শাহ ওলিউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলবি রহ. তার ‘ইযালাতুল খফা' গ্রন্থে সাহাবায়েকেরাম রাদি. -এর জীবনচরিত নিয়েআলোচনা করতে গিয়েশিয়া ইমামামিয়াদের কুফুরি নিয়েআলোচনা করেন। এরপর তার ছেলে শাহ আবদুল আজিজ রহ. তার 'তুহফায়েইসনা আশারাহ কিতাবে তাদের বাতিল আকিদা নিয়েআলাপ করেন। হজরত রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি রহ. ও ‘হেদায়াতুশ শিয়া' নামে একটি কিতাব লেখেন। উলামায়ে দেওবন্দের তারকাপুরুষ হজরত কাসেম নানুতবি রহ. ‘হাদিয়্যাতুশ শিয়া' নামে তাদের মুকাবেলায় একটি কিতাব লেখেন। হজরত খলিল আহমদ সাহারানপুরি রহ ও হেদায়াতুর রশিদ' নামে একটি কিতাব লেখেন।
মোটকথা সব যুগের উলামায়েকেরাম তাদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করে উম্মতকে তাদের ফেতনা থেকে সতর্ক করেন। শুরুতে তাদের লিখিত গ্রন্থাদি কম ও দূলর্ভ থাকলেও বর্তমানে সচারচ পাওয়া যায়। ফলে যে কেউ তাদে লিখিত বই পুস্তক দেখলেই সহে তাদের ভ্রান্ত আকিদা বিশ্বাস সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন।
ইসনা আশারি শিয়ারা কি মুসলিম?
ইসলামে কোন মুসলমানকে যেমন কাফের বলার সুযোগ নেই, ঠিক তেমনি কোন কাফেরকেও মুসলমান বলার সুযোগ নেই। ঈমান ও কুফুর দুটোই আলাদা আলাদা বিষয়। ঈমান ও কুফুরের ভিত্তি কেবল আকিদা বিশ্বাসের উপর। আল্লাহর একত্ববাদ, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালত, খতমে নবুওয়াত, জরুরিয়াতে দীন ও ইসলামের বিধিবিধানকে অন্তর থেকে যে বিশ্বাস করবে, সেই মুসলিম। এসবের উপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস না রেখে কেবল কালিমা মুখস্ত করলেই মুসলমান হওয়া যায় না। হজরত আল্লামা কাশ্মীরি রহ. বলেন, যারা জরুরিয়াতে দীনের উপর বিশ্বাস রাখে না এবং ইসলামের অকাট্য বিধানাবলীর বিরুধীতা করবে, তারা উম্মাহর ঐকমত্যে কাফের সাব্যস্ত হবে। [ইকফারুল মুলহিদিন, পৃ.৬২]
উম্মাহর বিদগ্ধ মনীষীগণ শিয়া মতবাদের কিতাবাদি পর্যালোচনা করে সকলেই তাদের ব্যাপারে কুফুরির ফতোয়া দিয়েছেন। কেবল একটি নয়; তাদের আকিদায় অসংখ্য কুফুরি বিশ্বাস এবং ইসলামের অকাট্য বিধানাবলী অস্বীকার এবং বিকৃতির কারণ একত্রিত হয়েছে। ইসলামে অসংখ্য বিকৃতির কারণে তারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাত থেকে বের হয়েগিয়েছে। তার মধ্যে মৌলিক কয়েকটি হলো,
এক. নবীদের নিষ্পাপ মনে না করা। দুই. নবীদের উপর তাদের কথিত ইমামদের প্রাধান্য দেয়া। তিন. কুরআনের স্পষ্ট বিকৃতি করা। চার. সাহাবায়েকেরামকে মুরতাদ তথা ধর্মত্যাগী আখ্যা দেয়া। পাঁচ. হজরত আবু বকর ও উমর রাদি. -এর খেলাফতকে অস্বীকার করা। ছয়. উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রাদি. -এর উপর মিথ্যা অপবাদ দেয়া।
উপমহাদেশে প্রথম ফতোয়া
উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম হজরত মাওলানা আবদুশ শকুর ফারুকি লাখনভী একটি ফতোয়ায় উল্লেখ করেন, ইছনা আশারিয়া রাফেজি শিয়া মতাবলম্বীরা ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে গেছে । আমাদের পূর্বসূরী অনেক উলামায়েকেরাম তাদের মতবাদের বিষয়টি মূল থেকে না জানার কারণে সতর্কতাবশত তাদেরকে কাফের ফতোয়া দেননি কেননা তারা সাধারণত তাদের আকিদা বিশ্বাসকে লুকিয়ে রাখে এবং তাদের কিতাবাদিও সচারচর পাওয়া যেত না। বর্তমানে তাদের আকিদা বিশ্বাস ও লিখিত কিতাবাদি সকলের সামনে রয়েছে। তাই তারা কাফের হওয়ার ব্যাপারে সকল আলেম ঐকমত্য পোষণ করেন। [মাকালাতে হাবিব এর সূত্রে, শাইখুল হিন্দ একাডেমি, দারুল উলুম দেওবন্দ ১/৩৬৫] মাওলানা লাখনভীর এ ফতোয়াতে তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত ত্রিশজন আলেম সত্যায়ন করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন— শাইখুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি, মুফতিয়ে আজম মাওলানা কেফায়েতুল্লাহ শাহজাহানপুরি, দারুল উলুম দেওবন্দের প্রখ্যাত মুফতি মাওলানা রিয়াজুদ্দিন, মাওলানা ইজাজ আলী, মুফতি মুরতাজা হাসান চান্দপুরি, পাকিস্তানের গ্রাণ্ড মুফতি মুহাম্মদ শফি, মুহাদ্দিসে কাবির মাওলানা খলিল আহমদ সাহারানপরি, হজরত মাওলানা আনওয়ার শাহ কাশমিরি, মুফতি মাহদি হাসান শাহজাহানপুরি রহ. প্রমুখ বিখ্যাত মুফতিগণ। এসব আকিদা বিশ্বাস ছাড়াও তারা ১০ই মহররমের দিন ইমাম হুসাইন রাদি. -এর শাহাদাত উপলক্ষে তাজিয়া মিছিল বের করে। সেখানে ঈমান বিধ্বংসি অনেক কুফুরি কথা ও শরিয়াহ বিবর্জিত অনেক কর্মকাণ্ড করে থাকে।
লেখক: অনুবাদক ও শিক্ষক জামিয়া কারিমিয়া আরাবিয়া, রামপুরা, ঢাকা
-এএ