আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: ‘ইসলামি শিক্ষা উন্নয়ন বাংলাদেশ’-এর সভাপতি ড. একেএম মাহবুবুর রহমান ও মহাসচিব প্রফেসর মুহাম্মদ আবদুর রহমান এক বিবৃতি বলেন, আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে,, গত ২৩/০৬/২০২২ তারিখে এনসিটিবি-চেয়ারম্যান স্বাক্ষরিত একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘সম্প্রতি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই শিক্ষাক্রম সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করছে যে, নতুন শিক্ষাক্রমে ধর্মশিক্ষাকে বাদ দেয়া হয়েছে। উল্লিখিত প্রচারণাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট।’
এই প্রেস বিজ্ঞপ্তির অভিন্ন সুরে শিক্ষামন্ত্রী স্বয়ং ব্রিফ করেছেন। প্রকৃত পক্ষে, এই বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষার্থীদের ভয়াবহ ক্ষতির বিষয়টি শুভঙ্করের ফাঁকির মতো চাতুরতার সাথে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সেটি হলো, প্রথম পাবলিক পরীক্ষা এস এস সি-র সামষ্টিক মূল্যায়ন তথা বোর্ড পরীক্ষা থেকে ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ বিষয়টিকে বাদ দেয়া হয়েছে । যে পাঁচটি বিষয়ের বোর্ড পরীক্ষা হবে তা হলো-বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সামাজিক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান। এর ভেতরে ধর্মশিক্ষা নেই। আর যে পাঁচটি বিষয়ের বোর্ড পরীক্ষা হবে না, তা হলো- জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, ভালো থাকা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি (জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ঃ পৃষ্ঠা-৯৭)। তাহলে ধর্মশিক্ষা আছে মাত্র স্কুলের ক্লাস ও অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার জন্য। এতে কি ধর্মশিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকল? বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে ধর্মশিক্ষা কখনই বোর্ড পরীক্ষার বাইরে ছিল না। শুধু বোর্ড পরীক্ষার বাইরে ছুঁড়ে ফেলেই ক্ষান্ত নয়, ধর্মশিক্ষার ক্লাসসংখ্যা বা শিখন ঘন্টাও অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় নির্মমভাবে সঙ্কোচন করা হয়েছে। যেমন দশম শ্রেণির ধর্মশিক্ষার বাৎসরিক শিখন ঘন্টা বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানের চেয়ে ১০১ টি করে কম। (জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ঃ পৃষ্ঠা-৯১)।
এছাড়া একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে নতুন রূপরেখায় ধর্মের কোনো অস্তিত্ব নেই। আছে ‘মূল্যবোধ ও নৈতিকতা’ নামের শিখনক্ষেত্রের কথা। এতে আদৌ কোনো ধর্মশিক্ষার বই আবশ্যিক এবং বোর্ড পরীক্ষার অন্তর্ভুক্ত থাকবে কিনা, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। ফলে জাতীয় শিক্ষাক্রমের বর্ণনাই ভরসা। ২০১২ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষাক্রমের ১১ নং পৃষ্ঠায় একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির জন্য ছয়টি শাখা রাখা হয়েছে। বিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা, ইসলাম শিক্ষা, গার্হস্থ্যবিজ্ঞান ও সঙ্গীত।
এর মধ্যে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা, গার্হস্থ্যবিজ্ঞান ও সঙ্গীত, এই এই চার শাখায় ধর্মশিক্ষার কোনো আংশিক বা ঐচ্ছিক পাঠও নেই। শুধু মানবিক শাখার ঐচ্ছিক ১৭টি গুচ্ছ বিষয়ের মধ্যে অপাঙ্ক্তেয় অবস্থায় ইসলাম শিক্ষা রয়েছে, যা বোর্ড পরীক্ষার অন্তর্ভুক্ত নয়। শুভঙ্করের ফাঁকির আরো সূক্ষ্ম কাণ্ড হলো, ইন্টারে খোদ ইসলাম শিক্ষা নামেই একটি শাখা রাখা হয়েছে, যাতে তিনটি আবশ্যিক বিষয়ের একটি হচ্ছে আরবি। মূলতঃ এই শাখাটি কেতাবে থাকা কাজীর গরুর মতো।
এ শাখাটি প্রচলিত নেই, এর জন্য বিশেষজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় না; এ বিষয়টির কোনো পাইলটিং তো দূরে থাক, নতুন করে বিষয়টি ওপেন করার অনুমোদনও অঘোষিত ভাবে বন্ধ। পারিপার্শ্বিক কারণে এর বিষয়টির চাহিদা প্রকাশেরও সুযোগ নেই। কারণ, প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ধারাবাহিক আরবি না শিখে একাদশে গিয়ে হঠাৎ করে কঠিন আরবি ভাষা ও সাহিত্য পড়া সক্রেটিসের পক্ষেও সম্ভব নয়। তাই এটিকে কার্যকর করার জন্য অবশ্যই যৌক্তিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
নব্বই ভাগ মুসলমান তথা শতভাগ ধর্মপ্রাণ মানুষের এই বাংলাদেশে কোনো সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক এরকম ধর্মশিক্ষাকে অপাঙ্ক্তেয় অবস্থায় রাখা, বোর্ড পরীক্ষার বাইরে রেখে সঙ্কুচিত ও গুরুত্বহীন করাকে কিছুতেই সমর্থন করে না। সম্পূর্ণ জনমতের বাইরে থেকে কোন্ দেশের পরামর্শে, কাদের হীন স্বার্থে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, জাতির কাছে তা একদমই অবোধগম্য ও অনভিপ্রেত।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ধর্মের মতো সর্বপ্রধান বিষয়টি বোর্ড পরীক্ষার বাইরে রাখার ফলে, সেটি যে মারাত্মকভাবে গুরুত্বহীন হবে, সেটুকু বোঝার জন্য যুক্তিতর্কেরও প্রয়োজন হয় না। একে তো দুর্নীতি প্রতিরোধ ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার প্রধান উৎসই ধর্মশিক্ষা; তদুপরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বঙ্গবন্ধুর মতোই শিক্ষা-নীতিমালায় ধর্মশিক্ষাকে প্রাধান্য দেয়ার কথা অধিক গুরুত্বের সাথে বলেছেন। (জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ঃ প্রাক-কথন, শিক্ষার উদ্দেশ্য-পৃষ্ঠা ০২) মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা পাশ কাটিয়ে, বোর্ড পরীক্ষার বাইরে রেখে ধর্মশিক্ষাকে গুরুত্বহীন করার মতো ঔদ্ধত্ব কারা কীভাবে দেখাতে পারল, সেটা অবশ্যই খতিয়ে দেখার বিষয়।
যার যার ধর্মশিক্ষা গুরুত্বের সাথে অর্জন করা প্রত্যেক সম্প্রদায়ের সাংবিধানিক অধিকার। প্রতিটি রাষ্ট্র শিক্ষার্থীদের জন্য ধর্মশিক্ষার সর্বোচ্চ ব্যবস্থা রাখে। ইসরাইলের মতো একটি বিতর্কিত-অস্বীকৃত রাষ্ট্র, যাকে সর্বাধুনিক মনে করা হয়, তারা যদি তাদের ধর্মশিক্ষা ‘তালমুদ’ ডিগ্রী পর্যন্ত বাধ্যতামূলক রাখতে পারে, তাহলে উন্নত দেশ গড়ার জন্য কোন্ যুক্তিতে আমাদের ধর্মশিক্ষাকে গুরুত্বহীন করতে হবে?
এ প্রেক্ষিতে গত ২৩/০৬/২০২২ তারিখে এনসিটিবি প্রকাশিত প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রত্যাহার ও শিক্ষাক্রম রূপরেখা সংশোধনপূর্বক জনস্বার্থে নিম্নোক্ত দাবিমালা বাস্তবায়নের জন্য ‘ইসলামি শিক্ষা উন্নয়ন বাংলাদেশ’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছে। দাবিমালা হচ্ছে-
১। ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ বিষয়টিকে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা, গার্হস্থ্য অর্থনীতি, সঙ্গীত এবং কারিগরিসহ সকল শাখায় আবশ্যিক বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
২। দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির সামষ্টিক মূল্যায়ন তথা বোর্ড পরীক্ষায় ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ বিষয়টিকে বহাল রাখতে হবে।
৩। বিতর্কিত, প্রত্যাখ্যাত কুরআনবিরোধী বিবর্তনবাদসহ ইসলামবিরোধী সকল পাঠ্য রচনা সিলেবাস থেকে অপসারণ করতে হবে।
৪। আরব দেশগুলোর শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার জন্য আরবি ভাষাকে সর্বস্তরে বাধ্যতামূলক করতে হবে। উল্লেখ্য, ভারতের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরাও এ উদ্দেশ্যে আরবি ভাষা শিখে এগিয়ে রয়েছে।
আজ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও ধর্মশিক্ষার গুরুত্বের জন্য বোর্ড পরীক্ষায় বহাল রাখার কথা দাবি করে বলতে হবে, একথা ভাবতেও লজ্জা হচ্ছে। ধর্মবিমুখ প্রজন্ম দিয়ে নৈতিকতাসমৃদ্ধ উন্নত সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখা মাকাল গাছে কমলা ফলনের মতোই অবাস্তব।
‘ইসলামি শিক্ষা উন্নয়ন বাংলাদেশ’ এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইতোপূর্বেই এনসিটিবি-চেয়ারম্যান, মাউশি-মহাপরিচালক, শিক্ষাসচিব মহোদয়, কয়েক জন মাননীয় সংসদ সদস্য, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী; সর্বোপরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর একাধিকবার স্মারকলিপি প্রদান করেছে। বেশ কিছু ফিচার ও প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে।
জাতীয় প্রেসক্লাবসহ সরাসরি ও অনলাইনে অনেক সেমিনার ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এত দিনে এ যৌক্তিক দাবিমালা সরকারের প্রশাসন ও নীতিনির্ধারক, সুধীজন ও চিন্তাবিদ এবং ছাত্র ও অভিভাবক সমাজের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। লক্ষ লক্ষ জনতা এর সাথে সংহতি প্রকাশ করছে। আমরা দৃঢ়ভাবে আশাবাদী যে, এ পর্যায়ে সরকার উল্লিখিত দাবিমালা বিবেচনায় নিয়ে নতুন চূড়ান্ত শিক্ষাক্রম রূপরেখা পরিমার্জন করে প্রকাশ করবে।
প্রয়োজনে উক্ত সংগঠন এ সংশোধনী কর্মসূচিতে সরকারকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছে। অন্যথায় এসব চাপিয়ে দিলে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হবে এবং ধর্মপ্রাণ জনগণ কোনো দিনই তা মেনে নেবে না। কোনো এক পর্যায়ে জনমত-বিস্ফোরণ জনরোষে পরিণত হতে পারে। আসলে গণমানুষের মনের ভাষা কেড়ে নিয়ে কেউই কিছু টিকাতে পারে না। ৫২, ৬৯, ৭১ তো তাই বলে। ধর্মশিক্ষা গণমানুষের অন্তরাত্মার চাহিদা।
মানুষ জীবনের বিনিময়ে হলেও ধর্মের মান সমুন্নত রাখে। আর ধর্ম নিজেই মানুষকে আন্দোলিত করে। ধর্ম নিয়ে খেলা চলে না; এটা আগুন খেলার মতো। আমরা তা কিছুতেই চাই না। সর্বশক্তিমান আল্লাহ সবার সুমতি দিন।