।।ফারুক ফেরদৌস।।
আয়েশা রা. ছিলেন আল্লাহর নির্বাচিত; নবীজির যুগে ও ওফাত পরবর্তী সময়ে মুসলমানদের ফিকহচর্চা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণ, বিধি বিধান প্রণয়ন ইত্যাদিতে নারীর শক্তিশালী প্রতিনিধিত্বের যে প্রয়োজনীয়তা ছিলো, আল্লাহ তাআলা আয়েশা রা.-এর মাধ্যমে সেই প্রয়োজনীয়তা পূরণ করেছিলেন।
সাহাবীদের যুগের ইতিহাস যাদের পড়া আছে তারা জানেন, দীর্ঘ কাল যাবত সাহাবীদের সমাজে আয়েশা রা.-এর কত শক্তিশালী অবস্থান ও মান্যতা ছিলো। তার চেয়ে বয়সে প্রবীণ বয়োজ্যেষ্ঠ সাহাবীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইলম, ফিকহ ও ফয়সালার জন্য তার দারস্থ হতেন। নবীজির স্ত্রী উম্মুল মুমিনীন ছাড়া আর কারো পক্ষে এই ভূমিকা রাখা সম্ভবপর ছিলো না। রসূল সা.-এর সমবয়সী বা কাছাকাছি বয়সী স্ত্রীদের পক্ষেও দীর্ঘ কাল ধরে এই ভূমিকা রাখা সম্ভব ছিলো না।
নারীদের বিধি বিধান, অধিকার ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট ফিকহ আয়েশা রা.-কে ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। ফিকহচর্চা ও বিন্যাসের ইতিহাস পড়লে দেখবেন শুধু আয়েশা রা.-এর প্রেজেন্সের কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের জন্য শরিয়ত কত সহজ সাবলীল হয়েছে, কত শক্তিশালীভাবে সেগুলো প্রমাণ করা গেছে। এর আগে একটা লেখায় আমি বলেছিলাম হানাফী মাযহাবে নারীদের কবর যিয়ারত নিষিদ্ধ বা অপছন্দনীয় তো নয়ই, বরং পুরুষদের মতোই মুস্তাহাব।
এই মতামতের দলীল আয়েশা রা.-এর হাদীস। নারীদের ইবারত বা একক ইচ্ছায় বিয়ে হতে পারে এর দলীল কুরআনের আয়াতের পাশাপাশি আয়েশা রা.-এর আমল। অনেক আলেমদের কাছে হায়েযা অবস্থায়ও মসজিদে প্রবেশ করা নারীদের জন্য বৈধ আয়েশা রা.-এর বর্ণনার কারণে। একজন সাহাবী যখন বলেছিলেন নারীরা সামনে থাকলে নামায হবে না বা ভেঙে যাবে। হযরত আয়েশা রা.-এর প্রতিবাদের কারণেই সেটা সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নাই। তিনি বলেছিলেন রসূল সা. আমাকে সামনে রেখে বহু রাত তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করেছেন।
শুধু নারী সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিই নয়, আয়েশা রা.-এর বিচরণ ও ব্যাপক প্রভাব আছে সামগ্রিক ফিকহেই। তাবেয়ী যুগে মদীনার বিখ্যাত সাত ফকীহের প্রায় সবাই দেখবেন আয়েশা রা.-এর ছাত্র, এর মধ্যে দুইজন আবার একেবারেই তার হাতে গড়া শাগরেদ। একজন তার ভাগ্নে উরওয়া ইবনে যুবাইর, আরেকজন তার ভাতিজা কাসেম ইবনে মুহাম্মাদ।
আপনি ইসলামই মানেননা, আল্লাহর নির্বাচন ইত্যাদি গল্প বিশ্বাস করার আগ্রহ নাই, আয়েশা রা.-এর প্রয়োজনীয়তা বা ভূমিকা নিয়ে আপনার মাথা ব্যথা নাই, তাহলে আসেন কমন সেন্স দিয়ে বিচার করি। দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে আসলে কী বেশি গুরুত্বপূর্ণ? সদ্ভাব, সদাচার, ভালোবাসা নাকি বয়সের পার্থক্য? সমবয়সী বা বয়সে বড় নারীকে বিয়ে করার পরে তার সাথে অসদাচার, নির্যাতন, জবরদস্তি যৌনসম্পর্ক, অপমান, হেনস্থা ইত্যাদি ঘটনার নজির কি নাই? বিপরীতে আমি দেখেছি আমার দাদা তার বিশ বছর কম বয়সী স্ত্রীকে আপনি বলে সম্বোধন করতেন। স্ত্রীর প্রতি তার সম্মান, অনুরাগ ও ভালোবাসা ছিলো প্রবাদতুল্য। আমার বহু আত্মীয় স্বজন অডিয়েন্সে আছেন, তারা এই বক্তব্যের সত্যতার সাক্ষ্য দেবেন। আপনারাও আশে পাশে খুঁজে এ রকম বহু দৃষ্টান্ত পাবেন।
সুতরাং দাম্পত্য সম্পর্ককে শুধু বয়সের পার্থক্য দিয়ে বিচার করার যে প্রবণতা এটা অন্যায়, অসঙ্গত ও ভ্রান্ত। দেখেন তাদের সম্পর্ক কেমন ছিলো? আয়েশা রা. কি তার বয়সে অনেক বড় দাম্পত্য সঙ্গীর প্রতি বিরক্ত ছিলেন? তা তো নয়ই বরং তার প্রতি তার ভালোবাসা ও অনুরাগ ছিলো অধিকেরও অধিক। ভালোবাসার অতি আধিক্যের কারণে বরং অনেক সময় সমস্যায় পড়েছেন তিনি; রসূলের অন্য স্ত্রীদের ঈর্ষা করেছেন, তার নতুন বিয়েতে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন, রসূলের পেছনে গোয়েন্দাগিরি করেছেন, তাকে হালাল খাবার বা হালাল যৌনসঙ্গীকে নিজের ওপর হারাম করতে বাধ্য করেছেন ইত্যাদি নানা কিছু। সেসব কারণে বিভিন্ন সময় কুরআনের আয়াত পর্যন্ত নাজিল হয়েছে।
তার মতো শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারী স্পষ্টবাদী নারী সমাজ বা পরিস্থিতির চাপে পড়ে যদি তার বিরক্তির কথা না প্রকাশ করে থাকেন, অন্তরে ভালোবাসা না থাকলে ভালোবাসার এত অভিনয় কি তিনি করতেন? এত বেশি ভাণ করলেন যে নানা সমস্যা তৈরি হলো?
সুতরাং যাদের দাম্পত্য সম্পর্ক ছিলো এত মধুর ও সুন্দর, পরস্পরের প্রতি যাদের অনুরাগ ছিলো এত অত্যধিক, তাদের বয়সের পার্থক্য নিয়ে কথা না বলে নিজের ঘরে গিয়ে দেখেন আপনি আপনার দাম্পত্য সঙ্গীর কতটুকু সন্তুষ্টি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আদায় করতে পেরেছেন, কয়টা ভালো কথা একে অপরের সম্পর্কে আপনারা বলেন?
-কেএল